ফিচার্ড সাহিত্য ও কবিতা

চিঠি / বিপ্লব ঘোষ

চিঠি / বিপ্লব ঘোষ

এখন এই চিঠির কোন মানে নেই। আবার তুই চলে না গেলে এই চিঠি তির তির করে বয়ে যাওয়া কোন নদীর মত আমায় জাগিয়ে রাখে আর বলে যায়– এখন তো চিঠি লেখার সময়। তোর কাছ থেকে প্রথম চিঠি পাই কালিম্পং থেকে নীল রঙের খামে। আমিও উত্তর দিতে দেরি করিনি কোনদিন। তখন মাতৃহারা তোর কাছে আমি মা–বাবা। আর কী আশ্চর্য,সেসব কত যুগ ধরে আগলে রেখেছিস।একদিনও বলিসনি। তোর কবিতার খাতার মধ্যে পেলাম। মানুষ তো চিঠি লেখে দূরে গেলে। বছর দুই পরেই নিয়ে এলাম। তোর দাদার জলে ডুবে যাওয়া দৃশ্য দেখে ঠিক করি আর দূরে নয় । তারপর আর চিঠি লেখা হয়নি। আজ আবার তো এখন মহাদূর  দিগন্তে দাঁড়িয়ে আছিস। তাই ভাবলাম চিঠি লিখি। মনের মধ্যে যদি একটু শান্তি পাই। না হলে ওই বয়ে যাওয়া ঢেউ আমাকে যে তাড়িয়ে বেড়ায় আর বলে– লেখো, লেখো– হারিয়ে যা পেয়েছো। তাই আজ বসেছি।কোন মানে নেই তবু যে  মানে আছে সেও তো কম নয় ! 

তোর শেষ জন্মদিন আসছে। ” শেষ” বলছি কারণ তুই জেনেছিস,দিন ফুরিয়ে এসেছে ।তাই বলেছিলি নভেম্বর মাসে,এই শীত পেরোলে আর একটি বছর যদি থাকতে পারি ! শীতেই যত ভয়। সেই আশংকাই সত্যি হলো । জন্মদিন আসার দুদিন আগেই অর্থাৎ আঠাশে নভেম্বর দুপুরে শ্বাস থেমে গেল।
 
যত আপনজন ছিল  প্রত্যেকের জন্য মনে করে, লিখে লিখে গিফ্ট অনলাইনে কিনে দিয়েছিস। আমাকে টাকা দিয়ে একটা কিছু কিনতে বলে রোজ মনে করাচ্ছিস। বিদায় বেলার শেষ উপহার। খুব ইচ্ছে জেগেছিল শেষ জন্মদিনে নাকে অক্সিজেনের নল নাকে নিয়েও সন্ধ্যায় কেক কাটার পর সবার সাথে নাচ করবি। কী ভয়ংকর ইচ্ছে ! যতদিন আছি ভাল করে আনন্দ করে বাঁচ। দুঃখ করে,চোখের জল ফেলে লাভ নেই। সেই অন্তিম সাধও অপূর্ণ থেকে গেল। দুদিন আগেই…..
 
যত টাকা, বীমা, গয়না আর যা কিছু কাজের সব বলে বুঝিয়ে দিলি দিনের পর দিন। কোনোভাবেই যেন ভুল না করি। শূন্য হয়ে যাবার আগে সব বিলিয়ে দেবার কথা।সেই শিখলাম।কিছুই থাকে না জীবনে। সব দিয়ে,রেখে যেতে হয় ।জানি আমি চলে গেলে কোথাও কিছু কম পড়বে না।নদীতে জোয়ার ভাটা আসবে,  বারান্দায় দাঁড়ালে সেই চাঁদ উঠবে। সেদিনও জানলার পাশে মেহগনি গাছের সব পাতারা ঝরে যাবে শীতের শেষে। আবার সবুজ হবে।
” আমি চলে যাব ব’লে 
চালতাফুল কি আর ভিজিবে না শিশিরের জলে
নরম গন্ধের ঢেউয়ে ? ” 
এসব কত কথাই না বলতিস রাত গভীর হলে আমাকে একা পেলে।
তাই জীবিতকালে ত্যাগ যে করতে পারে তার মত সুখী কেউ নেই।মানুষ বাঁচে যে যার মত সুখের সন্ধান করে।  যদি তারা জানত দেবার মত সুখ আর নেই। আজ আমি সেই মন্ত্রে দীক্ষিত হতে চাই । আরো কত কী যে শিখলাম! তা বলে শেষ করা যাবে না।পরে বুঝেছি এসব জ্ঞান অর্জন করার পিছনে ছিল অগাধ পড়াশোনা নীরবে।
 
আজ আমার সময় হয়ে এল।যেকোন দিন চলে যাব।মেয়ের শেখানো পথে এক এক করে বর্ম খুলে রাখছি ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে ।সব দিয়ে শূন্য হবার আনন্দে। মেয়ে জীবন দিয়ে জানিয়ে গেল। আজ তোর ছবির সামনে নতজানু হয়ে প্রণাম করে বলেছি — আমি যেন শেষ সোনালী  অস্তরাগের আলোয় সোনা হতে পারি ! তুই আমার শিক্ষাগুরু ।
 
না, না এসব তো কোন চিঠি নয়  ! যা হলো সব ঘুমঘোরে, সবই কি স্বপ্ন ? ঠিক নিজেও কি জানি  ! 
সংবাদটি শেয়ার করুন