তবে কি ইউরোপে করোনার নতুন হটস্পট হতে চলেছে রোমানিয়া?
রাকিব হাসান রাফি, স্লোভেনিয়া ।। খুব সম্ভবত ইউরোপে করোনার নতুন হটস্পট হতে চলেছে রোমানিয়া। প্রতিনিয়ত দেশটিতে নতুন করে গড়ে এক হাজারের বেশি মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। ওয়ার্ল্ডওমিটারস ডট ইনফো কর্তৃক প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ ইউরোপের এই দেশটিতে শনিবার (২২ আগস্ট) নতুন করে প্রাণঘাতী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ১৮৯ জন।
রোমানিয়া দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে অবস্থিত ৯২ হাজার ৪৬ বর্গমাইলের মাঝারি আয়তনের দেশ, যার দক্ষিণে রয়েছে বুলগেরিয়া, উত্তরে ইউক্রেন, পশ্চিমে হাঙ্গেরি, দক্ষিণ-পশ্চিমে সার্বিয়া এবং পূর্ব দিক বরাবর রয়েছে মলদোভা ও কৃষ্ণসাগরের উপকূল।
সর্বশেষ ২০১৮ সালের জনগণনা অনুযায়ী দেশটিতে প্রায় দুই কোটির মতো মানুষের বসবাস। আয়তন অনুযায়ী রোমানিয়া ইউরোপের মধ্যে দ্বাদশ বৃহত্তম রাষ্ট্র এবং জনসংখ্যার দিক থেকে এটি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর মাঝে সপ্তম বৃহত্তম দেশ। বুখারেস্ট দেশটির রাজধানী ও বৃহত্তম নগরী। ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নিকোলেই চসেস্কু রোমানিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রোমানিয়ায়র গর্জে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়। আক্রান্ত ব্যক্তি ৭১ বছর বয়সী এক ইতালিয়ানের সংস্পর্শে এসেছিলেন, যিনি মূলত পারিবারিক এবং একই সাথে ব্যবসায়িক কাজে ইতালির কাত্তোলিসা থেকে রোমানিয়াতে এসেছিলেন।
পরে তিনি আবার যখন ইতালিতে ফিরে যান, তখন তার শরীরে কোভিড-১৯ এর উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়। এরপর ধীরে ধীরে দেশটিতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। প্রথম কয়েক দিন রোমানিয়াতে যাদের শরীরে করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়, তাদের বেশিরভাগই সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার কয়েক দিন আগে ইতালি ভ্রমণ করেছিলেন। উল্লেখ্য যে উন্নত জীবনের আশায় এবং একই সাথে তুলনামূলক বাড়তি আয় ও ভাষাগত সামঞ্জস্যতার কারণে রোমানিয়াতে বসবাসরত অধিবাসীদের একটি বড় অংশের মানুষ প্রত্যেক বছর ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স এ সকল দেশে পাড়ি জমান।
ফার্স্ট ওয়েভে রোমানিয়া করোনা মোকাবিলায় অনেকটা সফল ছিল। ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ইউরোপের এ সকল দেশ করোনার ভয়াল থাবায় প্রতিনিয়ত যেখানে মৃত্যুর মিছিল দেখেছে, সেখানে রোমানিয়াতে করোনা পরিস্থিতি ছিল অনেকটা নিয়ন্ত্রণে। বিশেষ করে লকডাউন এবং একই সাথে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ ও স্থানীয় প্রশাসনের তৎপরতার কারণে রোমানিয়াতে সেভাবে করোনার বিস্তার দেখা যায়নি বললেই চলে।
গত ১১ এপ্রিল রোমানিয়াতে ৫২৩ জনের শরীরে কোভিড-১৯ এর উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়, নতুন করে সংক্রমণের হার বিবেচনায় একদিনের ব্যবধানে ফার্স্ট ওয়েভে যেটি ছিল সর্বোচ্চ। কিন্তু জুনের মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু করে জুলাইয়ের দিকে এসে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীতে মোড় নেয়। সেকেন্ড ওয়েভে অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে দেশটিতে পুনরায় নতুন করে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। একই সাথে বাড়তে থাকে মৃত্যুর মিছিল।
সারজিউ মিউরেসান, পেশায় একজন কম্পিউটার প্রোগ্রামার যিনি রোমানিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর ওরাদায় বসবাস করেন। তার সাথে কথা বলে জানা গেলো যে, গ্রীষ্মকালীন অবকাশকে কেন্দ্র করে মানুষ রোমানিয়ার বিভিন্ন ট্যুরিস্ট স্পট বা সমুদ্র তীরবর্তী রিসোর্টগুলোতে জড়ো হচ্ছেন, যার প্রভাবে দেশটিতে নতুন করে করোনার প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি লকডাউন কিংবা জরুরি অবস্থা চলাকালীন মানুষ যেভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা কিংবা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ওপর তৎপরতা দেখিয়েছে, লকডাউন অথবা জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করার পর মানুষ আগের মতো সচেতন নেই স্বাস্থ্যবিধি কিংবা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে।
এছাড়াও তিনি রোমানিয়ার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর এক ধরনের অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তার মতে, স্বাস্থ্যসেবার দিক বিবেচনায় দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় শহর কিংবা মফস্বল এলাকাগুলো পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর কিংবা মফস্বল এলাকাগুলোর থেকে অনেক পিছিয়ে। তাছাড়া পশ্চিম ইউরোপের দেশ বিশেষত জার্মানি, ফ্রান্স, সুইডেন, ইতালি, ডেনমার্ক, অস্ট্রিয়া এ সকল দেশের তুলনায় রোমানিয়া অর্থনৈতিক দিক থেকে যেমন অনেক পশ্চাৎপদ, ঠিক তেমনি রোমানিয়ার স্বাস্থ্যগত অবকাঠামো তেমন একটা আশানুরূপ নয়। তাই অনেকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালগুলোতে শরণাপন্ন হওয়ার ক্ষেত্রে এক ধরণের ইতস্তত বোধ করছেন। এজন্য অনেকের শরীরে কোভিড-১৯ এর উপসর্গ থাকার পরেও তারা টেস্ট করা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখছেন।
এ কারণে প্রকৃতপক্ষে দেশটিতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা নিরূপণ করাটা জটিল হয়ে পড়েছে এবং সার্জিউ দাবি করেছেন পরিসংখ্যানের তুলনায় প্রকৃতপক্ষে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি হতে পারে। এছাড়াও দেশটিতে সেকেন্ড ওয়েভে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির আরও একটি কারণ হচ্ছে বলকান দেশ যেমন : সার্বিয়া, বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, মেসিডোনিয়া এ সকল দেশ থেকে রোমানিয়াতে মানুষের যাতায়াত বৃদ্ধি পাওয়া।
অন্যদিকে যেহেতু দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন একটা ভালো নয়, তাই সরকার নতুন করে আবার লকডাউন কিংবা জরুরি অবস্থা জারি করার সাহস পাচ্ছে না। ফলে দেশটিতে সকল কিছু চলছে স্বাভাবিক গতিতে। যদিও বুখারেস্ট, তিমিসোয়ারা, ইয়াস, ব্রাসোভসহ দেশের বড় শহরগুলোতে পাবলিক প্লেসগুলোতে মাস্ক পরিধান করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং এ ব্যাপারে দেশটির স্থানীয় প্রশাসন অত্যন্ত কঠোরতা অবলম্বন করছে। কিন্তু গ্রাম বা মফস্বল এলাকাগুলোতে বাস্তবতা একেবারে ভিন্ন বলে সার্জিও জানিয়েছেন। ফলে দেশটিতে প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা, এমনকি বর্তমানে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর মাঝে রোমানিয়াতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটছে।
ওয়ার্ল্ডওমিটারস ডট ইনফো কর্তৃক প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের এ দেশটিতে মোট করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৭৮ হাজার ৫০৫ জন, এখন পর্যন্ত মোট মৃত্যুবরণ করেছেন ৩ হাজার ২৭২ জন এবং চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন ৩৫ হাজার ২৮৭ জন। প্রতিদিন যেরকম এক হাজারের ওপর মানুষ দেশটিতে নতুন করে এ প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন, একই সাথে প্রত্যেকদিন গড়ে ৩৫ থেকে ৪০ জনের মৃত্যু ঘটছে।
ভৌগোলিক দিক থেকে ইউরোপ মহাদেশে রোমানিয়ার অবস্থান খুবই গুরত্বপূর্ণ। রোমানিয়াকে সেন্ট্রাল ইউরোপ, পূর্ব ইউরোপ এবং বলকান অঞ্চলের মধ্যকার ক্রসরোড বলা হয়। এছাড়াও যেহেতু রোমানিয়া আর্থিকভাবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর মাঝে তুলনামূলক অস্বচ্ছল অবস্থানে রয়েছে, তাই রোমানিয়ার অধিবাসীদের একটি বড় অংশ প্রতিনিয়ত জার্মানি, ফ্রান্স, সুইডেন, ডেনমার্ক, ইতালি, স্পেন, অস্ট্রিয়া, নেদারল্যান্ডসসহ পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে পাড়ি জমান জীবিকার আশায় কিংবা উন্নত জীবন ও তুলনামূলক অধিক আয়ের আশায়। তাই কোনা কারণে রোমানিয়াতে যদি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যায় গোটা ইউরোপের জন্য সেটি হবে এক মারাত্মক অশনি সংকেত।
সিএ/এসএস
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন