দীর্ঘশ্বাস – ১ । সুশীল কুমার পোদ্দার
সীমান্ত এলাকা। সন্ধ্যা হলেই ঝুপ করে রাত্রি নেমে আসে। প্রগাঢ় অন্ধকারে ঢেকে যায় চরাচর। রাস্তার ধারের টিমটিমে আলোগুলো সে অন্ধকার কিছুতেই দূর করতে পারে না। সে অন্ধকারে জেগে উঠে অন্য এক জগৎ। সন্ধ্যার পর এখানে কোন ট্রেন থামে না। প্রবল বেগে অন্ধকারের বুক চিরে চলে যায় ট্রেন। এখানে সেখানে ঝুপ ঝুপ করে কি যেন ঝরে পড়ে ট্রেন থেকে। মাঝে মাঝে অদূরে হুইসেল বেজে উঠে, সীমান্তের ওপার থেকে বাতাসের সাথে ভেসে আসে হিন্দি গানের দু একটা পরিচিত সুর।
এ প্রগাঢ় অন্ধকারে আমার অন্ধকার জগতের অনেক কিছু দেখতে ইচ্ছে করে। মাঝে মাঝে এগিয়ে যাই রেললাইনের পাশে ঝুঁকে থাকা বিশাল আকার কড়ুই গাছটার কাছে। সীমান্তের ওপারে ঝুঁকে থাকা আরেকটা একই রকম কড়ুই গাছ । রেললাইন দিয়ে বিভাজিত হলেও ওরা একে অপরের সাথে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে থাকে। সামান্য বাতাসে ঊর্ধ্বাকাশে পাতায় পাতায় জড়াজড়ি করে, ডালপালা মেলে একে অপরের গায়ে পরম আহ্লাদে লুটিয়ে পড়ে। গাছের পাতার সেই সিঞ্চন আমায় অন্য জগতে নিয়ে যায়। এখানে সেখানে মাটি ফুরে বেরিয়ে আসা শিকড় গুলোর দিকে তাকিয়ে আমি কেন যেন ওদের উৎস খুঁজি। আমার কেন যেন মনে হয় দুই বাংলার দুই কড়ুই গাছ পরস্পর শিকড়ের বন্ধনে আবদ্ধ। ওরা নির্দ্বিধায় ঢুকে পড়েছে অন্য সীমান্তে, যেমন করে সেই কৈশোরের এক নিরপরাধ বয়সে আমিও ঢুকে পরেছিলেম অপর সীমান্তে। সেদিন আমার মনে ছিল অজস্র কৌতূহল। প্রকৃতি কিভাবে দুটো দেশকে বিভাজিত করেছে তা দেখতে আমি আপন মনে হেটে হেটে কখন যে সীমান্ত রেখা পার করেছিলেম বুঝতে পারিনি। সীমান্ত রক্ষী বাহিনী আমায় যখন অনধিকার প্রবেশ করার অভিযোগে একটা ঘরে বন্ধী করে রাখে তখন বুঝতে পারি আমি অন্য ভূমিতে পা রেখেছি। কিন্তু মনের দ্বিধা আমার যে দূর হয়না। আজ আমি তাই আবারো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি দুই বাংলার মাটি, জল, বাতাসকে। আজ আমায় বাধা দেবার তেমন কোন প্রতিবন্ধক নেই। আমাকে সবাই জানে আমি এখানকার কাস্টম কর্মকর্তার ছোট ভাই।
আশীর দশক। এক দুরন্ত সময়ের সাক্ষী আমি। দেশে সামরিক শাসন। বিশ্ববিদ্যালয় খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে। এক দিন চলে তো দুদিন বন্ধ। ছাত্র আন্দোলন, পুলিসের নির্মম অত্যাচার, গুলি বিদ্ধ ছাত্রের লাশ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। খবরের কাগজে হেড লাইনে মাঝে মাঝেই বড় বড় করে লেখা ওঠে ‘ DU closed sine die’। sine die শব্দটার সাথে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে খবরের কাগজে। এমনি এক sine die কালে আমি আমার অলস সময় পার করতে চলে যাই সীমান্ত এলাকা হিলিতে।
আমার বড়ভাই সেখানে কাস্টমস কর্মকর্তা। হিলি স্থল বন্দর তখন এক স্বল্প পরিচিত অঞ্চল। শ্রীহীন, গ্রামীণ জনপদ। ভগ্ন রাস্তাঘাট, ক্ষয়িষ্ণু কিছু প্রাচীন ইমারত আর একটা রেলওয়ে স্টেশন। একতলা এক ভবনে আমার বড়ভাইয়ের অফিস। সকাল হলেই এ জনপদ জেগে ওঠে। সীমান্তের ওপার থেকে কমলা, আপেল, পাথরের ট্রাক আসে। কুলী মুজুরের উচ্চ কোলাহলে মুখরিত হয় জনপদ। কর্মহীন আমি বড় ভাইয়ের অফিসে বসে থাকি। কুলী মুজুরের সাথে কথা বলি, নিঃশঙ্ক চিত্তে রেললাইন পার হোয়ে চলে যাই অপর সীমান্ত চৌকিতে। চোখে পড়ে ছোট ছোট ঝুপড়ী, ছোট ছোট হোটেল। বিনা পাসপোর্টে আসা দুই বাংলার দুঃস্থ আত্মীয়-স্বজন আশ্রয় নেয় এই সব ঝুপড়িতে। দালালেরা সময় সুযোগ বুঝে ওদের পার করে দেয়। পুলিস, বিডিয়ার, বি এস এফ নীরব থাকে। দেখেও দেখে না। দিনাজপুর-গামী ট্রেন যখন এ সীমান্ত এলাকা পার হয়, তখন কেন যেন ধুকে ধুকে চলে। রেললাইনের দুপাশে সন্তর্পণে দাড়িয়ে থাকে হুকারের দল। এপার থেকে তুলে দেওয়া ইলিশের ঝাঁকা ওপারে গড়িয়ে পড়ে, ওপার থেকে আসা শাড়ী কাপড়ের বড় বড় গাট্টিগুলে এপারে। এক অপূর্ব মিল বন্ধন প্রাণ ভরে উপভোগ করি।
সীমান্ত পার হতে আসা কিছু মানুষের বিমর্ষ চেহারা প্রায়ই চোখে পড়ে, চেহারায় কষ্টের ছাপ, কি যেন লুকাতে চায়। উদ্বিগ্ন মুখগুলো দেখে মনে হয় কে যেন ওদের পিছু নিয়েছে। এই বুঝি যা আছে সবটুকু কেড়ে নেবে। মনে প্রশ্ন জাগে ওরা কোথায় চলেছে? আর কি ফিরবে না? জিজ্ঞেস করলে উত্তর আসে না। একদিন এক অসহায় পরিবার কাস্টমস অফিসের বারান্দায় বিভ্রান্ত হয়ে বসে থাকে। ওদের সাথে প্রাচীন রংচটা ট্রাঙ্ক, ছোট ছোট অসংখ্য পুটুলি। কাস্টম অফিসে একে একে সব খোলা হয়। বেড় হয়ে আসে পিতৃপুরুসের ছবি, ঠাকুরের ছবি, বাস্তু ভিটের ছবি। আরও খুলতে খুলতে বেড় হয়ে আসে একটা দৈয়ের খুঁটি। কাপড় দিয়ে বাধা। খুলতেই বেড় হয়ে আসে কিছু ধুলো মাটি। সন্দেহ বেড়ে যায়। জেরার পর জেরা চলে। দরিদ্র মানুষটা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। স্যার আমার দেশের মাটি, বাস্তু ভিটের মাটি, চোখ ভরা জল নিয়ে মাথা নিচু করে অস্ফুট কণ্ঠে বলে ওঠে। একটা সুমসাম নিঃস্পব্ধতা নেমে আসে। আমি নীরবে ওদের চলে যাওয়া দেখি। রেললাইন পার হতে যেয়ে থমকে যেতে দেখি। গভীর বেদনায় কপালে মেখে নিতে দেখি দেশের মাটির শেষ তিলক।
দীর্ঘশ্বাস – ১ । সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী । ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স, মাস্টার্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান