ভ্রমণ

ভয়াবহ বিমান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ও অনুষঙ্গ ৩

বিল্লাহ ভাই

 

তৃতীয় পর্ব

ভয়াবহ বিমান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ও অনুষঙ্গ ৩ ।। আমার এবারের বাংলাদেশে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিলো জামালপুরে যে স্থানে খুররম শাহাদাৎবরণ করেছেন সে স্থানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ বিনির্মাণে সাহায্য করা এবং কাকিলাকুড়া হাইস্কুল ও বেলটিয়া হাইস্কুলে জে এস সি লেভেলে একাধিক মেধাবৃত্তি ঘোষণা করা। এর আগে ২০১৮ সনের ডিসেম্বর মাসে আমাদের গ্রামের বাড়িতে শহীদ খুররমের কবরের পাশে একটি স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তোলা হয়। কাজটি করতে গিয়ে আমি কাকিলাকুড়া ও সিঙ্গাবরুনা ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে একাধিক বৈঠক করি এবং তাঁদের সহযোগিতা নিয়েই কাজটি সে সময় ভালোভাবে করা সম্ভব হয়ে উঠে। কাজের প্রশংসাও করেছেন বহু মানুষ। আর উদ্বোধন উপলক্ষে অর্ধশতাধিক মুক্তিযোদ্ধার উপস্থিতিতে যে সমাবেশ করা হয় তা ছিলো একটি বিরল ঘটনা। মুক্তিযোদ্ধা শেরপুর জেলা কম্যান্ডারসহ শ্রীবরদি উপজেলা নির্বাহী অফিসার, উপজেলা পুলিশ-ইন-চার্জসহ কাকিলাকুড়া ও সিঙ্গাবরুনা ইউনিয়নের ৫৪ জন (তাঁদের উপস্থিতি স্বাক্ষরও একটি বিশেষ খাতায় দেয়া আছে) মুক্তিযোদ্ধার উপস্থিতিতে যে সমাবেশের আয়োজন করা করা তেমন কোনো অনুষ্ঠান ওই অঞ্চলে আগে হয়নি; এবং পরেও আর কখনো করা সম্ভব হবে না তা নিশ্চিত করে বলা যায়।

এই কাজটির সার্বিক দায়িত্ব আমি পালন করি। আমার ভাইবোনেরা উদারভাবে সাহায্য করেন। কাজটি করতে যেয়ে বেশ কিছু দুর্বল দিক আমার নজরে আসে যা ছিলো সত্যি হতাশাব্যঞ্জক। যারা বন্দুক হাতে নিয়ে একাত্তরে যুদ্ধ করেছেন নির্ভিক চিত্তে – জীবনকে বাজি রেখে – তাঁরা অতীতকে ভুলে আছেন নির্বিকারভাবে। তাঁদের মাঝে সেই অদম্য তারুণ্যের ছোঁয়া নেই – ভয়কে জয় করার সাহস নেই – সৎ থাকার মনোবলও অনেকের মাঝে আর অবশিষ্ট নেই। এই অধঃপাত দেখে মনে হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ছিলো সহজে ভুলতে পারা এক আবেগহীন পুরনো ঘটনা মাত্র। তাই আমি তাঁদেরকে বলি তাঁদের মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকার কথা আমাকে আলাদা আলাদাভাবে জানাতে যাতে করে আমি সেগুলি এডিট করে একটি পুস্তিকা বের করতে পারি এবং এলাকার স্কুলগুলিতে তা নিয়ম করে যাতে পঠিত হয় তার ব্যবস্থা করতে পারি। এ কাজে তাঁদের কোনো খরচা নেই। এর জন্য আমি একটি ছেলেকেও কাজে নিয়েছিলাম। ওঁর কাজ ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাঁদের স্মৃতিকথাগুলি লিখে আনতে। দুঃখের বিষয় কেউ তাতে সাড়া দেননি। সে বার কানাডায় ফিরে আসার আগে আমি ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কম্যান্ডারসহ কয়েকজনকে সাথে নিয়ে কাকিলাকুড়া হাইস্কুলের শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির সাথে বৈঠক করে বলে আসি যাতে সাধারণভাবে মুক্তিযুদ্ধ এবং বিশেষভাবে কাকিলাকুড়ার মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারে স্কুলের ছাত্রদেরকে নিয়মিতভাবে ধারণা দেয়া হয়। কারণ, মুক্তিযুদ্ধ একটি স্মৃতিস্তম্ভের মাঝে আটকে থাকার বিষয় নয়; চেতনায় এবং অভ্যাসে সর্বক্ষণ জাগিয়ে রাখার বিষয়। দুঃখের বিষয়, আজ অবধি এই প্রক্রিয়ার কোনো অগ্রগতি সেখানে হয়নি। যেখানে রেখে এসেছিলাম; সেখানেই রয়ে গেছে।

আরও পড়ুনঃ ভয়াবহ বিমান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ও অনুষঙ্গ ২

ওই অনুষ্ঠানটি করতে যেয়ে প্রায় ৩৭ বছর পর আমার সাথে আবারো দেখা হয় বন্ধুবর উৎপল কান্তি ধরের সাথে। ময়মনসিংহ জেলে আমরা ১৯৮০ সনের প্রথম দিকে একত্রে কাটিয়েছি কয়েক মাস এবং বন্দিদের একটি ন্যায্য আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে সফলও হয়েছি দারুণভাবে। তিনি সে সময় ছিলেন জামালপুর জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি। অল্প সময়েই আমি তাঁকে ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলাম। তিনি একজন দেশপ্রেমিক ও জনকল্যাণকামী রাজনীতিক। এখন জামালপুর মুক্তিসংগ্রাম জাদুঘরের অন্যতম সংগঠক – যার ধ্যানধারণার মুল চালিকাশক্তি হলো মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গড়ে উঠা আদর্শবোধ। তাই এবার তাঁকে পেয়ে আমার মানসিক শক্তিও কিছুটা বেড়ে যায়।

প্রবাসীদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ভিডিও দেখতে হলে

এ বছরের প্রথম অর্ধে একদিন উৎপলদা আমার কাছে প্রস্তাব করেন জামালপুরের যে স্থানে যুদ্ধরত অবস্থায় একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর শহীদ খুররম আত্মাহুতি দেন সেখানে তাঁরা একটি স্মৃতিস্তম্ভ করতে চান জাদুঘরের পক্ষ থেকে। প্রস্তাবটি আমার কাছে খুব ভালো লাগে একাধিক কারণে। প্রথমতঃ যে স্থানটিতে খুররম দেশের জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছেন সে স্থানটিকে ঐতিহাসিকভাবে চিহ্নিত করে রাখা এবং খুররমকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধ ও বর্তমান প্রজন্মের মাঝে চেতনাগত সংযোগ স্থাপনের সুযোগ করে দেয়া। অন্য কারণটি হলো এই যে, ঐতিহাসিক তাৎপর্যসহ স্থাপনাটির সংরক্ষণ করবে জামালপুর মুক্তিসংগ্রাম জাদুঘরের মতো নিবেদিতপ্রাণ, নির্ভরযোগ্য ও গৌরবময় প্রতিষ্ঠানটি। ——- চলবে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

twelve − seven =