প্রবাসের সংবাদ

লজ্জায় ডোবালেন এমপি পাপুল

লজ্জায় ডোবালেন এমপি পাপুল

জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাঁর দেশ ও জনগণের স্বার্থ নিয়ে কাজ করার কথা। অথচ তিনিই কি না প্রবাসে জড়ালেন অর্থপাচার ও মানবপাচারের মতো ঘৃণ্য অপরাধে। হঠাৎ সংসদ সদস্য (এমপি) বনে যাওয়া মোহাম্মদ শহিদ ইসলাম ওরফে কাজী পাপুলকে এই অপরাধে কুয়েতের আদালত চার বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন।

গতকাল বৃহস্পতিবার কুয়েতের ফৌজদারি আদালতের বিচারক আবদুল্লাহ আল ওসমান এই রায় দেন। কারাদণ্ডের পাশাপাশি পাপুলকে ১৯ লাখ কুয়েতি দিনার (প্রায় ৫৩ কোটি ২১ লাখ টাকা) জরিমানা করা হয়েছে।

পাপুলের সাজার খবর কুয়েতের সংবাদমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ কুয়েত চ্যাপ্টারের সাধারণ সম্পাদক আতাউল গণি কালের কণ্ঠকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। বাংলাদেশের কোনো আইন প্রণেতার এভাবে বিদেশে দণ্ডিত হওয়ার ঘটনা আর কখনো ঘটেনি।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, অর্থপাচার ও মানবপাচারের অভিযোগ নিয়ে একজন সংসদ সদস্যের বিদেশের কারাগারে আটক থাকা এবং শেষ পর্যন্ত অভিযোগ প্রমাণিত হয়ে সাজা পাওয়া অত্যন্ত লজ্জাজনক।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক কালের কণ্ঠকে বলেন, এটি রাষ্ট্রহিসেবে বাংলাদেশের ও জনগণের জন্য খুবই বিব্রতকর। ওই ব্যক্তি বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশকে অসম্মানিত করেছেন।

কুয়েতের আল কাবাস ও আল রাই পত্রিকার অনলাইনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আবদুল্লাহ আল ওসমানের নেতৃত্বে কুয়েতের ফৌজদারি আদালত গতকাল বাংলাদেশি আইন প্রণেতার বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক মামলার রায় ঘোষণা করে। আদালত পাপুল ছাড়াও কুয়েতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরখাস্তকৃত কর্মকর্তা মাজেন আল জাররাহসহ কুয়েতি তিন কর্মকর্তাকেও চার বছরের কারাদণ্ড এবং একই পরিমাণ অর্থদণ্ড দিয়েছেন। কুয়েতের এই জেনারেলসহ ওই কর্মকর্তারা সে দেশে পাপুলকে অনৈতিকভাবে ব্যবসা পরিচালনায় মদদ দিয়েছেন।

লক্ষ্মীপুর-২ (রায়পুর ও লক্ষ্মীপুর সদরের আংশিক) আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য পাপুল প্রায় আট মাস ধরে কুয়েতে আটক আছেন। অর্থপাচার, মানবপাচার ও শ্রমিক শোষণের অভিযোগে গত ৬ জুন কুয়েত সিটির মুশরিফ এলাকার বাসা থেকে পাপুলকে গ্রেপ্তার করে সে দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

পাচারের শিকার পাঁচ বাংলাদেশির অভিযোগের ভিত্তিতে পাপুলের বিরুদ্ধে মানবপাচার, অর্থপাচার ও ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের শোষণের অভিযোগে মামলা করা হয়।

কুয়েতের পাবলিক প্রসিকিউশন পরে তদন্ত করে পাপুলসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে অর্থপাচার, মানবপাচার, ঘুষ লেনদেন ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ভঙ্গের অভিযোগ আনেন। অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর পাপুলের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বিচারকাজ শুরু হয়। এরপর ২৮ সেপ্টেম্বর মামলার রায় ঘোষণার জন্য দিন ঠিক করে দেন বিচারক।

আসামিদের মধ্যে মেজর জেনারেল মাজেন আল জাররাহ নাগরিকত্ব, পাসপোর্ট ও বসবাসের অনুমতি বিষয়ক দপ্তরের অ্যাসিস্ট্যান্ট আন্ডারসেক্রেটারি থাকা অবস্থায় ঘুষের বিনিময়ে পাপুলের বেশ কিছু কাজে সায় দেন বলে অভিযোগ ছিল। আর কুয়েতের পার্লামেন্টের মেম্বার সাদুন হাম্মাদ ও সালাহ খুরশিদের বিরুদ্ধেও বাংলাদেশি এই সংসদ সদস্যের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে অবৈধ সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছিল। তবে আদালতে তা প্রমাণিত হয়নি।

সাধারণ শ্রমিক হিসেবে কুয়েত গিয়ে বিশাল সাম্রাজ্য গড়া পাপুল ২০১৮ সালে লক্ষ্মীপুর-২ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

ওই নির্বাচনে ওই আসন আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দিয়েছিল, কিন্তু জাতীয় পার্টির প্রার্থী শেষ মুহূর্তে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালে ‘বিএনপি ঠেকানোর’ কথা বলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ পাপুলের পক্ষে কাজ করে বলে দলটির নেতাদের ভাষ্য।

পাপুল নিজে সংসদ সদস্য হওয়ার পর স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের কোটায় পাওয়া সংরক্ষিত একটি আসনে তাঁর স্ত্রী সেলিনা ইসলামকে সংসদ সদস্য করে আনেন।

প্রবাসী উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠিত এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন পাপুল, যেখানে তাঁর বড় অঙ্কের শেয়ার রয়েছে। তাঁর মালিকানাধীন মারাফি কুয়েতিয়া গ্রুপে ১৫ থেকে ২০ হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি কাজ করেন বলে কুয়েতে বাংলাদেশি কমিউনিটির ধারণা।

বাংলাদেশে দুর্নীতি দমন কমিশনও পাপুল, তাঁর স্ত্রী, শ্যালিকা ও মেয়ের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। পাপুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম ও  মেয়ে ওয়াফা ইসলাম সেই মামলায় জামিনে আছেন। তাঁদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।

এর আগে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কুয়েতে বাংলাদেশ দূতাবাস কুয়েত সরকারের কাছে পাপুলের বিষয়ে তথ্য চেয়েও পায়নি। গত অক্টোবর মাসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের কুয়েত সফরের সময়ও পাপুলের প্রসঙ্গ কোনো পক্ষই তোলেনি।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী একাধিকবার সাংবাদিকদের বলেছেন, বাংলাদেশের সংসদ সদস্য হিসেবে পাপুলকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। পাপুল কুয়েতের বাসিন্দা ছিলেন। সেখানে আইন ভাঙার অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলেছে, পাপুল সংসদ সদস্য হিসেবে কূটনৈতিক পাসপোর্ট পাওয়ার অধিকার রাখেন, কিন্তু তিনি সেই পাসপোর্ট নেননি। বরং বাংলাদেশি সাধারণ পাসপোর্টেই তিনি বিদেশে যাওয়া-আসা করতেন। ধারণা করা হয়, নজরদারি এড়াতেই তিনি এমনটি করতেন।

কুয়েতের আদালতে ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় সংসদ সদস্য পদ হারাতে হবে পাপুলকে। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তথ্য পেলে তবেই তাঁর সদস্য পদ খারিজের উদ্যোগ নেবে সংসদ সচিবালয়। আর পাপুলের সদস্য পদ নিয়ে কোনো বিতর্ক দেখা দিলে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে।

বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো আইন প্রণেতা নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে মুক্তি পাওয়ার পর পাঁচ বছর পর্যন্ত তিনি আর সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্য বিবেচিত হন না।

পাপুলের সংসদ সদস্য পদ নিয়ে প্রশ্ন উঠবে বলে মনে করেন জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার মো. ফজলে রাব্বী মিয়া। তবে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আদালত রায় দিয়েছেন মানেই সংসদ সদস্য পদ বাতিল হবে, বিষয়টি তেমন নয়। সংসদ তখনই তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে, যখন তাঁর বিচারের রায়ের কপি সংসদের কাছে পৌঁছবে। তবে সেটা ওই দেশের সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের সরকারের কাছে পাঠাতে হবে।’ অবশ্য আদালতের রায়ের সার্টিফায়েড কপিসহ স্পিকারের কাছে কেউ আবেদন করলে তা স্পিকার বিবেচনা করতে পারেন বলে তিনি মনে করেন। -কালেরকন্ঠ


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

 

সংবাদটি শেয়ার করুন