লেখালেখি

সৌদিতে নারী কর্মীর আঁধারে ঢাকা জীবন

মামুনুর রশীদ

⇒মামুনুর রশীদ।।

ধরা যাক, মেয়েটির নাম হাসনা অথবা কেয়া অথবা রাবেয়া। বাড়ি তার উত্তরবঙ্গে। বয়স ২০ বছর। ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছে সংসারের অভাব, দারিদ্র্য। অপুষ্টির কারণে শরীরে শক্তিরও অভাব। দু’চারবার বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। সেজেগুজে পাত্রপক্ষের সামনে গিয়ে বসে দু’চারটি প্রশ্নের জবাবও দিয়েছে। যৌতুকের নিয়ম প্রবল, বাবা টাকা জোগাড় করতে পারেননি। একমাত্র উপায় ছিল ক্ষুদ্রঋণ নেওয়া। কিন্তু ক্ষুদ্রঋণের টাকা পরিশোধ করার কোনো উপায় না থাকায় সেটাও হয়ে ওঠেনি। শেষ পর্যন্ত পাশের গ্রামের জনৈক সফর আলীর পরামর্শে বিদেশে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। হাসনার চোখে হঠাৎ স্বপ্ন এসে বাসা বাঁধে। বাবা-মাকে রাজি করানোর চেষ্টা করতে থাকে। সফর আলীর কথামতো আশ্বাস দেয়, টাকা ঋণ করা হবে। তা সে চাকরি করে দু’তিন মাসের মধ্যেই শেষ করে দেবে। অবশেষে ভিটেমাটি বন্ধক দিয়ে গ্রামের ধনী ব্যক্তিটির কাছ থেকে টাকা জোগাড় করে। সরকারি নিয়মেই টাকা-পয়সা জমা দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে; কিন্তু সমস্যা হয় বয়স নিয়ে। কারণ ২৫ বছরের নিচে কোনো নারী কর্মীকে বিদেশ পাঠানো সম্ভব নয়। ২৫ থেকে ৪৫ বছর হচ্ছে সরকারি নিয়ম। সফর আলী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান অফিস থেকে জন্ম নিবন্ধনের কাগজ বের করে ফেলেন। তার জন্য আবার বাড়তি কিছু টাকাও দিতে হয়। জেলা শহরের কোনো একটি প্রতিষ্ঠান থেকে নূ্যনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা ও প্রশিক্ষণের সার্টিফিকেট জোগাড় করা হয়। সেখানেও কিছু বাড়তি টাকা লাগে। এসব শেষ করার পর সেই স্বপ্নের দিন এগিয়ে আসে। বাবা-মা, ভাইবোনকে নিয়ে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভোরবেলায় পৌঁছে যায়। বিমানবন্দরে ঢোকার অনুমতি সবাই পায় না। বাবা মেয়েকে নিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দেন।

হাসনা কখনও ঢাকা শহরেই আসেনি। মুহূর্তেই এয়ারপোর্ট তার কাছে এক বিশাল ভয়ের জায়গা হয়ে দাঁড়ায়। এ সময় অবশ্য রিক্রুটিং এজেন্সির লোকেরা হন্যে হয়ে খুঁজছিল মেয়েটিকে। ওদের জেলা শহর থেকেই তিন মাস আগে একটা মোবাইল ফোন কিনেছিল। সেটা কেনার কারণ, বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে যোগাযোগ রক্ষা করা। ফোনটি মেয়ের কাছে হস্তান্তর এবং এজেন্সির লোকের কাছেই চোখের জলে কন্যাকে সোপর্দ করেন বাবা। হাসনা ইমিগ্রেশনের ভেতরে ঢোকার পরই কাচের মধ্য দিয়ে অপসৃয়মাণ একটি ছায়া দেখতে পান তিনি। কর্তব্যরত আনসার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বেশিক্ষণ দাঁড়াতে দেয় না। কাচের বাইরে থেকে বারবার মেয়েকে খোঁজার চেষ্টা করেন। তারপর ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসেন বিমানবন্দরের একেবারে বাইরে বড় রাস্তার পাশে। সেখানে এমনি অনেক পরিবার অপেক্ষা করে থাকে। শেষ বিমানটির উড্ডয়ন শেষ হতে হতে মাঝরাত হয়ে যায়। তখন পাশের রাস্তা পার হয়ে রেলস্টেশনে এসে আশ্রয় নেন। শেষ রাতের দিকে উত্তরবঙ্গের একটি ট্রেন আছে। সেই ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। সেই ভোরবেলায় ট্রেন স্টেশনে এসে নেমেছিল। সারাদিন তেমন খাওয়া-দাওয়া হয়নি। এখন বেশ ক্ষুধা অনুভব করেন। হাসনার ছোট দুই ভাই, এক বোন, মা-ও এসেছিলেন। সবাইকে নিয়ে বাবা স্টেশনের বাইরে একটা অস্থায়ী বাঁশের বেড়ার হোটেলে খেতে বসেন। এ কোনো তৃপ্তির খাওয়া নয়, শুধু উদরপূর্তি। বিলটা ওদের কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়। একবেলা খাওয়ার জন্য কোনোদিন এত টাকা খরচ করেননি। তাই মেনে নিতে কষ্ট হলেও উচ্চবাচ্য করেন না। স্টেশনে গিয়ে আশ্রয় নেন।

হাসনা তখন উড়োজাহাজে। ভেতরটা তার কাছে অস্বাভাবিক একটা বসার জায়গা। ঝড়ের পরে একটা মুরগি যেমন আশ্রয় নেয়, তেমনি জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। খাবারের বাক্সটি এলেও সে যেহেতু কখনও চামচ ব্যবহার করেনি, তাই সামনে নিয়ে বসে থাকে। এয়ারহোস্টেস ব্যাপারটি বুঝতে পারেন। আশপাশের নারীরাও বুঝতে পারেন। সবাই মিলে তাকে হাত দিয়ে খাবার অনুমতি দেন। এত উঁচুমানের খাবার জীবনে সে খায়নি। তাই খাবারের ঘ্রাণটাই তার কাছে বিস্বাদ হয়ে ওঠে। অল্প কিছু খেয়ে সে রেখে দেয়। এর মধ্যে উড়োজাহাজের ভেতরে আলো নিভে যায়। এই আঁধার তার কাছে অসহ্য লাগে। সিট বেল্টের মধ্যে একটা বন্দিদশায় তার রাত কাটে। সকালবেলায় মাইকের শব্দ শুনে সে কিছুই বুঝতে পারে না। কিন্তু আশপাশের মানুষের চলাচল দেখে বুঝতে পারে, গন্তব্যে এসে গেছে। আশপাশের লোকের সাহায্যে তার ছোট্ট পুঁটলির মতো ব্যাগটি নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। তারপর সবার সঙ্গে সঙ্গে এক নিরুদ্দেশ যাত্রায় ইমিগ্রেশনে এসে পৌঁছে। তার ক্লাস ফোর পড়া জ্ঞানে সে কিছুই উদ্ধার করতে পারে না। এবার এক সহৃদয় নারী কর্মীর কাছ থেকে জানতে পারে, তারা জেদ্দা পৌঁছে গেছে। এর পর এজেন্সির লোকেরা যথাস্থানে পৌঁছে দেবে। এবার সে কেঁদে কেঁদে নারী কর্মীকে বলে, আমি কিছুই বুঝি না; আমারে দয়া করে সঙ্গে রাখেন। নারী কর্মী বলে, সেও কিছু বোঝে না; তবে শুনেছে, এজেন্সির লোকেরা এসে নিয়ে যাবে।

ইমিগ্রেশন পেরিয়ে এজেন্সির লোকদের সঙ্গে দেখা হয়। তারা নিয়ে যায় একটা জায়গায়। সেখান থেকে তার নাম উচ্চারিত হতে থাকে। ওখানে একজন বাঙালি বাংলা ভাষায় বুঝিয়ে দেয়, কার কোথায় যেতে হবে। জানতে পারে, তার যেতে হবে রিয়াদ। আবার কেউ যাবে দাম্মাম, কেউ যাবে অন্য শহরে। তবে চিন্তা নেই, জায়গামতো পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে তারা। ইতোমধ্যে কিছু খাবার ও পানি পেয়ে যায় এবং এজেন্সির লোকজন বাথরুমে যাবার ব্যবস্থাও করে দেয়। সে অনুমান করতে পারে না, কতদূরে তার সেই গ্রামটি। এক রাতে কতদূরে আসা যায়। মেয়েটিকে যথাস্থানে এজেন্সির লোকেরা পৌঁছে দেয়। সে এক প্রাসাদপ্রতিম বাড়ি। সে বাড়ির গৃহকর্তা কী ভাষায় কথা বলছে, সে বুঝতে পারে না। তাকে বাড়ির ভেতরে দু’তিনজন মহিলার সঙ্গে নিয়ে যায়। তাদের কথাও সে কিছু বুঝতে পারে না। তাদের গ্রামেও মাঝেমধ্যে ভিন্নভাষী নারীরা আসত। ভাঙা ভাঙা বাংলায় কথা বলত। কাজেই তেমন অসুবিধা হতো না। মহিলাদের মধ্যে একজন তাকে শোবার ঘর দেখিয়ে দেয় এবং রান্নাঘর, গোসলখানা ও কী কী কাজ করতে হবে তা ভিন্ন ভাষায় বুঝিয়ে দেয়। এর কিছুই সে বুঝল না। এজেন্সির লোকেরা অফিসের মাঝপথে এক জায়গায় থামিয়ে ওদেরকে একটা সিমকার্ড দিয়েছিল এবং বুঝিয়ে দিয়েছিল, বাংলাদেশে ফোন করতে হলে কী করতে হবে। একটুখানি অবসর মিললেই সে বাংলাদেশে ফোন করতে শুরু করে। যেহেতু বাড়ির একমাত্র ফোনটি সে নিয়ে এসেছে, তাই বুদ্ধি করে সে পাশের বাড়ির ফোন নম্বরটি নিয়ে এসেছিল। সেই নম্বরে ফোন করে পেয়ে গেল সে বাড়ির ছেলে তাইজুলকে। তাইজুলকে শুধু এই সংবাদটি দিল- আমি কাজের জায়গায় পৌঁছে গেছি, তারা যেন চিন্তা না করে। ওই দিন থেকেই তার কাজ শুরু হয়ে গেল। প্রথমে ঘর মোছা, থালা-বাসন মাজা। কাপড় ধোয়ার জন্য ওয়াশিং মেশিনের ব্যবহার সে জানে না। আরেকজন বিদেশি গৃহপরিচারিকার সাহায্যে এসব সে আস্তে আস্তে শিখতে শুরু করল। এর মধ্যে ভুল করার কারণে দু’চারটে চড়-থাপ্পড় তাকে খেতে হয়েছে। একদিন তো রীতিমতো গরম চামচ দিয়ে তার গালে আঘাতও করেছে। অনেক দিন লাল হয়ে ছিল জায়গাটা। এক মাস যেতে না যেতেই সে জানতে পারল, গৃহকর্তার সঙ্গে ১৮শ’ মাইল দূরে এক জায়গায় তাকে যেতে হবে। যাত্রার আগে ওই বাড়ির বধূরা শাসনের চোখে অনেক কিছু বলে দিল। তার কিছুটা আকার-ইঙ্গিতে বুঝতে পারল হাসনা। মাস শেষে কিছু বেতন পেয়েছিল, কিন্তু টাকা কী করে পাঠাতে হয় তা সে জানত না। যে গাড়িতে দূরের পথে যাত্রা করল সে, ড্রাইভার সৌভাগ্যক্রমে বাঙালি। তার কাছে সবকিছু খুলে বলায় সে টাকা পাঠানোর দায়িত্বটি নিল। ইতোমধ্যে এজেন্সি মোবাইলে যে টাকা দিয়েছিল, তা শেষ হয়ে গেছে। পথে যাত্রাবিরতি হলো; সেও গৃহকর্তার আরেক বাড়িতে। এমনি করে তিন দিন পর পৌঁছাল আরেক জায়গায়। সেই জায়গায় এসে জনশূন্য এক বাড়িতে তাকে থাকতে হয়। ইতোমধ্যে রান্নাবান্নার কাজ সে কিছুটা শিখে নিয়েছিল। রাতের খাবারের পর নানা ধরনের আদেশ-নির্দেশ তাকে মানতে হচ্ছে।

রাতে ঘুমানোর জন্য কর্তার পা টিপে দেওয়ার কাজও তাকে করতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে সেই বাঙালি ড্রাইভার চলে গেছে। তার জায়গায় এসেছে ফিলিপিনো এক ড্রাইভার। কিছুদিন পর গৃহকর্তা দেশের বাইরে চলে যাবে। তখন হাসনার ভাগ্য সমর্পিত হলো তারই কর্তার পরিচিত এক প্রতিবেশীর কাছে। প্রতিবেশীর পরিবার-পরিজন আছে। এই লোকটি বৃদ্ধ কিন্তু তার অনেক স্ত্রী। সবার আদেশ-নির্দেশ রক্ষা করতে প্রাণান্তকর অবস্থা। রাতের বেলায় ওই বাড়ির এক ড্রাইভার তার ঘরে ঢুকে পড়ে এবং নানাভাবে পীড়ন করতে থাকে। যেহেতু সে ভাষাটা ঠিকমতো জানে না, তাই সবটা বুঝিয়ে বলতেও পারে না। এক রাতে সে ধর্ষিতও হয়। পরদিন বিষয়টি জানাতেই সব স্ত্রী যেন একটা মজা পেয়ে যায়। তারা বিষয়টি নিয়ে হাসাহাসি করে। বৃদ্ধ গৃহকর্তা বিষয়টি বুঝতে পারে এবং তার এক প্রতিবেশীর কাছে হস্তান্তর করে। সেখানে গৃহকর্তা বেশ নিঃসঙ্গ। সে নিজেই ধর্ষক হয়ে ওঠে। এ অবস্থা থেকে মুক্তির আশায় সে গ্রামে মা-বাবাকে জানায়, বিদেশে আর থাকতে চায় না। হাসনার একজন আত্মীয় ঢাকায় সচিবালয়ে কাজ করত। তার মাধ্যমে কীভাবে যেন রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাসে সংবাদটি পৌঁছায়। দূতাবাসের কর্মীরা এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করে মেয়েটির বৃত্তান্ত জানতে চায়। কিন্তু কোথাও তাকে খুঁজে পায় না। শেষ পর্যন্ত বেশ কিছুদিন পর খবর আসে, একজন বাঙালি নারী কর্মীকে কোনো এক মরুভূমির প্রান্তে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে। একজন সহৃদয় বিদেশি তাকে একটি হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে গেছে। হাসপাতাল থেকে যোগাযোগ করার পর দূতাবাস ও এজেন্সির কর্মীরা সেফ হোমে নিয়ে আসে। সেফ হোমে অনেক দিন থাকার পর হাসনাকে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

এ তো গেল একটি কাহিনি। এমনি অসংখ্য কাহিনির জন্ম হচ্ছে প্রতিদিন নারী গৃহকর্মীদের নিয়ে। বাংলাদেশের নারীদের চিরকালই বিদেশ ভ্রমণ হচ্ছে পরিবারের সঙ্গে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ইংল্যান্ডে অনেক শ্রমিকের অভিবাসন হয়েছে। সেটাও পরিবারসহ। একা কোনো নারী সাধারণত বিদেশ ভ্রমণ করেনি। যেভাবে মধ্যপ্রাচ্যে নারী গৃহকর্মী পাঠানো হচ্ছে, তা একটি আদিম দাস ব্যবস্থার মতো। উপমহাদেশে শ্রীলংকা এটি বন্ধ করে দিয়েছে। ভারতও নারী গৃহকর্মী পাঠায় না বিদেশে। এখন ফিলিপাইন ও বাংলাদেশ নারী কর্মী পাঠাচ্ছে। সৌদি আরব থেকে লাশ হয়ে ফিরেছে ৩১১ জন নারী। তাতে দেখা গেছে, ৫৩ জন নারী আত্মহত্যা করেছে। আমাদের সংস্কৃতি, পারিবারিক জীবন এসব বিবেচনা করে নারীদের জন্য কাজের ব্যাপক সুযোগ আমাদের দেশেই সৃষ্টি করা উচিত। এভাবে আর নারী কর্মী বাইরে পাঠানো নয়, যেখানে শুধু লাভবান হয় রিক্রুটিং এজেন্সি।

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

 

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

7 − two =