ফিচার্ড লেখালেখি

অতীতের ডায়েরী থেকে – নেত্রকোনার বালিশ | সুশীল কুমার পোদ্দার

গ্রাফিকঃ সদেরা সুজন

অতীতের ডায়েরী থেকে – নেত্রকোনার বালিশ | সুশীল কুমার পোদ্দার

নব্বই দশকের শুরুর কথা। দেশে স্বৈর শাসকের পতন ঘটেছে। তত্বাবধায়ক সরকারের উপর মানুষের তখন প্রচণ্ড আস্থা। ছোট ছোট চুনি পুঁটিরা ধরা পড়ছে, রাঘব বোয়ালরা ধরা পড়ল বলে ভেবে আমরা পত্রিকার দিকে অধির হয়ে চেয়ে থাকি। আর থাকি আমার নিয়োগ পত্র পাবার প্রত্যাশায়। বিসিএস পরীক্ষার রেজাল্ট বেড় হয়েছে তাও অনেক দিন হল। একদিন তেমন কিছু না ভেবেই পরীক্ষা দিয়েছিলেম। applied physics and electronics এর ছাত্র হয়ে ম্যাজিস্ট্রেট হবো কখনো ভাবিনি। মানুষ ভাবে এক হয় আরেক। ভবিতব্য মানুষকে কোথায় নিয়ে যায়। যা হতে চাইনি একদিন সেই ম্যাজিস্ট্রেসি ছাড়া অন্য কোন পথ খোলা রইলো না। চার বছরের পড়ালেখা শেষ করতে প্রায় দ্বিগুণ সময় পার হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে আসতে কখন যে আমি চাকুরীর বয়স সীমার প্রান্তে চলে এসেছি বুঝতে পারিনি। একটা ভয় একটা আস্থাহীনতায় পেয়ে বসেছে আমায়। কেন যেন মনে হয় হয়তো আমার নিয়োগ পত্র আর কখন আসবে না। এ আস্থাহীনতার জন্ম হয়েছে সেই দিন যেদিন ভালো রেজাল্ট করা স্বত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা উন্মুক্ত হল না; যেদিন আমার সতীর্থরা একযোগে আণবিক শক্তি কমিশনে যোগ দিল শুধু আমি ছাড়া। মনে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স পরীক্ষায় মৌখিক পরীক্ষায় এসেছিলেন আণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান। উনি আমায় সর্বোচ্চ নম্বর দিয়েছিলেন। বাহিরে ডেকে নিয়ে আমায় বলেছিলেন তুমি যদি আণবিক শক্তি কমিশনে জয়েন করতে চাও তবে আমার সাথে যোগাযোগ কোর। আমিতো বুঝিনি উনার কথা ছিল কথার কথা, ক্ষণিকের মানবিকতার তাড়নায় উনি হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন আমার ধর্মীয় পরিচয়। যেদিন আমার এক বন্ধু আমায় বলল আমি সংখ্যালঘু হবার কারণে আমায় বাদ দিয়েছে সেদিন ভীষণ অভিমান হয়েছিল। আরও অভিমান হয়েছিল সেদিন, যেদিন বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষায় একজন উচ্চপদস্থ আমায় বললেন – তুমি হিন্দু, তুমি তো ইন্ডিয়া চলে যাবে? আমি সেদিন কোন উত্তর দেয়নি। আসলে এমন কঠিন সত্যের মুখোমুখি হতে হবে কোনদিন ভাবিনি যে!

তাই ভয়ে ভয়ে ডাক পিয়নের আসা যাওয়ার পথে উন্মুখ হয়ে চেয়ে থাকি। একদিন নিয়োগ পত্র এলো। যেতে হবে বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল নেত্রকোনা। মহাখালী বাস ষ্টেশনে এলেন আমার বড়দাদা, তিনি খুঁজে খুঁজে পেয়ে গেলেন ফারুক নামে এক আনন্দমোহন কলেজের ছাত্রকে, ওর বাড়ী নেত্রকোনা। গ্রামের বাড়ি খালীয়াজূড়ি। ও আসে আমার নেত্রকোনা জীবনের পরিক্ষিত বন্ধু হয়ে। দাদা তার ছোটভাইটিকে ওর হাতে সপে দিয়ে বিদায় নেন। আমি ধুলো ধূসরিত দীর্ঘ পথ আছাড়ি পাছাড়ি খেতে খেতে পৌঁছি নেত্রকোনার সার্কিট হাউজে। ফারুক সার্কিট হাউজের সবাইকে ডেকে ডুকে, এখানে সেখানে ফোন করে আমার চাকুরী জীবনের শুরুটা মসৃণ করে দেয়।

চাকুরীর শুরুতে নিজকে বেশ বড়সড় মানুষ বলে মনে হয় যখন সাধারণ মানুষ মাথা নিচু করে কারণে অকারণে সালাম দেয়, কথায় কথায় স্যার স্যার বলে। কিন্তু এ ভালো লাগা এ নিজকে বড় ভাবা বেশি দিন স্থায়ী হয় না- যখন মাস শেষে পকেটে যৎসামান্য পয়সা থাকে। ভেবে উঠতে পারিনা কিভাবে ১৬৫০ টাকার স্কেলের চাকুরী করে পরিবারের মুখে হাসি ফুটাব। নিজকে বড় অসহায় মনে হয়। আমার ঘরে জানালা গুলো থাকে পর্দা শূন্য।বড় ভাইয়ের দেওয়া জামা কাপড় পড়া এ নতুন মাজিস্ট্রেটকে দেখে অনেকেই মনে করে আমার মনে হয় বেতন না হলেও চলবে। বেতনের দিন এলে পিয়ন পরম উৎসাহে নেজারত থেকে আমার টাকা তুলে নিয়ে আসে। হাতে অনেকগুলো পাঁচ-টাকার একটাকার বান্ডিল, পেটের মাঝে ভোমর দিয়ে ফুটো করে দড়ী দিয়ে বাঁধা। সেই একগোছা টাকা আমার টেবিলে রেখে বিনীত ভাবে বলে স্যার একটা সাইন করে টাঁকাগুলো গুনে নেন। আমি লজ্জায় গুনতে পারিনা। আমি মাথা নেড়ে সাইন করে দেই। ও মাথা নিচু করে দাড়িয়ে থাকে। আমি বুঝতে পারি ও কেন দাড়িয়ে আছে। দেখতে দেখতে আমার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় প্রায়ই অফিসের পিয়ন, বাগানের মালী ওদের অভাবের কথা বলে আমার মনকে শিক্ত করে দেয়। যৎসামান্য যা পারি দিয়ে দেই। রাত্রে একাকী ঘরে পর্দা-হীন জানালা দিয়ে চেয়ে থাকি জোনাকি জ্বলা দিগন্তের দিকে। একটা গভীর দুর্ভাবনা পেয়ে বসে। মনে পড়ে হাতে কলমে শিক্ষা নেবার জন্য এস পি অফিসে গিয়েছিলেম। এস পি সাহেব কপট-হীন কণ্ঠে আমায় বলেছিলেন – দেখেন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব, আমি মানুষটা সৎ নই আর সৎ হতেও চাইনা। গরীব ঘরের বড় ছেলে, বাবার কাছে একটা ফুটবল চেয়েছিলেম। উনি দিতে পারেননি। আমি চাই না আমার পোলাপান একটা ফুটবলের জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করুক। কথাটা খুব কানে লেগেছিল।

একদিন অফিসের কাজে ঢাকায় এসেছি। ড্রাইভার আমায় নিয়ে গেল ওর এক পরিচিত রেস্টুরেন্টে – সেটাই আমার সরকারী টাকায় প্রথম মধ্যাহ্ন ভোজন। আমার টেবিলে দু পদের মাছ, খাসির মাংস। আমার খাবারের জন্য কতো বরাদ্দ তা আমার জানা নেই। বিলটা পরিশোধ করেই একটা অস্বস্তি আমার মনের মাঝে জেকে বসলো। ডি এ সাহেবের সাথে কথা না বলা পর্যন্ত আমার স্বস্তি নেই। উনি খুব রসিক মানুষ। উনার অফিসে গেলেই চা খাওয়ান। সারাক্ষণ মুখে তার পান। তিনি সিগারেট খান না কিন্তু অপরকে দেন। সিগারেটের ধূমায়িত ধূয়াসার মাঝে তিনি হাসি মুখে বসে থাকেন। তার চারপাশ অসংখ্য জাবর কাটা মানুষের সমাগম। উনাকে একান্তে কথাটা বলতেই তিনি হেসে কুটিকুটি। আরে চা খান। না হয় দু’পদের মাছই খেয়েছেন। খাবারই তো খেয়েছেন। অনেকে তো পুরো বিল শুদ্ধা মাছ খেয়ে ফেলে! আমি স্বস্তি ফিরে পেলাম। কথায় কথায় তিনি বললেন তিনি আগে কখনও পান খেতেন না। চাকুরীতে আসার পরই চা, পানে অভ্যস্ত হয়েছেন কারণ পান সিগারেট আর চায়ের একটা আলাদা ভাষা আছে। আমি সেদিন সেই চা পানের আলাদা ভাষা বুঝতে পারিনি। আমি একটা নিরেট বোকা ছিলেম। আস্তে আস্তে জীবনের অনেক সত্যের মুখোমুখি হবার সুযোগ আসে। সুযোগ আসে নিজকে চেনার, নিজকে জানার।

একদিন নেত্রকোনার ব্যাপক অঞ্চলের উপর দিয়ে বয়ে যায় কালবৈশাখী ঝড়। আমি তখন শিক্ষা বিভাগের দায়িত্বে। আমার উপর দায়িত্ব পড়েছে উপজেলা গুলোর বিধ্বস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা তৈরি করা। একদিন একজন শিক্ষক এলেন তদবির করতে। তার হাতে বিরাট এক মিষ্টির বাক্স। বিনীত ভাবে বললেন স্যার আপনি তো নেত্রকোনার বালিশ খুব পছন্দ করেন, তাই সামান্য কিছু আপনার জন্য এনেছি; আপনি খেলে আমার ভালো লাগবে। মিষ্টিকে মিষ্টি ভেবে আমি চেয়ে আছি মিষ্টির দিকে। হয়ত লোভ হয়েছিল ক্ষণকালের জন্য। কিন্তু কখন কিভাবে আমি তাকে কঠোর ভাবে ফিরিয়ে দিয়েছি জানি না। কথাটা পাঁচ কান হয়ে ডিসি সাহেবের কানে গেল। আমি প্রশংসিত হলাম। নিজকে প্রশ্ন করলাম কে আমায় বাঁধা দিল মিষ্টির প্যাকেটটা নিতে! একি আমার নিরীহ পিতামাতার দেওয়া সংস্কার? এই সংস্কারই কি আমায় নীরবে বাঁধা দিয়েছে? পরম্পরা থেকে পাওয়া হে সংস্কার, হে নৈতিকতা, তুমি সেদিন আমায় বাঁধা না দিলে হয়তো লোভে পড়ে একদিন দুএকটা বালিশ মুখে তুলে দিতেম। হয়তো মুখে দিতে দিতে এতদিন অভ্যস্ত হয়ে পড়তাম। তুমি আমায় গরীব রেখেছ কিন্তু রূপপুরের বালিশের মতো আমার মাথাকে করনি অবনত…

চলবে…

অতীতের ডায়েরী থেকে – নেত্রকোনার বালিশ | সুশীল কুমার পোদ্দার ,  ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী ।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,  ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

সংবাদটি শেয়ার করুন