ফিচার্ড সাহিত্য ও কবিতা

হানিমুন ।।। নাজনিন নিশা

হানিমুন ।।। নাজনিন নিশা

লেখালেখির বদভ্যাস ওনার সেই জন্মলগ্ন থেকেই, কিছু থেকে কিছু হলেই খাতাকলম নিয়ে ওনি লিখতে বসে যান। আর কিছু পারুক না পারুক লিখতে কোনো কার্পণ্য নেই তাঁর ভেতরে। কিন্তু এত লেখালেখি করে কি করতে পেরেছেন তিনি এ জীবনে। না একটা বাড়ি, না একটা গাড়ি না কোনো জায়গাজমি। কিছুই করতে পারেননি। মাঝখান থেকে খাতা আর কলমের পয়সা ভরতে হয়। সেই বিয়ের পর থেকে এত বছরে কতবার করে বললাম হানিমুনে যাবার কথা। কত স্বপ্ন ছিল বিয়ের পর বরকে নিয়ে হানিমুনে যাবার। আমার সব বান্ধবীরাই গেছে অথচ আমার বিয়ে হয়ে বাচ্চা জন্ম নিয়ে এতবড় হয়ে গেলো কিন্তু তিনি কখনোই রাজি হলেননা। অবশ্য কয়েকবছর আগে তিনি আমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন একবার কিন্তু সেটা তার মামার বাড়ি। আচ্ছা কারো মামার বাড়িতে গেলে কি সেটাকে হানিমুন বলা যায়?

আমি চেয়েছিলাম কলকাতা আর দার্জিলিং শহর ঘুরে দেখতে। অথচ এই সামান্য দুটি জায়গায় আমাকে নিয়ে যাবার মতন সময় কিংবা মন কোনোটাই তাঁর হয়নি কোনোদিন। কথায় আছেনা ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়! আসলে তাঁরতো ইচ্ছেই নেই!

এতক্ষন ধরে শাপলার সঙ্গে নবনীতা এসব আলাপচারিতাই করছিলো অফিসের কাজের অবসরে। অবশ্য এসবকে আলাপচারিতা বললে ভুল বলা হবে কারণ এ অভিযোগের পুরোটাই নবনীতা তার বর তমালের বিরুদ্ধে করে আসছিলো। নবনীতা এবং তমালের সংসারযাপন দীর্ঘ ১০ বছর। তাদের এই ছোট্ট সংসারে রয়েছে ৭ বছর বয়সী একমাত্র পুত্র সন্তান রোদ্দুর। যাকে ঘিরে তাদের অনেক স্বপ্ন, অনেক আশা আর ভরসা।
নবনীতা একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে সামান্য মাইনে নিয়ে খুবই সাধারণ একটি চাকরিতে লেগে আছে কয়েক বছর ধরে, মাইনের বড় অংশটা বাসা ভাড়ায় চলে যায়, বাকি অংশ থেকে অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে প্রতি মাসে অতি অল্প পরিমানের একটা অঙ্ক সরিয়ে রাখে হানিমুনে যাবে বলে এখন সেই অঙ্কটা মোটামুটি বড় মাপের একটা অঙ্কে দাঁড়িয়েছে যা ব্যয় করে ওরা দিব্যি ঘুরে আসতে পারে কলকাতা এবং দার্জিলিং। কিন্তু পয়সার যোগান হলেও তমালের ইচ্ছের যোগান হয়নি এখনো।

শাপলা নবনীতার অফিস কলিগ। অফিসের কাজের অবসরে সংসারের টুকিটাকি সুখদুঃখের আলাপ করেই তারা নিজেদের মনের কষ্ট লাঘব করে। নবনীতার বেশিরভাগ অভিযোগই থাকে বিয়ের পর থেকে সে বহুবার চেয়েছে কলকাতা আর দার্জিলিং ঘুরে আসতে। কিন্তু তমাল কোনোদিন নবনীতাকে নিয়ে যায়নি সেখানে। লেখালেখি করে তমালের যা রোজগার তাতে এতবেশি বিলাসিতা করা ওদেরকে ঠিক মানায়না, এটা তমালের ভাষ্য। নবনীতার মতে তমাল আসলে মোটেও রোমান্টিক পুরুষ নয়, বৌকে নিয়ে কোন রোমাঞ্চ তার মনে নেই, তাই নবনীতার এ সামান্য চাওয়াকে ও বিলাসিতা মনে করে। মাঝে মাঝে ইচ্ছের কাছে, রোমান্টিকতার কাছে বিলাসিতা হার মেনে যায় এটা তমালকে বোঝানো যায়না। সেটা না হলে বিয়ের আগে তমাল পুরো ইন্ডিয়া ঘুরে এসেছে বন্ধুদের সাথে নিয়ে তখনতো তার বিলাসিতা মনে হয়নি। লেখালেখি নিয়ে যাঁরা ব্যস্ত থাকে তাদের মনটা অনেক বিশাল হয়, তাঁরা প্রকৃতি প্রেমী হয়, অনেক রোমান্টিক হয় এসব ভেবেই নবনীতা তমালকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল সেদিন। এতসব বাক্য বিনিময় ঝগড়াঝাটি আর মানঅভিমানের পরেও নবনীতা হাল ছেড়ে দেয়নি। কলকাতা আর দার্জিলিং ঘুরতে যাবার স্বপ্নে আজও সে বিভোর!

সারাদিন একটানা অফিসের পর ক্লান্ত শরীর নিয়ে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেই নবনীতা আজ বিছানায় শুয়ে পড়ে। অন্যান্য দিনগুলোতে রোদ্দুরকে ডাকে কিন্তু আজ মনে হচ্ছে ডাকার সে শক্তি লোপ পেয়েছে। কতক্ষন এভাবে শুয়ে ছিল জানা নেই। হঠাৎ কানে আসতে থাকে তমাল নবনী নবনী করে একনাগাড়ে ডেকেই চলছে, নবনীতা চোখ খুলে ঠিক আন্দাজ করতে পারেনি কয়টা বাজে। বিছানা ছেড়ে নামতে গিয়ে মনে হলো যেন পা জড়িয়ে আসছে। অন্ধকারে ঘরের লাইট এর সুইচ হাতড়ে বের করে লাইট জ্বালিয়ে দেখলো দেয়াল ঘড়িতে আটটা বেজে চলছে। তৎক্ষণাৎ মনে হলো রোদ্দুর কোথায়, কি করছে? ঘর থেকে বেরিয়ে রোদ্দুরকে ডাকতে ডাকতে নবনীতা সোজা রোদ্দুরের রুমে চলে গেলো, লাইট জ্বালাতেই চোখে পড়লো রোদ্দুর তার বিছানায় শুয়ে আছে চোখ বন্ধ করে। নবনীতা রোদ্দুরকে আর ডেকে না তুলে বসার ঘরে এসে তমালকে জিজ্ঞেস করলো কেন ডেকেছেন? তারপর জানতে চাইলো রোদ্দুর কখন ঘুমিয়েছে? ভারী চশমাচোখে তমাল নবনীতার দিকে একবার তাকিয়ে আবার লিখতে লিখতেই জবাব দিলো রোদ্দুরকে স্কুল থেকে এনে ভাত দিয়েছি কিন্তু ও না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। নবনীতা এবার জিজ্ঞেস করলো আপনি খেয়েছেন? তমাল নবনীতাকে জানালো সে এখনো খায়নি। নবনীতা টেবিলে খাবার লাগিয়ে তমালকে খেতে আসতে বললো। কিন্তু রোদ্দুর কেন না খেয়ে এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লো সেটা নিয়ে নবনীতার ভীষণ চিন্তা হতে লাগলো। তমালইবা কেন ওকে না খেয়ে ঘুমাতে দিলো সেটাও চিন্তা করে নবনীতার ভীষণ রাগ হতে লাগলো তমালের উপর।

আজ রবিবার! নবনীতার অফিস ছুটি! সকাল থেকেই একটানা বৃষ্টি আর বৃষ্টি! জানালার কাঁচের উপরে আছড়ে পড়া বৃষ্টির শব্দে নবনীতার খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যায়। ছুটির দিনগুলোতে একটু বেশি ঘুমানোর ইচ্ছে থাকলেও সেটা কখনো সম্ভব হয়ে ওঠেনা। এর কারণ অফিসের দিনগুলোতে সামান্য চা তৈরির জন্য তমাল নবনীতাকে ঘুম থেকে না ডেকে তুললেও ছুটির এই দিনটিতে নবনীতার হাতে বানানো এককাপ চা তমালের চাই-ই চাই। তাছাড়া এ দিনটিতে ভালোমন্দ একটা রান্নার বিষয়ও থাকে। ঘুমের রেশ না কাটতেই নবনীতা রান্নাঘরে এসে দেখলো চুলায় আগুন ধরছেনা, বৃষ্টি হলে লোড শেডিং এর পাশাপাশি গ্যাসের চুলাটা না জ্বলবারও একটা সমস্যা দেখা দেয়! অগত্যা কেরোসিনের চুলা ধরিয়ে তমালের জন্য চা বসিয়ে দিলো অদাকুচি আর সাথে লবঙ্গ এলাচ দিয়ে।
চুলার পানিটা ফুটতে ফুটতে নবনীতার চোখ নিজের অজান্তেই জানালার কাঁচ ভেদ করে কখন যেন বাইরে চলে গেছে। দমকা বৃষ্টির তান্ডবে গাছগুলো এলোপাতাড়ি দুলছে। মাঝে মাঝে বিকট শব্দে বিদ্যুৎ চমকে মধ্যাকাশে আগুনের স্ফুলিঙ্গ ঘটছে। দূর আকাশের গায়ে লেপ্টে থাকা রাশি রাশি মেঘ দেখে মনে হচ্ছে বিশাল সব পাহাড়গুলো নদীর কিনার ঘেঁষে যেনো দাঁড়িয়ে আছে। অদ্ভুত সব প্রাকৃতিক দৃশ্য! সৃষ্টিকর্তা কি নিপুণ হাতে বানিয়েছেন যা দেখার ইচ্ছে কখনোই ফুরোয়না। নবনীতা ওর বন্ধুদের কাছে শুনেছে দার্জিলিং এ আছে এসব প্রকৃতির এক অপরূপ সমাহার যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয়না। সেখানে খুব কাছ থেকে প্রকৃতিকে দেখার আনন্দ উপভোগ করা যায় এবং তার মাঝে নিজেকেও যেন নতুন করে আবিষ্কার করে নেয়া যায়। বৃষ্টি দেখতে দেখতে নবনীতা কিছু সময়ের জন্য যেন ডুবে গেলো দার্জিলিং যাবার গভীর স্বপ্নে। হঠাৎ বাইরের দরজায় খুব জোরে জোরে কেউ আওয়াজ দিতে লাগলো নবনীতা সে শব্দে বলক উঠা পানির দিকে চোখ নামিয়ে কয়েক মিনিটের ভেতরে চা বানিয়ে চায়ের কাপ হাতেই দরজা খুলতে এসে দেখে তার ছেলে রোদ্দুর দরজা খুলে দাঁড়িয়ে তার দিদামনিকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে। আর দিদামনির পেছন পেছন একটি বড় ধরনের ব্যাগ হাতে তমালের ছোট ভাই হিমেল। নবনীতা হাত থেকে চায়ের কাপ পাশে রেখে তার শাশুড়িমাকে সালাম করে সোফার দিকে নিয়ে গেলো সাথে হিমেলকেও বসতে বললো। রোদ্দুর দৌড়ে এসে দিদামনির গলা জড়িয়ে ধরে তার স্কুল আর বাবা মায়ের গল্প জুড়ে দিলো দিদামনির সাথে। নবনীতা শোবার ঘরে এসে দেখে তমাল নাক ডেকে এখনো ঘুমোচ্ছে। সারাঘরে তমালের কাগজ কলম ছড়িয়েছিটিয়ে আছে যা একটু পর নবনিতাই সব ঘুছিয়ে রাখবে। তমালকে ডেকে ওর মা আর ভাই এসেছে সে খবরটা দিয়ে নবনীতা আবারো রান্নাঘরে চলে গেলো সকালের নাশতা আর দুপুরের খাবারের আয়োজন করতে। তমালের জন্য যে চা বানিয়েছিলো সেটা এতক্ষনে ঠান্ডা হয়ে বরফ জমেছে কিনা কে জানে তাই আবারো চা বসাতে হলো। ততক্ষনে শাশুড়ি মা রান্নাঘরে এসে দেখলেন বৌমা কি করছে। ওদিকে তমাল ঘুম থেকে উঠে বাইরে তাকিয়ে ঝড় তুফানের এ তান্ডব দেখে হিমেলকে বললো “তোরা এই প্রচন্ড বৃষ্টিতে কেমন করে এলি?” তমালের মা বললেন “আমরা গতকালকে যখন রওনা দিয়েছিলাম এ বৃষ্টি তখন ছিলোনা, এটাতো শুরু হয়েছে আজ খুব সকাল থেকে।”
বাসার পরিবেশটা আজ ভীষণ হৈচৈ এবং রান্না আর সবার সঙ্গে সবার গল্প করেই কেটে গেলো। গল্পের একফাঁকে শাশুড়িমা দুই ছেলে আর বৌ’মা কে নিয়ে বসলেন কিছু জরুরি কথা বলবেন বলে। আর সে জরুরি কথাগুলো ছিল তমাল আর হিমেলের মাঝে তার স্বামীর রেখে যাওয়া সামান্য জমিগুলো তিনি মারা যাবার আগেই ভাগবাটোয়ারা করে দিতে চান, তমাল যেন সময় নিয়ে দেশে যেয়ে তার অংশ বুঝে নিয়ে আসে। যদিও বিয়ের পরে শাশুড়িমা নবনীতাকে খুব জ্বালিয়েছেন, কিন্তু এ মুহূর্তে শাশুড়িমায়ের এমন প্রস্তাবে নবনীতা কিছুটা অবাক হয়ে গেলো! নবনীতা বিয়ের পর থেকেই দেখে এসেছে তমাল কিছু না করতে পারলেও প্রতিমাসে একটা খরচ তার মা’কে তিনি নিয়মিত পাঠান। আর এখন কিনা সেই শাশুড়িমা উল্টো তার জমিজমা লিখে দিতে চাইছেন? আসলে সময় মানুষকে না চাইতেই অনেক সময় বদলে দিয়ে যায়। হয়তো তার শাশুড়িমাও সেরকমই বদলে গেছেন আজ সময়ের সাথে সাথে।

পরের দিন অফিস আছে নবনীতার তাই রাত ১০ টা বাজতেই নবনীতা রোদ্দুরকে বিছানায় দিয়ে নিজেও চলে গেলো ঘুমাতে। যাবার সময় দেখলো তমাল, হিমেল আর শাশুড়িমা তাঁরা এখনো বসে গল্প করে যাচ্ছে।

মাঝরাতে নবনীতার ঘুম ভেঙে গেলো, এমনটি খুব একটা হয়না তবে আজ কেন যেন এমন হল। ঘুম ভেঙে মনে হলো কেউ যেন ডাকছে কিংবা খুক খুক করা কাশির শব্দ কানে আসতে লাগলো। পাশে তাকিয়ে দেখে তমাল ঘুমাচ্ছে কিন্তু নাক ডাকা শুরু হয়নি এখনো। নবনীতা খোলা দরজাটা আরেকটু খুলে অন্ধকারে পানি খাবার জন্য ফ্রিজ হাতড়াতে লাগলো! তখনি আবারো খুক খুক কাশির শব্দের সাথে মা মা ডাক নবনীতার কানে এলো। পানি খাওয়া রেখে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নবনীতা দৌড়ে পাশের রুমে চলে গেলো এবং লাইট জ্বালিয়ে দেখলো রোদ্দুর বিছানায় শুয়ে মা মা করে যাচ্ছে! কিছুটা কাশিও হচ্ছে রোদ্দুরের। নবনিতা দৌড়ে এসে ছেলের মাথায় হাত রাখতেই মনে হলো ছেলের গায়ের তাপে তার হাতটা যেন পুড়ে যাচ্ছে। ছেলেকে বুকের সাথে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে আবার বিছানায় শুইয়ে দিলো। কিছুই মাথায় খেলছেনা আসলে কি করা উচিত! এত রাতে কোথাও ডাক্তার থাকবে বলে মনে হলোনা। তমালকে ডেকে তুললো। ততক্ষণে শাশুড়িমাও শব্দ পেয়ে উঠে এলেন। গায়ের তাপমাত্রা কমানোর জন্য নবনীতা ছেলের মাথায় জ্বলপট্টি দিতে লাগলো। অনেক সময় ধরে জ্বলপট্টি দিতে দিতে একটা সময় জ্বর নেমে গেলো, ততক্ষণে চারিদিকে রাতের অন্ধকার সরে গিয়ে দিনের আলোরা যেন উঁকিঝুঁকি মারতে লাগলো। সারারাত না ঘুমিয়ে শরীর বড্ড ক্লান্ত, তাই ছেলের পাশেই নবনীতা ঘুমিয়ে পড়লো।

শাশুড়িমা টানা তিনদিন বেড়িয়ে বিদায় নিয়ে আবার চলে গেলেন তার নিজের গ্রামের বাড়িতে। নবনীতা ছেলের কারণে একদিন অফিস বন্ধ দিয়ে এখন আবার নিয়মিত অফিস করতে লাগলো। রোদ্দুরের জ্বর ভালো হয়ে গেছে তাই এখন সেও নিয়ম করে স্কুলে যাচ্ছে।
এক সপ্তাহ পার হবার পর রোদ্দুর আবার জ্বর নিয়ে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লো। এবং একটানা কয়েকদিন জ্বর। নবনীতা অফিস বন্ধ করে রেখেছে। ডাক্তারের দেয়া ঔষধ কিছু সময়ের জন্য কাজ করলেও জ্বর একেবারেই ছেড়ে যাচ্ছেনা। ঔষধে কিছুদিন ভালো থাকছে কিন্তু আবার জ্বর আসছে। নবনিতাও মাঝে মাঝেই রোদ্দুরের কারণে অফিসে যেতে পারছেনা। এভাবে কয়েক মাস ধরেই রোদ্দুরের জ্বর উঠানামা করছে। অনেক ডাক্তার দেখিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হলো। কিন্তু জ্বর একেবারেই সেরে গেলোনা। এ ডাক্তার সে ডাক্তার করে করে সর্বশেষ ডাক্তার জানালেন রোদ্দুর ক্যান্সারে আক্রান্ত এবং রোদ্দুরকে সিঙ্গাপুরে পাঠালে উন্নত চিকিৎসায় ভালো হবার সম্ভাবনা থাকতে পারে। নবনীতা কখনোই প্রস্তুত ছিলোনা আজকের এই ভয়ানক পরিস্থিতির জন্য। তার সব স্বপ্নগুলো কাঁচের টুকরোর মতো ভেঙে চুড়মার হয়ে গেলো। অথচ ওই লোকটির কোন চিন্তাই নেই, সে দিব্যি খাতাকলম নিয়ে এখনো লিখে যাচ্ছে। নবনীতার চারিদিক অন্ধকার মনে হলো। তার কাছে টাকার যে অঙ্কটা আছে সেটা দিয়ে সিঙ্গাপুর নেয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। তমালকে সাথে নিয়ে নবনীতা ডাক্তারের শরণাপন্ন হলো এবং অনুরোধ করলো এদেশেই খুব ভালো মানের চিকিৎসা তার ছেলেকে দেবার জন্য। কিন্তু ডাক্তার নবনীতাকে আবারো বুঝিয়ে বললেন এর ভালো চিকিৎসা এখানে নেই। ছেলেকে নিয়ে ভীষণ করুণ আর অস্থির এক নিদ্রাহীন পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে নবনীতা নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়লো। তমালকে রাজি করে শাশুড়িমায়ের কাছ থেকে পাওয়া জমিগুলো বিক্রি করেও দেখা গেলো রোদ্দুরকে সিঙ্গাপুর নিয়ে চিকিৎসা দেয়া যাচ্ছেনা। অবশেষে কোন এক ডাক্তার নিরাশায় আশার আলো জ্বালিয়ে বললেন সিঙ্গাপুর না হলেও কলকাতা পাঠাতেই হবে। কলকাতায় এ ক্যান্সারের ভালো চিকিৎসা আছে। নবনীতা ডাক্তারের এ প্রস্তাবে অথৈ সাগরে যেন কূলকিনারা খুঁজে পেয়ে নিজেকে আশ্বস্থ করলো। কিছু প্রয়োজনের কাছে কিছু স্বপ্ন পুরোই অবান্তর। নবনীতার হানিমুন যাওয়াটাও ঠিক তেমনই। তাই আর দেরি না করে হানিমুনে যাবার পুরো জমানো টাকা এবং জমি বিক্রির টাকাগুলো দিয়ে ছেলেকে কলকাতা নেবার ব্যবস্থা করে ফেললো।

খুব সকালে বাস ছেড়েছে কলকাতার উদ্দেশ্যে। বাসের ভেতরে ছেলেকে নিয়ে নবনীতা আর তমাল বসে আছে। রোদ্দুর খুব ঘামছে। নবনীতা কখনো একটি গামছা আবার কখনো তার শাড়ির আঁচল দিয়ে রোদ্দুরের কপালের ঘাম মুছে দিচ্ছে। তমাল একগ্লাস পানি হাতে বসে আছে। গলা শুকিয়ে পানি পানি করা মাত্রই ছেলের মুখে একটু একটু করে পানি তুলে দিচ্ছে। একটা সময় রোদ্দুর নবনীতার কোলে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়লো। বাস ছুটে চলছে গাছপালা, খালবিল, নদীনালা পেরিয়ে। কিন্তু নবনীতার আজ সেসব দেখার চোখ ভিন্ন। প্রকৃতি দেখার চোখ দিয়ে নবনীতা আর আগের মত করে প্রকৃতি দেখছেনা। আজ তার দেখার চোখ, চাওয়ার চোখ সবই ভিন্ন। কলকাতা কিংবা দার্জিলিং অথবা পৃথিবীর অন্য কোথাও যাবার চোখও ভিন্ন।

মানুষের জীবনের কোন কোন স্বপ্ন হয়তোবা পূরণ হয়, কিন্তু পূরণ হবার অনেক আগেই সে স্বপ্নের আবেদন, পাবার ব্যাকুলতা তার মাঝে ফুরিয়ে যায়। আবার কখনো কোন কোন স্বপ্ন পূরণ হলেও তার আবেদন এবং পাবার ব্যাকুলতা থাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। নবনীতারও হয়তো তাই। তবুও মানুষ স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। স্বপ্ন দেখে যায়। কারণ স্বপ্নের মাঝেই সে তার নিজেকে খুঁজে পায়।

নাজনীন নিশা: গল্পকার, উপস্থাপিকা এবং সংগীত শিল্পী।

 




সংবাদটি শেয়ার করুন