বিশ্ব

৫০ বছরে সবচেয়ে বড় দুর্যোগে কলকাতা?

৫০ বছরে সবচেয়ে বড় দুর্যোগে কলকাতা?  তছনছ এলাকার পর এলাকা, দক্ষিণ থেকে উত্তর ২৪ পরগনা লন্ডভন্ড । সর্বনাশ হয়ে গেল, দুটো জেলা ধ্বংস, বললেন মমতা, বাড়ছে মৃত্যুর খবরও

গত কয়েক দশকের মধ্য সবচেয়ে বড় দুর্যোগের মুখোমুখি হল কলকাতা। আয়লা, বুলবুল কিংবা ফণী— কোনও ঘূর্ণিঝড়ই এত শক্তিশালী অবস্থায় কলকাতায় প্রভাব ফেলেনি, যতটা তাণ্ডব চালাল আমপান।

উপকূলে আছড়ে পড়ার সময় ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৫৫ থেকে ১৬৫ কিলোমিটার। তখন কলকাতায় ঝড়ের গতিবেগ গড়ে ১১০-১২০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায়। ২০০৯ সালে আয়লা যখন সুন্দরবনের উপকূলে স্থলভাগে আছড়ে পড়েছিল, সেখানে তার গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১২৫-১৩০ কিলোমিটার। আর কলকাতায় কার্যত আয়লার লেজের ঝাপটা লেগেছিল। কলকাতায় ঝড়ের গতিবেগ সে বার ছিল ঘণ্টায় ৯০ কিলোমিটারের আশেপাশে। তবু কার্যত লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল শহর। আর আমপানে এ বার কলকাতা আর আশপাশের এলাকা মিলিয়ে সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৩৩ কিলোমিটার।

গত বছরের নভেম্বরে এসেছিল ঘূর্ণিঝড় বুলবুল। বুলবুল উপকূলে আছড়ে পড়ার সময় তার গতিবেগ ছিল ১৩০, তবে তার তাণ্ডব সুন্দরবন এলাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। কলকাতায় তার খুব একটা প্রভাব পড়েনি। আবার গত বছর আরও এক ঘূর্ণিঝড় ফণী আছড়ে পড়েছিল ওড়িশার উপকূলে। কলকাতায় তার প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তেমন কিছু ঘটেনি ।

আলিপুর আবহাওয়া দফতরের আধিকর্তা গণেশকুমার দাস বলেন, ‘‘অত্যন্ত শক্তিশালী এই ঘূর্ণিঝড় যদি শেষ মুহূর্তে গতিপথ পরিবর্তন না করে, তা হলে কলকাতায় ঝড়ের গতিবেগ থাকবে ১১০ থেকে ১২০ কিলোমিটার। পূর্ব কলকাতা এবং দক্ষিণ কলকাতায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে।’’

আরও একটি কারণে এই আমফান ভয়ঙ্কর হতে চলেছে। আলিপুরের আবহবিদদের মতে, প্রায় ১২ ঘণ্টা ধরে তাণ্ডব চালাবে এই ঘূর্ণিঝড়। কলকাতাতেও তার প্রভাব অন্য ঝড়ের চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হবে। ফলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। শহর কলকাতায় অনেক পুরনো বাড়ি রয়েছে। ঘূর্ণিঝড় এবং ভারী বৃষ্টির জেরে বহু বাড়িঘর ভেঙে পড়তে পারে। উপড়ে পড়তে পারে বহু গাছপালা।

আয়লার সময় এই রকম অনেক তাণ্ডবের সাক্ষী ছিল কলকাতা। —ফাইল চিত্র

অন্য দিকে, আমপানের প্রভাবে ইতিমধ্যেই কলকাতায় প্রচণ্ড বেগে ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে চলছে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। পরিস্থিতির মোকাবিলায় কোমর বেঁধে নেমেছে কলকাতা পুরসভা। পুরসভায় রয়েছেন প্রশাসক মণ্ডলীর চেয়ারম্যান ফিরহাদ হাকিম-সহ অন্যান্য সদস্যরা। প্রাক্তন মেয়র পারিষদ তারক সিংহকে গোটা বিষয়ের তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

তছনছ এলাকার পর এলাকা, দক্ষিণ থেকে উত্তর ২৪ পরগনা লন্ডভন্ড

ভয়াল গতিতে সুন্দরবনেই আছড়ে পড়ল আমপান (প্রকৃত উচ্চারণ উম পুন)। বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা নাগাদ ওই অতি মারাত্মক ঘূর্ণিঝড়টি আছড়ে পড়ে বলে জানিয়েছে দিল্লির মৌসম ভবন। সেই সময় ঘূর্ণিঝড়ের ঘূর্ণনের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ১৫৫-১৬৫ কিলোমিটার। সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১৮৫ কিলোমিটার ছিল। সন্ধ্যা ৭টা বেজে ২০ মিনিটে কলকাতায় সেই ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ১৩৩ কিলোমিটার। এর জেরে লন্ডভন্ড পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে কলকাতা-সহ দুই ২৪ পরগনা এবং পূর্ব মেদিনীপুরে। হাওড়া, হুগলি এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের অবস্থাও ভয়াবহ। হাজার হাজার কাঁচাবাড়ি এবং গাছপালা ভাঙার খবর আসছে এই সব জেলা থেকে। তবে বাস্তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এর অনেক গুণ বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। রাত পর্যন্ত কলকাতা সহ বিভিন্ন জেলা মিলিয়ে অন্তত ১২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে বলে জানা গিয়েছে নবান্ন থেকে। এর মধ্যে ৩ জন মারা গিয়েছেন কলকাতায়।

বুধবার দুপুর আড়াইটে নাগাদ ঘূর্ণিঝড়টির স্থলভূমিতে ঢুকে পড়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়।দিল্লির মৌসম ভবন জানিয়েছে, বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা নাগাদ দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুন্দরবন উপকূলে আছড়ে পড়ে আমপান। কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতরের ডিরেক্টর মৃত্যুঞ্জয় মহাপাত্র জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্র অর্থাৎ চোখ (আই) বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ অর্ধেকটা ঢুকে পড়ে স্থলভাগে। সাড়ে ছ’টার মধ্যে পুরো ‘চোখ’ই সুন্দরবন এলাকায় ঢুকে পড়েছে।

সর্বনাশ হয়ে গেল, দুটো জেলা ধ্বংস, বললেন মমতা, বাড়ছে মৃত্যুর খবরও

‘‘রাজ্যের সর্বনাশ হয়ে গেল’’, দুই ২৪ পরগনায় আমপানের তাণ্ডবলীলা নিয়ে বলতে বসে বার বার এই কথাটাই বেরিয়ে আসছিল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ থেকে। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা নাগাদ সুন্দরবনে আছড়ে পড়ার পর দক্ষিণে তাণ্ডব চালিয়ে যখন উত্তর ২৪ পরগনায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে প্রবল ঘূর্ণিঝড়, সেইসময় রাত ৯টা নাগাদ নবান্নে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন তিনি। শুরুতেই বলেন, ‘‘দুই ২৪ পরগনা ধ্বংস হয়ে গিয়েছে…বাড়িঘর, নদী বাঁধ ভেঙে গিয়েছে, ক্ষেত ভেসে গিয়েছে।’’ তখনও পর্য়ন্ত ১০ থেকে ১২ জনের মৃত্যুর খবর এসেছে নবান্নে, জানান মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলন শেষ করার পর আরও কয়েক জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে বিভিন্ন জেলা থেকে।

সারাদিনই নবান্নের কন্ট্রোল রুম থেকে ঝড়ের গতিপ্রকৃতিক খোঁজখবর রাখছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রী জানান, পাথরপ্রতিমা, নামখানা, বাসন্তী, কুলতলি, বারুইপুর, সোনারপুর, ভাঙড় থেকে যা খবর এসেছে তা ভয়াবহ। খারাপ খবর উত্তর ২৪ পরগনা থেকেও। তবে ক্ষয়ক্ষতি কতটা হয়েছে, সেই সংক্রান্ত সবিস্তার তথ্য পেতে ৩-৪ দিন লেগে যাবে বলে জানান তিনি।

একদিনের মধ্যেও ৫ লক্ষ মানুষকে সরাতে পেরেছিলেন, তই ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা ঠেকানো গিয়েছিল বলেও জানান মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘এলাকার পর এলাকা ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। প্রশাসন ও সাধারণ মানুষের সাহায্যে ৫ লক্ষ মানুষকে সরাতে পেরেছি। ১৭৩৭ এ এমন ভয়ঙ্কর ঝড় হয়েছিল। ওয়ার রুমে বসে আছি আমি। নবান্নে আমার অফিস কাঁপছে। একটা কঠিন পরিস্থিতির যুদ্ধকালীন মোকাবিলা করলাম। মাঝরাত অবধি হয়ত ঝঞ্ঝা চলবে।’’
-আনন্দবাজার
সংবাদটি শেয়ার করুন