শিতাংশু গুহ, ১৮ই জুলাই ২০২২, নিউইয়র্ক।। রাজশাহীর এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী সবার সামনে এক কলেজ অধ্যক্ষকে পিটিয়েছেন। রাজাবাড়ী ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম রেজা ঘটনা সত্য নয় বলে জানিয়েছেন। এমপি ফারুক বলেছেন, ‘আমার ইজ্জ্বত আওয়ামী লীগের ইজ্জ্বত, আমার ইজ্জ্বত শেখ হাসিনার ইজ্জ্বত’। নারায়ণগঞ্জের শিক্ষক শ্যামল ভক্তকে এমপি সেলিম ওসমান কান ধরে উঠবস করিয়েছিলেন। এমপি ওসমান তখন বলেছিলেন, শিক্ষক শ্যমল ভক্তকে জনরোষ থেকে বাঁচাতেই তিনি তা করেছেন। শ্যামল ভক্তকে পরবর্তীতে সেলিম ওসমানের নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে দেখা গেছে। শ্যামল ভক্ত বা সেলিম রেজা হয়তো টিকে থাকার তাগিদেই এসব করেছেন?
সেলিম ওসমান জাতীয় পার্টির এমপি ছিলেন। শ্যামল ভক্তের বিরুদ্ধে ‘ইসলাম অবমাননা’-র অভিযোগ ছিলো, যা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। শ্যামল ভক্ত বিচার পাননি। ওমর ফারুক আওয়ামী লীগের এমপি, সেলিম রেজার সাধ্য কি সত্য বলার? আগে লোকে মিথ্যা বলতো না পাপ হবে বলে, এখন মানুষ সত্য বলে না বিপদে পরবে বলে! সেলিম রেজা সাহসে ভর করে সত্য বললেও ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদতো’। তবে সেলিম রেজা এমপি’র কাছে গিয়ে প্রমান করেছেন তিনি অধ্যক্ষ বা শিক্ষক হবার যোগ্য নন? এমপি বড় না শিক্ষক বড়, প্রশ্নটি কঠিন, কবি গোলাম মোস্তফার ভাষায় এর উত্তর হচ্ছে: ‘পিতা গড়ে শরীর, শিক্ষক গড়েন মন। পিতা বড় না শিক্ষক বড় বলিবে কোন জন’!
‘দুনিয়ার নিয়ম বিস্তর পাল্টাইছে’- এটি কৌতুক অভিনেতা ভানু বন্দোপাধ্যায়ের ডায়লগ। তাই হয়তো, নিয়ম পাল্টে এখন ছাত্র পেটালে শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা হয়, শিক্ষক খুন হ’ন; কিন্তু শিক্ষক পেটালে বা গলায় জুতার মালা দিলে কারো কিচ্ছু হয়না। হয়তো এ কারণে শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে হত্যার পর রাশেদ খান মেনন বলেছেন, ‘ছাত্রটি জানতো তাঁর কিছু হবেনা, তাই এ খুন’। দেশে এখন শিক্ষক হেনস্তার উৎসব চলছে; আর শিক্ষক হিন্দু হলে তো কথাই নাই, ইসলাম বা নবী অবমাননার অভিযোগ আনলে ‘সাত খুন মাফ’। ফলে একের পর এক শিক্ষক নির্যাতিত হচ্ছেন, দেখার কেউ নেই! যাদের দেখার দায়িত্ব, তাঁরা নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছেন।
স্কুল শিক্ষক হৃদয় মণ্ডল; অরুন কান্তি বিশ্বাস; শ্যামল কান্তি ভক্ত; কলেজ শিক্ষিকা লতা সমাদ্দার; শিক্ষিকা আমোদিনী পাল; ভারপ্রাপ্ত স্বপন কুমার বিশ্বাস; বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সঞ্জয় সরকার ও উমেশ রায় শুধু হিন্দু হওয়ার কারণে সীমাহীন লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। সবার বিরুদ্ধে ইসলাম বা নবী অবমাননার অভিযোগ। সাভারের আশুলিয়ায় শিক্ষার্থীর স্টাম্পের পিটুনীতে শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার তো মরেই গেলেন? প্রধানমন্ত্রীর এলাকা গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় পঞ্চপল্লী হাইস্কুলের শিক্ষক মিল্টন তালুকদারকে ২৪শে জুন ২০২২ পিটিয়ে মারাত্মক আহত করা হয়েছে। ডেইলী ষ্টার ২৭জুন ২০২২ বলেছে, জমি দখলের শিকার রাবি ইমেরিটাস শিক্ষক পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক অরুন বসাক, দখলদার ওয়াক্ফ ষ্টেটের মোতয়ালী।
নড়াইলের মীর্জাপুর ডিগ্রী কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেছেন, ‘পুলিশ আমাকে কলেজ কক্ষ থেকে বের করে আনে। দুইপাশে তখন শত শত পুলিশ। এরমধ্যে স্থানীয়রা পুলিশের সামনেই আমায় জুতার মালা পরিয়ে দেয়। পুলিশ ভ্যানের নেয়ার সময় অনেকে পেছনে লাথি মারে’। তিনি বলছিলেন, মাইকে যখন আমায় জুতার মালা পড়ানোর ঘোষণা দেয়া হয়, আমার তখন মনে হচ্ছিলো, আমি আত্মহত্যা করি।’ আমোদিনী পাল বেঁচে গেছেন। হৃদয় মন্ডল বাঁচেননি। না, তাকে প্রাণে মারা হয়নি, অপমানে তিনি জর্জরিত হয়েছেন। অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে জুতার মালা পড়ানো ঘটনায় হৃদয় মন্ডল বলেছেন, ‘জুতার মালা পড়ানো হয়েছে সকল শিক্ষকের গলায়’। আমার ধারণা, জুতার মালা পড়ানো হয়েছে ‘সুশীল সমাজের’ গলায়।
অধ্যাপক রতন সিদ্দিকীর প্রসঙ্গ ভিন্ন, তিনি সাহসের সাথে প্রতিবাদ করেছেন, তাঁর লোকবল ছিলো, তাই তিনি পার পেয়েছেন। তাঁর জায়গায় একজন হিন্দু হলে আর একটি ‘নাসিরনগর’ বা ‘সাহাপাড়া’ হয়ে যেতো। রতন সিদ্দিকী নিজেই বলেছেন, তাঁকে মালাউন, নাস্তিক বলা হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘দেশে উন্নয়ন হচ্ছে, একই সাথে মৌলবাদ ও ধর্মান্ধতার কাছে সবকিছুর পতন হচ্ছে’। এটাই আজকের বাংলাদেশ। উন্নয়ন হয়েছে, নৈতিক অবঃক্ষয় চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেছে, আর এসব ঘটনা সবই হচ্ছে ধর্মের নামে? দেশের সার্বিক পরিস্থিতি, শাসনব্যবস্থা, সমাজ, প্রশাসন হিন্দুদের কাছে যেন, ‘ডাঙ্গায় বাঘ জলে কুমীর’-র মত অবস্থা। একের পর হিন্দু শিক্ষকের ওপর আক্রমন, হত্যা, অবমাননা’র পর রতন সিদ্দিকী এবং অধ্যক্ষ সেলিম রেজার ঘটনা কিছুটা হলেও ‘মুখরক্ষা’’? ‘চমৎকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’র’ বাংলাদেশে এখন বলা যাবে, হিন্দু শিক্ষকদের অবমাননার ঘটনা সাম্প্রদায়িক নয়, কারণ মুসলমান শিক্ষকরাও আক্রান্ত হচ্ছেন। হিন্দুর ওপর যত আক্রমণই হোক, মূর্তি ভাঙ্গুক, বাড়ীঘর পুড়ুক, নারী ধর্ষিতা হোক না বাংলাদেশ ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’র রোল-মডেলই থাকবে।
আমরা জানতাম, ‘শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড’। বাংলাদেশে ধর্ম অবমাননার অজুহাতে একের পর এক শিক্ষকের মানহানিতে মনে হচ্ছে, ‘ধর্ম জাতির মেরুদন্ড’। সময়ের সাথে সাথে সবকিছু পাল্টে যাচ্ছে, তাই হয়তো পদ্মাসেতুর নাটবল্টু খুলে নেয়া ‘হিরো সাঁজতে যাওয়া’ ব্যক্তি চব্বিশ ঘন্টায় ধরা পড়লেও শিক্ষক হত্যাকারী যুবককে গ্রেফতারে তিন-চার দিন সময় লাগে, তাও জনমত গঠনের পর? স্মর্তব্য যে, পদ্মাসেতু যতটা গর্বের, শিক্ষকের গলায় জুতার মালা ততটা লজ্জার। আমাদের একেবারে ছোটবেলায় জামান স্যার বলতেন, ‘মানুষ হতে ‘মান ও হুঁশ’ থাকতে হয়, একের পর এক শিক্ষক অবমাননার ঘটনায় মনে হয়না, দেশের মানুষের কোনটা-ই আছে! বাদশাহ আলমগীর ও শিক্ষক মৌলভী কথোপকথন যারা জানেন তাঁরা শিক্ষকের মর্যাদা বুঝতে পারবেন।
শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে একটি জাতিকে ধ্বংস করে দেয়া যায়। বাংলা ট্রিবিউন ২১জুন ২০২২ বলেছে, ‘বাংলাদেশে শিক্ষার মান এশিয়ার মধ্যে সর্বনিন্ম’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক কাবেরী গায়েন বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতিগুলো কোন প্রতিবাদ করেন না, করলেও ফ্যাশেনবেল প্রতিবাদ হয়, যা কার্যকর হয়না। সকল শিক্ষক সমিতিগুলো চুপ বা তেমন নাড়াচাড়া নেই? শিক্ষকরা হয় প্রতিবাদ করতে শিখুন, নয়তো পরবর্তীতে ‘জুতার মালা’ পরার জন্যে তৈরী থাকুন। শিক্ষকদের ওপর হামলা মানে শিক্ষার ওপর হামলা বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে শিক্ষকদের ওপর সাম্প্রতিক ধারাবাহিক হামলার ঘটনায় ইউনিসেফ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। [email protected];