প্রসঙ্গ লাকিংমে চাকমা -১
অপহরণ ও পুলিশের অবহেলার শিকার- খুনরাজীব নূর
রাজীব নূর ।। অপহরণের পর অন্তত ছয় দিন লাকিংমে চাকমাকে আশপাশের গ্রামে লুকিয়ে রেখেছিল অপহরণকারীরা। অভিযুক্তদের একজন আতাউল্লাহ, যিনি পরে মিথ্যা জন্মসনদ দিয়ে মেয়েটিকে ধর্মান্তর ও বাল্যবিয়েতে বাধ্য করেছিলেন, তার বক্তব্য থেকেও এটা নিশ্চিত হওয়া যায়। লাকিংমের বাবা লালাঅং চাকমার দাবি, পুলিশ অবহেলা না করলে ওই ক’দিনের মধ্যে তার মেয়েকে উদ্ধার করা যেত। তাহলে মেয়েটিকে এমন অসময়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া লাগত না। লাকিংমে অপহৃত হয়েছে গত বছরের ৫ জানুয়ারি। অপহরণের পর অপহৃত কে উদ্ধারের ব্যাপারে পুলিশের নিষ্ফ্ক্রিয়তায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে লাকিংমে চাকমার ওপর ঘটে যাওয়া এসব ঘটনার তথ্যানুসন্ধানকারী শিক্ষক, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও আদিবাসী নেতাদের একটি প্রতিনিধি দল। প্রতিনিধি দলটি গত ২৮ ডিসেম্বর সকালে প্রথমে লাকিংমে চাকমার বাড়ি কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার শিলখালি গ্রামে যায়। এরপর গাড়িতে মাত্র ১৫ মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত আতাউল্লাহর বাড়ি মাথাভাঙ্গা গ্রামে গিয়ে তার পরিবার-পরিজনের সঙ্গে কথা বলে। আতাউল্লাহ তখন বাড়িতে ছিলেন না। তার মা রহিমা খাতুন ও বড় ভাই মনির উদ্দিন জানান, আতাউল্লাহ উখিয়ায় আছেন। তারা মিথ্যা তথ্য দিয়েছিলেন সেদিন। তিন দিন পর ৩১ ডিসেম্বর আতাউল্লাহকে খুঁজে পাওয়া যায় টেকনাফ বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন রমজান আলী মার্কেটের ‘রহমানিয়া থাই ফ্যাশন’ নামে একটি দোকানে। এই দোকানেই কয়েক মাস ধরে চাকরি করছেন তিনি।
আতাউল্লাহর দাবি, তিনি লাকিংমেকে অপহরণ করেননি। ঈশা ধর্মান্তরে আগ্রহী একটি চাকমা মেয়েকে বিয়ে করতে চায় কিনা জানতে চেয়ে গত বছর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের কোনো একদিন ফোন করে তাকে। পরে ভিডিওকলে লাকিংমেকে দেখে পছন্দ হলে গত ১১ জানুয়ারি টেকনাফে আসেন তিনি এবং সেদিনই মেয়েটিকে নিয়ে কুমিল্লায় চলে যান। সেখানে ২১ জানুয়ারি মেয়েটিকে ধর্মান্তরিত করার পর বিয়ে করেন। আতাউল্লাহর দাবি, ‘লাকি চেয়েছে বলেই আমি তাকে বিয়ে করেছি।’ কথা বলার সময় লাকিংমেকে ‘লাকি’ বলছিলেন তিনি।
লাকিংমে নিজেই এসব সওয়াল-জবাবের বাইরে চলে গেছেন। হত্যা কিংবা আত্মহত্যা যা-ই হোক, অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে বিতর্কের কারণে ২৩ দিন ধরে তার লাশ পড়ে আছে কক্সবাজার সদর হাসপাতাল মর্গে। আতাউল্লাহ ও তার পরিবারের লোকজনের দাবি, বিউটি পার্লারে যেতে না দেওয়ায় তর্কাতর্কির একপর্যায়ে স্বামী একটি থাপ্পড় মারার কারণে গত বছরের ৯ ডিসেম্বর লাকিংমে বিষপানে আত্মহত্যা করেছে। লাকিংমের পরিবার বলছে, তাদের মেয়েকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে। তার মা কেচিং চাকমার বক্তব্যে হত্যা করা না হলেও তার মেয়েকে অবশ্যই আত্মহত্যার প্ররোচনা দেওয়া হয়েছে- এমন অভিযোগ স্পষ্ট।
গত ২৮ ডিসেম্বর সকালে তথ্যানুসন্ধান দলটি লাকিংমেদের বাড়িতে ঢুকতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন কেচিং চাকমা। তিনি আহাজারি করে মেয়ে হত্যার বিচার চেয়েছেন। লাকিংমের বাবা লালাঅং ও মা কেচিং বাংলা বলতে পারেন না; বুঝতেও পারেন না খুব একটা। তাই তাদের সঙ্গে আলাপ করতে হয়েছে স্থানীয়দের সহযোগিতায়, যারা বাংলা ও চাকমা ভাষা জানেন। পাড়া-প্রতিবেশীরা বলেন, গত বছরের ৫ জানুয়ারি সন্ধ্যাবেলায় মেয়েকে অপহরণকারীরা তুলে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে কান্না কেচিং চাকমার নিত্যসঙ্গী হয়েছে। মেয়ে মারা যাওয়ার পর কান্না আরও বেড়েছে। কাঁদতে কাঁদতে সারাক্ষণই বলেন, তার মেয়েকে ওরা (আতাউল্লাহ ও তার পরিবার) মেরেছে অথবা মরার ব্যবস্থা করে (প্ররোচনা) দিয়েছে। লাকিংমেকে যখন তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন কেচিং তার বড় মেয়েসহ ছিলেন পানের বরজের কাজে। তার স্বামী লালাঅং গিয়েছিলেন সাগরে মাছ ধরতে। ছোট ছেলেমেয়েরা খেলছিল উঠানে। কেচিং চাকমার ১১ বছরের ছেলে উ মংহদ্মা চাকমা বলেছে, পাশের বাড়ির ইয়াসিনসহ পাঁচজন এসে ওর বোনকে জাপটে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। গ্রামের প্রান্তে দুটো বাড়িই শুধু চোখে পড়ে। একসময় রাখাইন ও চাকমাপ্রধান শিলখালিতে এখন বাঙালিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। বাঙালি প্রতিবেশী তার চাকমা প্রতিবেশী মেয়েটিকে অপহরণ করেছে। কাজেই চিৎকার করলেও শোনার কেউ ছিল না। উ মংহদ্মা যে পথ দিয়ে ওর বোনকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে দেখিয়েছে, সেদিকটা বেশ নির্জন। প্রত্যক্ষদর্শী অন্য পাঁচজন পরে ইসা ও আব্বুইয়ার নামও জানান পুলিশকে। আতাউল্লাহ ও তার মা রহিমা খাতুনের বক্তব্যে দিলু নামের একজনের নাম এসেছে। পাঁচজনের অন্য একজন কে- আতাউল্লাহ হওয়াটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক বলে মনে করছে তথ্যানুসন্ধানী দলটি।
আতাউল্লাহ দাবি করছেন, তিনি তখন কুমিল্লায় ছিলেন। ১১ ডিসেম্বর কুমিল্লা থেকে এসেছিলেন ধর্মান্তরিত হতে ইচ্ছুক একটি মেয়ের ইচ্ছে পূরণ করতে। আতাউল্লাহ বলেন, ‘ওকে অপহরণ করা হয়নি। লাকি কখনোই এমন কিছু বলেনি আমাকে।’ তার দাবি, লাকিংমেকে অপহরণ করা হয়ে থাকলেও সে দায় তার নয়, এটা করেছে ইসাসহ অন্যরা। গত ৫ জানুয়ারি তিনি কুমিল্লায় ছিলেন। আতাউল্লাহর এ বক্তব্য ইসা ও অপহরণের অভিযোগে অভিযুক্ত আরও দু’জন ইয়াসিন ও আব্বুইয়ার কাছ থেকে যাচাই করা যায়নি। লাকিংমের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর থেকে তারা তিনজনই পলাতক।
গত বছরের ৫ জানুয়ারি লাকিংমে যেদিন অপহৃত হয়, জন্মনিবন্ধন ও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) সনদ অনুযায়ী ওর বয়স হয়েছিল ১৪ বছর ১০ মাস। ‘আতাউল্লাহর দাবি, অনুযায়ী যদি লাকিংমে স্বেচ্ছায় বাড়ি ছেড়ে চলে আসে, তাহলেও এটি অপহরণ, জোরপূর্বক ধর্মান্তর, বাল্যবিয়ে ও ধর্ষণ বলে গণ্য হবে’- প্রতিনিধি দলের এমন বক্তব্যে সায় দেন কক্সবাজারের পুলিশ সুপার (এসপি) হাসানুজ্জামান। গত ২৮ ডিসেম্বর বিকেলে এসপি অফিসে তার সঙ্গে আলাপ হয়। অপহরণ মামলা গ্রহণে পুলিশের অনাগ্রহের কথা জেনে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। লাকিংমে অপহরণের সময় কক্সবাজার জেলার দায়িত্বে ছিলেন না তিনি।
লাকিংমের বাবা লালাঅং জানান, মেয়েকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে জেনে তিনি বাড়ি ফিরে আসেন। ওই দিনই ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. হাফেজকে বিষয়টি জানানো হয়েছিল। পরে তিনি টেকনাফ থানায় মামলা করতে গেলে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মামলা নিতে রাজি হননি। তখন ওই থানায় ওসির দায়িত্বে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সিনহা হত্যার দায়ে বরখাস্ত এবং বর্তমানে কারা-অন্তরীণ প্রদীপ কুমার দাশ।
লালাঅং বলেন, ‘আমার মেয়েকে যখন যেখানে আটকে রাখা হয়েছে বলে শুনেছি, সেখানেই ছুটে গিয়েছি আমি। অপহরণকারীরাও টের পেয়ে মেয়েকে সরিয়ে নিয়ে গেছে। মেয়েকে উদ্ধার করে দেওয়ার জন্য পুলিশের সহায়তা চেয়ে পাইনি।’
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন