পূর্ব প্রকাশের পর
অমিত পর্ব – ১২ |||| সুশীল কুমার পোদ্দার
কতো রহস্যময় আমাদের এ মস্তিষ্ক, যার অভ্যন্তরে ছড়িয়ে রয়েছে ১০০ বিলিয়নের অধিক নিউরন বা মস্তিষ্ক কোষ। প্রতিটা নিউরনের শরীর থেকে বেড়িয়ে গেছে সহস্র শাখা প্রশাখার মতো তন্তুরাশি (ডেন্ড্রাইট/অক্সন)। এই তন্তুরাশির কেউ নিকট কোন নিউরন থেকে নিয়ে আসছে তথ্য আবার কেউ তথ্য বয়ে নিয়ে যাচ্ছে অন্য কোন নিউরনকে দেবার জন্য। এমনি করে প্রতিটি নিউরন বিভিন্ন পথ দিয়ে সংযুক্ত হয়ে এক বিশাল জটিল মহাসড়কের জাল সৃষ্টি করেছে। আর সেই মহাসড়ক দিয়ে বয়ে চলেছে জটিল রাসায়নিক যা মানুষকে হাসায়, কাঁদায়, বিপদের আশংকায় সতর্ক করে দেয় আবার কারোকে খুন করার প্ররোচনা দেয়।
জুয়ার আসরে একবার জিতলে, দ্বিতীয় বার মানুষ বাজি ধরে। মনের মাঝে কে যেন বলে আবারো খেলতে, আবারো খেলতে। এমনি করে লাভের প্রত্যাশায় খেলতে খেলতে মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। একবার মাছ চুরি করে সফলকামী হলে , দ্বিতীয় বার নদী চুরি করতে ইচ্ছে জাগে। ধূমপান ছাড়ার প্রতিজ্ঞা করে বার বার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করা, ক্ষণে ক্ষণে ফেসবুকে নতুন পোস্ট দেবার ইচ্ছে, কয়টা লাইক পড়লো তা মিনিটে মিনিটে দেখার দুর্নিবার ইচ্ছে, ভিডিও গেমে পিস্তল উঁচিয়ে জম্মি মারার অহেতুক নেশাসহ এমনি অনেক আপাত সুখদায়ক নেশার পিছেনে রয়েছে এই মহাসড়কে বহমান অন্যতম নিউরো ট্রান্সমিটার- ডোপামিন। serotonin, norepinephrine, acetylcholine সহ আরও অজস্র নিউরোকেমিক্যাল আমাদের চিন্তা-চেতনাসহ শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট ভূমিকা রাখলেও ডোপামিনের রয়েছে এক বিশাল যাদুকরী প্রভাব যা আমাদেরকে প্রলুব্ধ করে এমন কাজ করতে যা আনন্দ বা কোন প্রাপ্তি বা পুরস্কারের আশা জাগায় মনে। বিজ্ঞানীরা নেশা, মদ্যপান, বিকৃত কামনা বাসনা ও অত্যধিক ঝুঁকি নেবার প্রবণতা সৃষ্টির জন্য এই ডোপামিনকে দায়ী করেছেন।
আজ হাসপাতালের বিছানায় নির্বাক শুয়ে থাকা গেরুয়া ও আলখাল্লাকে দেখে অমিতের অনেক কিছু মনে হয়, যা ও শিখেছে পড়াশুনা করে, ওদের সাথে কাজ করে। নিউরো সাইকোলজিস্টরা ওদের অতীত জীবনের ইতিহাস ঘেঁটে চেষ্টা করছে ওদের এমন অতিরিক্ত অর্থলিপ্সার কারণ বেড় করতে। কখনো কখনো অতীত জীবনের কষ্টসহিষ্ণু শৈশবের দরুন মানুষ বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ে, আবার কেউ কেউ প্রতিবন্ধী কিম্বা দুর্বল ব্যক্তিত্বের অধিকারী হবার জন্যও অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ে। তবে কি ওদের জীবনের অজানা অতীতের মাঝে এ অপরাধের বীজ লুকায়িত আছে? অমিত জেনেছে মস্তিষ্কের টেম্পোরাল লোবে অসংলগ্নতার কারণে অনেকে সমাজ বিরোধী কার্যকলাপে যুক্ত হয়ে পড়ে। ডোপামিন লোভ দেখায়, উত্তেজিত করে সমাজ বিরোধী কাজ করতে, সেরোটোনিন সেই উত্তেজনাকে প্রশমিত করতে চেষ্টা করে। ওদের সামঞ্জস্যহীনতা ও ডোপামিনের আধিক্য মানুষকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে প্রলুব্ধ করে। পারিবারিক ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধ, আর্থ সামাজিক অব্যবস্থা, রাষ্ট্র যন্ত্রের দুর্বলকাঠামো ও অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এই ঝুঁকি নিতে মানুষকে আরও বেশী প্রলুব্ধ করে।
হয়তো ওরা সামাজিক ভাবে একসময় ভালমানুষ ছিল, হয়তো ওদের জীবনাচারণেও ছিল মূল্যবোধ। পেশাগত জীবনে হয়তো ওরা এমন এক পরিবেশের মধ্যে বিকশিত হয়েছে যেখানে প্রতিনিয়ত অন্যায়, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ছিল নিত্যসঙ্গী। ওরা হয়তো দেখেছে অন্যায় করলে তার শাস্তির শিথিলতা, হয়তো ওরা পেয়েছে কোন গড ফাদারের আনুকূল্য । এমনি করে আস্তে আস্তে ওদের মস্তিষ্ক নতুন ভাবে বিন্যস্ত হয়েছে , ব্যক্তিত্বে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন, ব্যাপক বিকৃতি, পরিণত হয়েছে সর্বনাশা সাইকোপ্যাথে।
অমিত ভাবনার ঘোর ভেঙ্গে গেরুয়া ও আলখাল্লার পাশে বসে। পরম সহমর্মিতা নিয়ে ওদের হাতদুটো নিজের হাতের মধ্যে টেনে নেয়। ওরা ছল ছল চোখে চেয়ে থাকে অমিতের দিকে। সে চোখে এক গভীর আর্তি, এক গভীর আত্ম অনুশোচনা …
—– পাদটীকা
সাইকোপ্যাথি এক ভয়াবহ মানসিক বিকৃতি । এদের আবেগের মধ্যে লুকিয়ে থাকতে পারে সর্বনাশের বিষ। এদের নিজেদের সম্পর্কে অত্যন্ত ফোলানো ফাঁপানো উচ্চ ধারণা পোষণ করে। লজ্জাবোধ, অনুশোচনার বালাই নেই এদের মধ্যে। বন্ধু বা শুভাকাঙ্ক্ষীর অভিনয় করে বিশ্বাস অর্জন করে নিজের স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে চরম ক্ষতি করে দিতে পারে অন্যের। ভালোবাসা কিংবা সমবেদনার নিখুঁত অভিনয় করতে পারে এরা। নিজের স্বার্থে অন্যকে ব্যবহার করে প্রতারণায় এরা সিদ্ধহস্ত।
চলবে…
অমিত পর্ব – ১২ |||| সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী । ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স, মাস্টার্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।
সিএ/এসএস
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন