ফিচার্ড লেখালেখি

ডিম – বয়েল ডিম | | নৈশব্দের পংক্তিমালা ।। ধারাবাহিক ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

ডিম – বয়েল ডিম | | নৈশব্দের পংক্তিমালা ।। ধারাবাহিক ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

কি বিবর্ণ প্রকৃতি আজ ! আকাশটা এক সর্বগ্রাসী বিষণ্ণতায় ডুবে আছে। শ্বেত শুভ্র বরফে ঢেকে আছে চরাচর। সব কিছু যেন ঘুমিয়ে আছে; শুধু এই কনকনে শীতের তীব্রতাকে উপেক্ষা করে মাথা তুলে দাড়িয়ে আছে অকুতোভয়ী পাইন। আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি, মনে মনে বলি হে সর্বংসহা বৃক্ষ, কোথা থেকে পেলি দাড়িয়ে থাকার এমন অটুট মনোবল?

শীতের এ বিষণ্ণ সন্ধ্যায় বাড়ী ফিরতে যেয়ে আজ মনের গহীন কোন উৎস হতে হঠাৎ করে সামনে এসে দাঁড়ায় চাদর জড়ানো এক বয়সী চেনা মুখ। ও যেন কি বলতে চায়। দারিদ্র-কৃষ্ট হাসিমুখে ও আমায় যেন বলে – খোকা, কয়েকটা পয়সা বাকী ছিল ! আমি চেয়ে থাকি ওর দিকে। ফিরে যাই আপন ঘরে, আপন ঠিকানায়। প্রায় তিন-যুগ অতীতের হারিয়ে ফেলা সময়ের মাঝে আমি দেখতে পাই ওর মুখাবয়ব।

ঘন অন্ধকারে ঢাকা সন্ধ্যার আকাশ। আকাশ থেকে নেমে আসছে ধুসর বর্ণের থোকা থোকা কুয়াসা। কোন এক গলির প্রান্ত হতে ভেসে আসে এক মন কাড়া ডাক ‘ডিম বয়েল, বয়েল ডিম’ । ঘন কুয়াসার চাদরের মাঝে ঝাঁকা হাতে আমি ওর অপস্রিয়মাণ শরীরকে চলে যেতে দেখি। আমার কৈশোরের সেই খাই-খাই, চাই-চাই ভরা সময়ে সেই চাদর পড়া, নাম না জানা পৌঢ় ডিমওয়ালা আমায় স্বপ্নের জগতে নিয়ে যেত। সে স্বপ্ন মধ্যবিত্তের বৃত্ত ভেঙ্গে উপরে ওঠার স্বপ্ন, ছোট্ট ছোট্ট অপ্রাপ্তিকে হাতের মুঠতে পাবার স্বপ্ন।

টিউশন থেকে ফেরার পথে আমি ঐ প্রিয় ছন্দময় ডাক টার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতেম। ও প্রায়ান্ধকার লাইট পোস্টের নিচে দাঁড়াত। ঝুড়ির মাঝে কাপড়ের ভাজে ভাজে উষ্ণ ডিম গুলকে ও গভীর যত্নে অনাবৃত করতো। কয়লার দাগ দেখে ও বুঝতে পারত কোনটা হাফ বয়েল, কোনটা ফুল। আমি গভীর মনোযোগে, শঙ্কিত চিত্তে চেয়ে চেয়ে দেখতাম খোসার আড়াল থেকে আস্তে আস্তে বেড় হোয়ে আসা সুডৌল শুভ্র অপার্থিব ডিমকে। মনে মনে প্রার্থনা করতেম, হে ডিম, তুমি আস্ত বেড় হোয়ে আস খোসার বন্ধন থেকে। ও ঝুড়ির সাথে ঝুলিয়ে রাখা সরু সুতা দিয়ে ডিম টাকে দুভাগ করে একটু ঝালের গুড়ো ছিটিয়ে দিয়ে একটা ছিন্ন খবরের কাগজে মুড়ে দিত আমার হাতে। আমি হাতে পেয়ে মনকে বলতেম – পেয়েছি । আমি অন্তহীন সুখের সাগরে ভেসে যেতাম। পাছে খুব তাড়াতাড়ি সে সুখ ফুরিয়ে না যায় তাই কক্ষনো আস্ত ডিম মুখে তুলিনি। আস্ত ডিম মুখে দিয়ে স্বাদ আস্বাদন করতে মন খুব চাইতো। মনকে সান্ত্বনা দিতেম- বড় হয়ে অনেক বড় একটা চাকুরী করব, একসঙ্গে অনেকগুলো ডিম কিনবো। কোনটা হবে হাফ, কোনটা কোয়াটার বয়েল। উষ্ণতার তারতম্যে ডিমের মাঝে লুকিয়ে থাকা নানা বর্ণের স্বাদকে উপভোগ করব নানা ভাবে।

মাঝে মাঝে ওর ঝাঁকায় পড়ে থাকতো খুবই ছোট আকারের ডিম। ওকে জিজ্ঞেস করলে সহজ সরল উত্তর দিত- শীত তো, তাই মুরগীর বড় ডিম দিতে কষ্ট হয়। আমিও সরলভাবে ওর কথা বিশ্বাস করে বেছে নিতেম হাসের বড় আকৃতির ডিম। খেতে তেমন সুস্বাদু না হলেও এর পরতে পরতে লুকিয়ে থাকতো প্রকৃতির অপার রহস্য। আমি সযত্নে অনাবৃত করতেম এক একটা পরত। ধীরে ধীরে পৌঁছে যেতাম সে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে – হলুদাভ সূর্য গোলক, যেখানে একবার পৌঁছলে আর ফিরে আসা যায়না। ডিম ছোট হলে খুব কষ্ট হতো, আরও কষ্ট হতো যখন শঙ্খ ধবল ডিম খোসার মায়ায় আটকে পড়তো। এবড়ো থেবড়ো ডিম হাতে নিয়ে খুব কষ্ট পেতাম, ভীষণ মন খারাপ করা কষ্ট। কৈশোরের সেই দিনগুলোতে পকেটে তেমন পয়সা থাকতো না। সাড়া মাস টিউশণী করে মাসে আসতো একশো টাকা। তাই প্রায়ই পাঁচ পয়সা, দশ পয়সা বাকী থেকে যেত। বৃদ্ধ অকাতরে বাকী দিয়ে যেত। মাসান্তে পরিশোধ করে দিতেম। কিন্তু একদিন পরিশোধ করার আর সুযোগ এলো না। আমাকে অনেকগুলো পয়সা ঋণী করে হারিয়ে গেল সেই ডিমওয়ালা – যেমন করে অনেকেই হারিয়ে যায় আর কোনদিন ফিরবে না বলে।



ডিম – বয়েল ডিম | | নৈশব্দের পংক্তিমালা ।। ধারাবাহিক ।। সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী ।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,  ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

সংবাদটি শেয়ার করুন