অমিত পর্ব – ৯ |||| সুশীল কুমার পোদ্দার
অমিত জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। ড্রাইভার-বিহীন গাড়ীগুলো সুশৃঙ্খল ভাবে এগিয়ে চলছে। গাড়িগুলোতে নেই কোন ধুঁয়া, নেই কোন বীভৎস হর্নের শব্দ । অমিতের মনটা হঠাৎ করে ভালো হয়ে যায়। তবে কি মানুষ প্রকৃতির বেদনাকে বুঝতে পেরেছে? কেন যেন রাস্তার ধারের বাতাসে দোদুল্যমান গাছগুলোকে ওর আরও সবুজ মনে হয় , আরও জীবন্ত মনে হয়। হয়তো ওর মনের ভুল। তবুও এ ভুলটাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে ওর ভালো লাগে। আলখাল্লা, গেরুয়া সহ আরও অনেকে বাসে বসে ঝিমুচ্ছে। দু’একবার আলখাল্লা ওকে চোখের ইশারায় কাছে ডেকেছে। কিন্তু লোকটাকে ওর মোটেই ভালো লাগে না। বড় বেশী দুর্বিনীত। গেরুয়াকে আলখাল্লার চেয়েও রহস্যময় মনে হয়। অমিতের সাথে তার তেমন কথা হয়নি। বাসে ওকে বড় বেশী আনমনা মনে হয়। ও ওর ব্রিফকেজটা বারবার খোলে, বারবার বন্ধ করে । বিড়বিড় করে কি যেন আউড়িয়ে যায়।
ওরা হোটেলে এসে নামে। ওদের জিনিষপত্রগুলো বয়রা রুমে পৌঁছে দেয়। অমিত একনজর ওর ভাঙ্গা স্যুটকেজটার দিকে তাকিয়ে থাকে। আজও ঢাকা এয়ারপোর্টের ট্যাগ ঝুলে আছে । এয়ারপোর্টে মা এসেছিল, ছোট ভাই এসেছিল, আরও এসেছিল তার কিছু নিকট আত্মীয় । সেদিন অনিশ্চয়তায় ওদের জড়িয়ে ধরে সে অনেক কেঁদেছিল। আত্মীয় স্বজন জানতো অমিত আমেরিকা যাচ্ছে। কিন্তু ও কেবল জানতো আমেরিকা অনেক দূর! ওর গন্তব্য হল মেক্সিকো । ওর চোখে ভেসে ওঠে মেক্সিকো সীমান্তের সেই উঁচুনিচু পাহাড়িপথ। পথে ধরা পড়ার ভয়। ভাবতে ভাবতে ও শিউড়ে ওঠে। স্যুটকেজটার গায়ে জড়ানো টেপ খুলতে খুলতে বারবার ওর মনে হয়- কি আছে ওতে? বারবার খুলতে যেয়ে ওর হাত থেমে যায়। পুরানো স্মৃতিরা স্যুটকেজের মধ্যে হুড়াহুড়ি করে বেড় হয়ে আসার জন্য । অমিত ভীষণ ভয় পায় ওদেরকে দেখে , ওদের মুখোমুখি হবার মতো সমস্ত শক্তি সে হারিয়ে ফেলেছে। অনেক সাহস করে ও খুলে ফেলে তার স্মৃতির পেঁটরা। বেড় হয়ে আসে মায়ের ছবি। মা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে, চোখে তার অভিযোগ – বাজান, তুমি আমায় কেন মিথ্যা কথা বলল্যা? গায়ে জ্বর নিইয়া আমায় যখন বলল্যা ভালা আছি ; আমার মনটা বলেছিল আমার বাজান ভালা নাই। আমি তোমায় কতবার ফোন করছি, কেন আমার ফোন ধর নাই বাজান? অমিত, মা মা করে ডেকে ওঠে; মনের মাঝে লুকিয়ে থাকা কষ্টগুলো বরফ গলা নদীর মতো ওর দু চোখ বেয়ে ঝরে পড়ে। একে একে বেড় হয়ে আসে ছোট ভাইয়ের ছবি, আত্মীয় স্বজনের ছবি। অমিত সে ছবিগুলোর মাঝে খুঁজতে থাকে তার মনের মাঝে বেঁচে থাকে এক বিশেষ মুখ। অবশেষে সে খুঁজে পায় সেই মুখ। ধান ক্ষেতের আলে ছাগল কোলে নেওয়া এক মায়াবী মুখ। মুখে এক রহস্যময় হাসি। ঐ হাসিতে দুঃখকষ্ট, , পাওয়া-নাপাওয়া সব মিশে আছে। ঐ ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে নিজকে ওর অপরাধী মনে হয়। অমিত ঘর খুলে বারান্দায় এসে দাড়ায়। দূর আকাশে ম্রিয়মাণ চাঁদের পাশে অনেক গুলো চাঁদ উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছে। সে আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে পৃথিবী; অমিত এ আলোয় ভরা প্রকৃতির মাঝে নিজকে অত্যন্ত অবাঞ্ছিত মনে করে।
বারান্দায় গেরুয়া ও আলখাল্লা কি নিয়ে যেন কথা বলছে। অমিতকে দেখে ওরা এগিয়ে আসে। গেরুয়া এই প্রথম তার সহজাত গাম্ভীর্য ভেঙ্গে অমিতকে বিনীত অনুরোধ করে ওর ঘরে আসার জন্য। অমিত না করতে পারে না। বিছানার উপরে বেশ কয়েকটা স্যুটকেজ খোলা। অসংখ্য খবরের কাগজের কাটিং, ইংরেজি-বাংলায় অসংখ্য খবর গেরুয়াকে নিয়ে। ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের খবর, টরোন্ট শহরে লুটেরা বিরোধী আন্দোলনে তার নাম উঠে এসেছে, লুটেরাদের সমস্ত তথ্য দিয়ে কানাডীয় সরকারকে ব্যবস্থা নেবার আবেদনের খবর , পার্লামেন্টে এমপিপি দের প্রস্তাবনা এবং সমর্থনের খবর । গেরুয়া ভণিতা না করে অমিতকে সব কিছু ভেঙ্গে বলে। জীবৎদ্দসায় শে কোটি কোটি টাকা দেশে বিদেশে বিনিয়োগ করেছিল, বিনিয়োগ করেছিল রিয়েল ষ্টেটে। নতুন জীবন পাবার পর একটা ঘোরের মধ্যে ছিল, কিন্তু যতো দিন যাচ্ছে ততই একটা ভয় তাকে ঘিরে ধরছে। তার শুধু মনে হচ্ছে সামনে ওর জন্য কোন বিপদ অপেক্ষা করছে। আচ্ছা, অমিত তুমি কি বল – আমরা তো মরে গেছি । এই একশ বছর পর বেঁচে উঠলেও আমাদের সনাক্ত করার মতো কেউ বেঁচে নেই। নিশ্চয়ই আমাদের জীবৎদ্দসায় কৃত কর্মের জন্য আমদেরকে অভিযুক্ত করা হবে না। এ কথার সাথে সায় দেয় আলখাল্লা। অমিত এতক্ষণে বুঝতে পারে কেন ওরা আলখাল্লা ও গেরুয়ার বেশ ধরেছে । তবে কি ধর্ম দিয়ে লোক ঠকানোর সেই প্রাচীন ব্যবসা আজও টিকে আছে?
অমিত পর্ব – ৯ |||| সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী । ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স, মাস্টার্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।
সিএ/এসএস
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন