ফিচার্ড বিশ্ব

আবারো উত্তাল শ্রীলঙ্কা

আবারো উত্তাল শ্রীলঙ্কা

শ্রীলঙ্কায় তীব্র বিক্ষোভের মুখে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে দেশটির সরকার। গতকাল বুধবার সকাল থেকে রাজধানী কলম্বোতে দেশটির পলাতক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের সরকারি বাসভবন ঘিরে রেখে বিক্ষোভ করছে হাজার হাজার মানুষ। এদিকে, দেশের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ও বিক্ষুব্ধ জনগণকে শান্ত করতে সেনাবাহিনী ও পুলিশকে তৎপর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন শ্রীলঙ্কার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এরইমধ্যে টেলিভিশন সম্প্রচার বন্ধ করা হয়েছে দেশটিতে।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে নিজেকে দেশটির ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেন।

এর আগে বিক্ষোভকারীরা সংবাদমাধ্যম এনডিটিভিকে জানিয়েছেন, সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীরা দেশটির পার্লামেন্ট ভবনের দিকে যাত্রা করবে এবং প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে পদত্যাগ না করা পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করে বিক্ষোভ চালিয়ে যাবেন। এ সময় তারা প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের পদত্যাগও দাবি করেন।

এদিকে, প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার মালদ্বীপে আশ্রয় নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।

কমপক্ষে ১৫০০ বিক্ষোভকারী দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের কার্যালয়ের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। এ সময় বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ছোড়া টিয়ারগ্যাসের সেলের আঘাতে আহত হয়েছেন অনেকে।

এর আগে, গত ৯ জুলাই অর্থনৈতিক মন্দা ও আন্দোলনের মুখে নতুন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে পদত্যাগ করতে চান বলে জানিয়েছে তার দপ্তর। প্রধানমন্ত্রীর মিডিয়া বিভাগ জানিয়েছে, পার্লামেন্টে সর্বদলীয় সরকার গঠন হওয়ার পরই পদত্যাগ করবেন তিনি।

এর আগে গতকাল সকালে বিক্ষোভের মুখে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে পালিয়ে মালদ্বীপে চলে যান। গতকার আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগের আগে দেশ ছাড়েন তিনি। প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে, তার স্ত্রী, নিরাপত্তারক্ষীসহ চারজন একটি সামরিক উড়োজাহাজে কলম্বো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছাড়েন গতকাল ভোরে।

মালে বিমানবন্দর পুলিশ জানিয়েছে, মালদ্বীপ বিমানবন্দরে অবতরণের পর কড়া পুলিশি পাহারায় তাদের গোপন স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।

এর আগে মঙ্গলবার সকালে গোতাবায়া রাজাপাকসে দেশ ছেড়ে পালাতে বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন। কিন্তু দেশটির ইমিগ্রেশন অফিসারদের বাধায় তিনি যেতে পারেননি। আকাশপথে ব্যর্থ হয়ে তিনি নৌবাহিনীর জাহাজে শ্রীলঙ্কা ছাড়ার চেষ্টাও করেন।

৭৪ বছর বয়সী গোতাবায়া রাজপাকসে স্ত্রীসহ দেশটির কলম্বোর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পাশে সামরিক ঘাঁটিতে ছিলেন।

তিনি সোমবার রাতে সেখানেই ছিলেন। সেখান থেকেই মঙ্গলবার সকালে তিনি বিমানবন্দরে আসেন।

গোতাবায়া বন্দরনায়েকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গিয়ে ভিআইপি স্যুটে অপেক্ষা করছিলেন। নিরাপত্তার জন্যই তাকে সেখানে রাখা হয়। এরপর তার পাসপোর্ট সিল মারার জন্য ইমিগ্রেশন অফিসারদের ভিআইপি স্যুটে যেতে বলা হয়। তারা গোতাবায়ার পাসপোর্টে সিল মারতে অস্বীকার করেন। গোতাবায়া পরিবার নিয়ে সম্ভবত দুবাই যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার জন্য গোতাবায়া ভিসার আবেদন করেছিলেন। তবে তার সে আবেদন নাকচ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকার এক শীর্ষ র্কর্মকর্তার বরাত দিয়ে শ্রীলঙ্কাভিত্তিক ডেইলি মিররের প্রতিবেদনে এমনটাই জানানো হয়েছে।

শ্রীলঙ্কা এবং যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশেরই দ্বৈত নাগরিকত্ব ছিল গোতাবায়ার। কিন্তু ২০১৯ সালের নির্বাচনের আগে একটি আইন মেনে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব ছেড়ে দেন। ওই আইনে বিদেশি নাগরিকদের নির্বাচনে দাঁড়ানো নিষিদ্ধ ছিল।

গোতাবায়ার ছোট ভাই ও দেশটির সাবেক অর্থমন্ত্রী বাসিল রাজপাকসেও গোপনে দেশ ছেড়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিক্ষোভকারীদের বাধার কারণে তার সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়।

সকালে দুবাই যাওয়ার উদ্দেশে গোপনে কলম্বো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি টার্মিনালে হাজির হন বাসিল। কিন্তু বিমানবন্দরে থাকা লোকজন তাকে চিনে ফেলেন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই বিক্ষোভকারীরা বিমানবন্দর ঘেরাও করে অবস্থান নেন।

এ পরিস্থিতিতে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বাসিলকে ভ্রমণজনিত ক্লিয়ারেন্স দিতে রাজি না হওয়ায় ফিরে যান শ্রীলঙ্কার সাবেক অর্থমন্ত্রী।

এর আগে গোতাবায়া পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করেন। সোমবারই তিনি পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করে এরই মধ্যে জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর করেছেন। যদিও যে পদত্যাগপত্রে তিনি স্বাক্ষর করেছেন তার তারিখ দেওয়া আছে গতকাল ১৩ জুলাই ।

এরই মধ্যে বিষয়টি সম্পর্কে জেনেছেন দেশটির পার্লামেন্টের স্পিকার ইয়াপা আবিবর্ধনে। তিনি বুধবার প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের বিষয়টি জনসমক্ষে জানাবেন।

কয়েক মাস ধরেই শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে চরম মন্দা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে, মুদ্রাস্ফীতিও আকাশছোঁয়া। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী কিনতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন মানুষ।

এ অবস্থায় ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে দেশটির সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে। একপর্যায়ে রাজাপাকসে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়।

বিক্ষোভ দমাতে এপ্রিলের শুরুতে রাষ্ট্রীয় জরুরি অবস্থা জারি করেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। কিন্তু প্রেসিডেন্টের এমন পদক্ষেপ বিক্ষোভ দমাতে ব্যর্থ হয়। উল্টো মাত্রা আরো তীব্র হয়।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় মে মাসে পদত্যাগ করেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে। গত ১২ মে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন রনিল বিক্রমাসিংহে।

এই পর্যায়ে দেশজুড়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। নিহত হন এক এমপি। অনেক সাবেক মন্ত্রী-এমপির বাড়ি ও গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী রাজাপাকসের পৈতৃক বাড়িও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।

এদিকে, দেশের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ও বিক্ষুব্ধ জনগণকে শান্ত করতে সেনাবাহিনী ও পুলিশকে তৎপর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন শ্রীলঙ্কার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে।

গতকাল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বিক্ষুব্ধ জনতার হামলার পর টেলিভিশনে সমপ্রচারিত এক ভাষণে এ তথ্য জানিয়েছেন তিনি নিজে। ভাষণে তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনীর ও পুলিশকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দেশের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে যা যা প্রয়োজন, সবই তারা করবে।

১৯৪৮ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ আর্থিক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কা। বর্তমানে দেশটিতে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বলতে আর কিছুই নেই। ফলে ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ অধ্যুষিত শ্রীলঙ্কা খাবার, ওষুধ, জ্বালানির মতো অতি জরুরি আমদানিও করতে পারছে না।

বর্তমান এই দুরবস্থার জন্য দেশটির অধিকাংশ মানুষ প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে এবং তার বড়ভাই ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে দায়ী করে তাদের পদত্যাগের দাবিতে গত মার্চ থেকেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন শ্রীলঙ্কার সাধারণ জনগণ।

প্রায় চার মাস মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবে চললেও গত কয়েকদিন ধরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় আন্দোলন পরিস্থিতি। ৯ জুলাই পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের সরকারি বাসভবনে ঢুকে পড়েন একদল বিক্ষোভকারী। গোতাবায়া অবশ্য একদিন আগেই রাজধানীর কাছে একটি সামরিক ঘাঁটিতে গা-ঢাকা দিয়েছিলেন।

দেশের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ও বিক্ষুব্ধ জনগণকে শান্ত করতে সেনাবাহিনী ও পুলিশকে তৎপর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন শ্রীলঙ্কার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে।

গতকাল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বিক্ষুব্ধ জনতার হামলার পর টেলিভিশনে সমপ্রচারিত এক ভাষণে এ তথ্য জানিয়েছেন তিনি নিজে। ভাষণে তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর ও পুলিশকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দেশের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে যা যা প্রয়োজন, সবই তারা করবে।

প্রেসিডেন্টের বাসভবনে অবস্থান নেওয়া বিক্ষোভকারীরা ঘোষণা দেন, গোতাবায়া পদত্যাগের আগ পর্যন্ত তারা প্রাসাদ থেকে নড়বেন না।

গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়ার কথা ছিল গোতাবায়া রাজাপাকসের। কিন্তু তার আগেই মঙ্গলবার মধ্যরাতে সামরিক বাহিনীর বিমানে মালদ্বীপে পালিয়ে যান তিনি।

গোতাবায়ার দেশ ত্যাগের পর নিজেকে শ্রীলঙ্কার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে, সেই সঙ্গে দেশজুড়ে জারি করেন জরুরি অবস্থা।

কিন্তু তার পরই রনিলের পদত্যাগের দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি কার্যালয়ে হামলা করে তা তছনছ করেন একদল বিক্ষোভকারী। তাদের স্লোগান ছিল, রনিল বাড়ি যাও।

টেলিভিশনে সমপ্রচারিত ভাষণে এই হামলার নিন্দা জানিয়ে বিক্রমাসিংহে বলেন, ‘আমরা সংবিধানকে পদদলিত করতে পারি না। কোনো ফ্যাসিবাদী শক্তি দেশের ক্ষমতা নিয়ে নেবে তা আমরা হতে দিতে পারি না। গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হয়ে ওঠা প্রতিটি ফ্যাসিবাদী তৎপরতা অবশ্যই দমন করা হবে।

এদিকে, শ্রীলঙ্কার জাতীয় টেলিভিশন চ্যানেলের সমপ্রচার স্থগিত করা হয়েছে। নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকট ও গণআন্দোলনের মধ্যে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের বিদেশে পলায়ন এবং এরপরও চলমান বিক্ষোভের মধ্যেই গতকাল চ্যানেলটির সমপ্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়।
গতকাল এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্রীলঙ্কার জাতীয় এই টেলিভিশন চ্যানেলের নাম রূপবাহিনি। কর্মকর্তারা বলছেন, বিক্ষোভকারীরা রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন অফিসে প্রবেশ করায় প্রকৌশলীরা চ্যানেলটির সমপ্রচার বন্ধ করে দেন।

 



সংবাদটি শেয়ার করুন