লেখালেখি

আমাদের মধুদা ও মধুর ক্যান্টিন

আমাদের মধুদা
স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহ্যবাহি মুধুর ক্যান্টিন

আমাদের মধুদা ও মধুর ক্যান্টিন ||| তোফায়েল আহমেদ

আমার প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের পাশে অবস্থিত ‘মধু’র ক্যান্টিন’। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকার চারটি স্থানকে টার্গেট করে-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধুর বাসভবন, তৎকালীন ইপিআর ক্যাম্প (বর্তমান বিজিবি সদর দফতর) ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনস-গণহত্যা শুরু করে। গণহত্যার সেই বিভীষিকাময় রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত মধুর ক্যান্টিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রোষানলে পড়ে। এরই সূত্র ধরে পাকিস্তান বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন মধুদা, তার স্ত্রী, বড় ছেলে ও তার নববিবাহিত স্ত্রী। মধুদার স্মরণে মধুর ক্যান্টিন প্রাঙ্গণেই নির্মিত হয় তাঁর স্মৃতিময় ভাস্কর্য। ভাস্কর্যটির গায়ে লেখা রয়েছে ‘আমাদের প্রিয় মধুদা’। মধুদার ভাস্কর্যে সম্প্রতি কে বা কারা আঘাত করেছে! এর আগে বিগত কয়েক দিন যাবৎ স্বার্থান্বেষী মহল এমনকি জাতির জনকের ভাস্কর্য নিয়ে ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক বক্তব্য প্রদান করেছে। যে বা যারা এসব ঘৃণ্য কার্যকলাপ করছে, তারা ক্ষমাহীন অপরাধ করছে। বাংলার মানুষ তাদের কখনোই ক্ষমা করবে না।



আমরা যারা ষাটের দশকে ছাত্ররাজনীতি করেছি, তাদের কাছে শহীদ মধুসূদন দে তথা মধুদা সুপরিচিত শ্রদ্ধাভাজন এক নাম। আমি যখন ইকবাল হলের (বর্তমান শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ভিপি, ডাকসুর ভিপি ও পরে ছাত্রলীগের সভাপতি, তখন মধুর ক্যান্টিন ছিল আমাদের রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা ও সভা-সমাবেশের কেন্দ্রবিন্দু। এই মধুর ক্যান্টিনে বসেই আমরা বহু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি-যা আজ ইতিহাসের বিষয়বস্তু। ১৯৬৯-এ বাংলার জাগ্রত ছাত্রসমাজ যে ১১ দফা দাবিকে ভিত্তি করে ঐতিহাসিক গণ-আন্দোলনের সূচনা ও সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠন করে, সেই দাবিসমূহ প্রণয়নের আগে ডাকসু ও আমাদের চারটি ছাত্রসংগঠনের নেতৃবৃন্দ-যথাক্রমে ছাত্রলীগ সভাপতি প্রয়াত আব্দুর রউফ ও সাধারণ সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ আলী; ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) সভাপতি প্রয়াত সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক ও সাধারণ সম্পাদক সামসুদ্দোহা; ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) সভাপতি মোস্তফা জামাল হায়দার ও সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল্লাহ এবং এনএসএফ-এর একাংশের সভাপতি প্রয়াত ইব্রাহিম খলিল ও সাধারণ সম্পাদক ফখরুল ইসলাম মুন্সী, ডাকসুর ভিপি আমি তোফায়েল আহমেদ ও জিএস নাজিম কামরান চৌধুরী-এই মধুর ক্যান্টিনে বসেই নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করেছি।

ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের সূচনালগ্নে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের প্রথম কর্মসূচি ছিল ১৭ জানুয়ারি। ১১ দফা কর্মসূচি প্রণয়নের পর এটাই আমাদের প্রথম প্রত্যক্ষ কর্মসূচি। এর আগে আমরা ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছি। ছাত্রসংগঠনগুলোর সাথে বৈঠকের পর বৈঠক। আন্দোলনের কৌশলগত দিক নিয়ে আলোচনা, রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে যোগাযোগ ইত্যাদি। এসব আলোচনা সভার বেশির ভাগই অনুষ্ঠিত হয়েছে ডাকসু কার্যালয়ে, ইকবাল হলে আমার ৩১৩ নম্বর কক্ষে ও মধুর ক্যান্টিনে। সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা কর্মসূচির প্রথম দিন বটতলায় আমার সভাপতিত্বে সভা শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে গভর্নর মোনায়েম খান ১৪৪ ধারা জারি করেছেন। সভাপতি হিসেবে আমার দায়িত্ব ছিল সিদ্ধান্ত দেয়ার যে আমরা ১৪৪ ধারা ভাঙব কি ভাঙব না। জমায়েতে উপস্থিত ছাত্রদের চোখেমুখে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের দৃঢ়তা। যারা বক্তৃতা করেছিলেন প্রায় সকলেই ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে ছিলেন। শেষ পর্যন্ত ১৪৪ ধারা ভঙ্গের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে রাজপথে এলাম। মুহূর্তের মধ্যে পুলিশ বাহিনী ক্ষিপ্রগতিতে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বেপরোয়া লাঠিচার্জ শুরু করে। আমরাও যতদূর সম্ভব প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেষ্টা করি। শুরু হয় টিয়ার গ্যাস আর ফায়ারিং। ছাত্রলীগের সভাপতি জনাব আব্দুর রউফ ঘটনাস্থলেই আহত হন। আমরা ক্যাম্পাসের মধ্যে ফিরে এসে এই মধুর ক্যান্টিনেই আশ্রয় নিয়েছি, পুনরায় জমায়েত হয়েছি এবং পরদিনের কর্মসূচি কী হবে, সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি।


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

সংবাদটি শেয়ার করুন