আমার রবি ।। কৃষ্ণা গুহ রায়
শিশুবেলায় তোমায় প্রথম চিনেছিলাম সহজ পাঠে , কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি, বোঝাই করা কলসি, হাঁড়ি দিয়ে ৷ তখন পাড়ায় পাড়ায় আবার কারুর বাড়িতে একটা কাঠের চৌকি আর কাপড় টাঙিয়ে ঘরোয়াভাবে তোমার জন্মদিন করা হতো৷ এখনকার মতন আড়ম্বর সেসময়ে ছিল না ৷ তোমার জন্মদিনে শিশুশিল্পী হিসেবে উৎসাহে আবৃত্তি করতাম ” বীরপুরুষ, তালগাছ, লুকোচুরি৷ “
তারপর যখন কৈশোরের মুকুল সঞ্চারিত হলো শরীরে , নৃত্যের তালে তালে মেতে উঠলাম তোমায় নিয়ে ৷ পাড়ার এক দিদি তোমায় নিয়ে কোনও অনুষ্ঠান হলেই নাচ তুলিয়ে দিতো ৷ কত যে নৃত্যশৈলী আর কত যে তার ভঙ্গীমা ৷
একের পর এক তোমার গানের মালা গেঁথে নৃত্যের ঝংকারে আমার কৈশোরের প্রেম তোমাকে নিবেদন করেছি কবি , “হৃদয় আমার নাচেরে , এসো নীপবনে , মোর বীণা ওঠে ” আরও যে কত তা আজ আর মনে নেই৷
তোমার ” পূজারিনীতে” সেজেছিলাম বধূ অমিতা ৷ এখনও মনে আছে দৃপ্তস্বরে বলেছিলাম, ‘অবোধ, কী সাহসবলে এনেছিস পূজা!’
কিশোরীবেলার অবাধ্য প্রেমের লাজুক চাউনির প্রথম শিহরণে গেয়ে উঠেছিলাম তোমারই গান, ‘প্রাণ চায় , চক্ষু না চায়৷’
স্কুলের গন্ডী পেড়িয়ে কলেজে পা দিতেই কলেজের প্রথম বার্ষিক অনুষ্ঠান ‘চিত্রাঙ্গদা’ ৷ না তখন আর নাচে না ভাষ্যপাঠ করেছিলাম ৷ উদ্যম যৌবনে তুমিই শিখিয়েছিলে , ‘আমার চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ’৷
পরবর্তীকালে যখন আকাশবাণীতে উপস্থাপনার কাজ পেলাম , জানো রবি খুব গর্ব হয়েছিল , কারণ আকাশবাণীতো তোমারই দেওয়া নাম৷
আকাশবাণী কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ছুটেছিলাম শান্তিনিকেতন বসন্ত উৎসবের অনুষ্ঠান টেক করতে৷ তৎকালীন অনুষ্ঠান আধিকারিক প্রয়াত রুবী বাগচী একটা ছোট্ট চিরকূট হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, অমিতাদিকে গিয়ে দেখাস তোকে সাহায্য করবে ৷ অমিতাদি মানে অমিতা সেন , ক্ষিতি মোহন সেনের কন্যা এবং অমর্ত্য সেনের মা৷
ছোট্ট চিরকূটে রুবীদি লিখেছিলেন, শ্রদ্ধেয়া অমিতাদি , ভালবাসি বলে বিরক্ত করতে সাহস পাই ৷ তোমার কাছে কৃষ্ণাকে পাঠালাম ওকে একটু দেখো ৷
আনন্দের আবেগে ভেসে গিয়েছিলাম সেদিন ৷ বুঝেছিলাম ভালবাসার মানুষদের সত্যিই বিরক্ত করা যায় এবং তারা সেটা হাসিমুখে মেনেও নেন৷
শান্তিনিকেতনে যেদিন পৌছালাম , পরদিন যখন অমিতাদির কাছে গেলাম ওনার স্নেহ আর আদরের আন্তরিকতায় ভরে উঠল প্রতীচী৷
বসন্ত উৎসবের অনুষ্ঠান টেক করতে গিয়ে মোহরদি তথা কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, গোরাদা প্রমুখের সান্নিধ্য ৷ এদের স্নেহের আলিঙ্গনে আমি তখন আপ্লুত ৷ মনে হয়েছিল ওই তো ওইখানটিতে তুমি বসে আছো ৷ স্মিত হেসে বলেছিলাম “তুমি রবে নীরবে৷ “
সংসারজীবনে যেদিন প্রবেশ করলাম সেদিনও রবি তুমি ছিলে আমার সঙ্গে৷ প্রকৃতিপ্রেমিক,সংস্কৃতিমনস্ক যুবক পুরুষটি বুঝিয়ে দিয়েছিল সেই তোমার কথাই,” নারী তুমি অর্ধেক আকাশ৷ ” প্রেমের জোয়ারে ভেসে গিয়েছিলাম সেদিন৷
আকস্মিক ঝড় যেদিন এক লহমায় সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল, সেদিনও তুমি ছিলে পাশে৷ কানে কানে বলেছিলে, “যে রাতে মোর দূয়ারগুলি ভাঙ্গলো ঝড়ে৷ “
আঁধাররাতে যখন মন বিষন্ন হয় তখন চুপটি করে এসে বলো, ” কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে৷ “
যখন দিনযাপনের গ্লানিতে হাঁফিয়ে উঠি , মনে হয় আর পারছি না বাইতে এই জীবনতরী , তখনও তুমিই এসে উজ্জীবীত করো , “প্রাণ ভরিয়ে,তৃষা হরিয়ে মোরে আরও আরও আরও দাও প্রাণ৷ “
তুমি যে শুধু আমার রবি….. প্রেমিক রবি, বন্ধু রবি, অভিভাবক রবি আরও আরও কত কি….
কৃষ্ণা গুহ রায় , সাহিত্য কর্মী।। কলকাতা,পশ্চিমবঙ্গ, ভারত৷