ফিচার্ড লেখালেখি

আরহামের ছবি এবং নিউইয়র্কে একটি সান্ধ্য আড্ডা

আরহামের ছবি এবং নিউইয়র্কে একটি সান্ধ্য আড্ডা

কাজী জহিরুল ইসলাম ।। আমীরুল আরহামের ডকুফিল্ম ‘দ্য লস্ট সোলস অব বাংলাদেশ’ এর স্ক্রিনিং হয় নিউইয়র্কের ফ্লোরাল পার্কে। আয়োজন করে আরোহ ক্লাসিকস। এই সংগঠনের কর্ণধার প্রকৌশলী এবং উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের শিল্পী টগর চৌধুরী এবং এটর্নি লাকী খালেক। তাদের আতীথেয়তায় এক আনন্দঘন পরিবেশে ছবিটি দেখার জন্য শুক্রবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, সন্ধ্যায় জড়ো হয় নিউইয়র্কের সংস্কৃতি-সেবী চল্লিশজন নারী-পুরুষ।

আমীরুল আরহাম আমার খুব কাছের মানুষ। তিনি প্যারিসে বসবাস করেন। ১৯৮৪ সালে দেশ ছেড়ে পাড়ি জমান ফ্রান্সে। চলচ্চিত্রের ওপর পড়াশোনা করেন এবং ফরাসী মূলধারার চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত হন। তার নির্মিত বেশ কিছু ডকুফিল্ম ফরাসী মূলধারার টেলিভিশনে প্রদর্শিত হয়েছে। অধ্যাপক ড. ইউনূসকে নিয়ে তিনি ‘অ্যা ব্যাংকার ফর দি পুওর’ চলচ্চিত্র নির্মাণ করে বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে সমাদৃত হন। চলচ্চিত্র নির্মাণের পাশাপাশি তিনি কবিতাও লেখেন। আর কবিতা-সূত্রেই তার সঙ্গে আমার পরিচয় ও সখ্য গড়ে ওঠে।

২০২০ সালের শুরুতে করোনা মহামারী শুরু হলে পৃথিবী গৃহবন্দি হয়ে পড়ে। আমাদের দরোজাগুলো বন্ধ হয়ে যায়। আমরা জানালাগুলো খুলে দিই। একটি মহাশক্তিশালী জানালা ভার্চুয়াল মিডিয়ার কল্যাণে আমরা বাহিরকে ঘর আর ঘরকে বাহির বানিয়ে ফেলি। দুই হাজার কুড়ি সালের মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে ‘কফি ও কবিতা’ নামে একটি ভার্চুয়াল আড্ডা ও কবিতা পাঠের আসর শুরু করি। কিছুদিনের মধ্যেই সেখানে প্যারিস থেকে যোগ দেন আমীরুল আরহাম। তখন আমরা প্রতিদিন ভার্চুয়াল মিডিয়ায় কফি ও কবিতার আসর বসাতাম। আমাদের স্লোগান ছিল ‘কফি যার যার কবিতা সবার’।

সেই থেকে আমীরুল আরহামের সঙ্গে আমার সখ্য এবং তা ক্রমশ নিবিড় বন্ধুত্বে পরিণত হয়। সম্প্রতি তিনি উত্তর আমেরিকা সফরে বেরিয়েছেন। এই সফরের অংশ হিসেবে ক্যালিফোর্নিয়া, টরণ্টো এবং নিউইয়র্ক ভিজিট করেন। তিন জায়গাতেই তার নির্মিত ভিন্ন ভিন্ন চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়।

দ্য লস্ট সোলস অব বাংলাদেশ ছবিটি বাংলাদেশে আটকে পড়া বিহারীদের ওপর নির্মিত। এই ছবিতে তিনি ঢাকার মোহাম্মদপুরে অবস্থিত জেনেভা ক্যাম্পে বসবাসরত ২ লক্ষ ৩৮ হাজার বিহারি জনগোষ্ঠীর মানবেতর জীবনের করুণ চিত্র তুলে ধরেন। ছবিটি তিনি নির্মাণ করেন ১৯৯৬/৯৭ সালে। এর বছর তিনেক আগে ১৯৯৩ সালে একই বিষয় নিয়ে আমি বেশ কিছু কাজ করি। বিহারীদের জীবন-যাপন নিয়ে বাংলাদেশের একটি জাতীয় সাপ্তাহিক পত্রিকার জন্য বেশ কিছু ধারাবাহিক প্রতিবেদন তৈরি করি। তখন জেনেভা ক্যাম্পে প্রচুর সময় কাটাই। নাগরিকত্বহীন, শিক্ষা, চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত একদল মানুষের অবর্ণনীয় কষ্টের গল্প তুলে ধরি সেইসব প্রতিবেদনে। আরহামের ছবিটি দেখতে দেখতে আমার সেইসব দিনের কথা বারবার মনে পড়ছিল। বিহারীদের নেতা নাসিম খানের সাক্ষাৎকার নেবার জন্য আমাকে বহুদিন জেনেভা ক্যাম্পে যেতে হয়েছে। অবশেষে একদিন খুব ভোরে গিয়ে তার সাক্ষাত পাই। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অভিবাসনের ঘটনাটি ঘটে। ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত ভারত ও পাকিস্তানের হিন্দু মুসলমানদের এপার-ওপার হবার ঘটনাটি আজ অব্দি পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড়ো মাইগ্রেশন হিসেবে চিহ্নিত। ৪ বছর সময়ের মধ্যে ১ কোটি ৪৫ লক্ষ মানুষ তার জন্মভিটা ছেড়ে পাড়ি জমায় অজানার উদ্দেশে। সদ্য জন্ম নেয়া পাকিস্তান থেকে হিন্দুরা পাড়ি জমায় ভারতে এবং ভারতে বসবাসরত মুসলমানেরা পাড়ি জমায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে। ১৯৪৬ সালের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে ভারতের বিহারে বসবাসকারী ৩০ হাজার মুসলমান নারী-পুরুষকে হত্যা করে হিন্দু দাঙ্গাবাজেরা। ভারতের অন্যান্য মুসলমানদের মত বিহারে বসবাসরত নির্যাতিত মুসলমানেরা জীবনের নিরাপত্তার জন্য পাড়ি জমায় পাকিস্তানে। ভৌগোলিক ভাবে পূর্ব পাকিস্তান কাছে হওয়ায় তারা পূর্ব-পাকিস্তানে ঢুকে পড়ে। সেই থেকে তাদের অন্তরে পাকিস্তান রাষ্ট্র। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে এবং পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। পাকিস্তানি আর্মির সহায়তায় তারা বাঙালিদের হত্যা, বাড়িঘর লুণ্ঠন, বাঙালি নারীদের ধর্ষণসহ নানান বর্বরোচিত কাজে লিপ্ত হয়।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ সরকার তাদের নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকার করে। চোখে-মুখে নির্যাতনের বিভীষিকা নিয়ে ১৯৪৭ সালে তারা পাড়ি জমায় পাকিস্তানে। তাদের কাছে পাকিস্তান ছিল ত্রাণকর্তা, জীবন রক্ষাকারী। পাকিস্তান ছিল তাদের কাছে নিরাপত্তা, শান্তি ও সমৃদ্ধির স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন নতুন প্রজন্মের বিহারীদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিয়েছেন তাদের নেতারা। বিহারীদের নেতা নাসিম খান, এই সিনেমায়, এবং আমার সঙ্গে সাক্ষাৎকারেও, দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছেন, পাকিস্তানই তাদের দেশ। তারা পাকিস্তানে ফিরে যেতে চায়।

সিনেমাটি ফ্রান্সসহ ইওরোপের বিভিন্ন দেশে প্রদর্শিত হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ প্রভৃতি আন্তর্জাতিক সংস্থার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এর ফলে বহু মানুষ ইউরোপে মাইগ্রেট করার সুযোগ পায়। আরহাম জানান, দুঃখজনক হলো প্রায় হাজার পাঁচেক বাঙালি বিহারী নাম (খান) ধারণ করে ইওরোপে অভিবাস গ্রহণ করে।

অভিবাস দূর্ণীতি নতুন কিছু নয়। ১৯৯৯ সালে আমি ডেনমার্কে গিয়ে দেখি ওখানে ১২৫ টি বাংলাদেশী পরিবার বসবাস করে অথচ পাকিস্তানী পরিবারের সংখ্যা পাঁচ হাজার। জিজ্ঞেস করে জানতে পারি ১৯৭১ সালে যুদ্ধের দোহাই দিয়ে পাকিস্তানীরা ইওরোপের বিভিন্ন দেশে মাইগ্রেট করে, সেই সময়েই এই পরিবারগুলোর অধিকাংশ ডেনমার্কে ঢুকে পড়ে।

ছবি দেখা শেষ হলে প্রশ্নোত্তর পর্বে আমীরুল আরহাম জানান, তিনি বিহারীদের পাকিস্তান প্রত্যাবাসনের বিষয় নিয়ে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করার এবং কথা বলার বহু চেষ্টা করেন কিন্তু তারা কিছুতেই কথা বলতে রাজী হননি, উপরন্তু আরহামকে তারা পাকিস্তানে কালো তালিকাভূক্ত করেন, যাতে তিনি পাকিস্তানের ভিসা না পান।

পরে ধনঞ্জয় সাহা, শাহ আলম দুলাল ছড়া পড়েন, আমি এবং আমীরুল আরহাম কবিতা পড়ি। আমাদের তাড়া থাকায় চলে আসি, আড্ডা তখনও চলছিল, নিশ্চয়ই আরো কবিতাপাঠ এবং গান হয়েছে, যা আমরা মিস করেছি।

প্রসঙ্গত একটি কথা বলি, আমীরুল আরহাম কবি শামসুর রাহমানকে ফ্রান্সে নিয়ে যান, তার বেশ কিছু কবিতা ফরাসী ভাষায় অনুবাদ করে একটি ছোট্ট বই বের করেন এবং ফরাসী মূলধারার কবিদের সঙ্গে তাকে পরিচিত করাবার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। দীর্ঘদিন দেশের বাইরে অবস্থান করলেও আরহামের সমস্ত অন্তর জুড়ে আছে বাংলাদেশ। এখন তিনি রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ করছেন।

হলিসউড, নিউইয়র্ক। ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২।

 

 



সংবাদটি শেয়ার করুন