লেখালেখি

উক্রেনিয়ান ফ্লাইট ৭৫২; শোকার্ত কানাডা

উক্রেনিয়ান ফ্লাইট ৭৫২; শোকার্ত কানাডা

যাত্রীবাহী বিমান বিধ্বস্ত হবার ঘটনা প্রবাহে উক্রেইন নামটি ইতিহাসে অংশ হয়ে গেছে। মিসাইল দিয়ে বিমান ফেলে দেবার  গুঁটি কয়েক  ঘটনায় উক্রেইন নামক দেশটি ফিরে ফিরে সংবাদ শিরোনাম হচ্ছেই।  সাম্প্রতিক  বছরের বিমান দুর্ঘটনায়  মালয়েশিয়া  আর উক্রেইন হাত ধরাধরি করে দুর্ভাগ্যের পেছনে ছুটছে। পাঠকদের নিশ্চয় মনে আছে রাশিয়ার ক্রিমিয়ার দখল করে নেওয়াকে কেন্দ্র করে চলমান উত্তেজনার পটভূমিতে ইউক্রেইন আর রাশিয়া সমর্থিত ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যকার সংঘাতের বলি হতে হয়েছিল মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের  ফ্লাইট এমএইচ১৭ কে। আমস্টারডাম থেকে কুয়ালালামপুরগামী  মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের  ফ্লাইট এমএইচ১৭ এর বোয়িং ৭৭৭ জেট লাইনারটিকে ২০১৪ সালের ১৭ই জুলাই  যেভাবে ভূপাতিত করা হয়েছে, তা মানবতার বিরুদ্ধে ভয়াবহ অপরাধ।    এই ধরণের অপরাধ আগেও ঘটেছে কয়েকবার। উক্রেইনের বিরুদ্ধে একই অপরাধের অভিযোগ ছিল। ২০০১ সালের ৪ঠা  অক্টোবর সাইবেরিয়া এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ১৮১২ কে  উক্রেনিয়ান আর্মি  মিসাইল দিয়ে ফেলে দিয়েছিল।  তেলআবিব থেকে নভোসিবিরস্ক   যাবার পথে কৃষ্ণ সাগরে  চিরতরে হারিয়ে  গিয়েছিল ৭৮ জন যাত্রী।  ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র,  নাজি  জার্মানি, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এই অপরাধগুলো সাথের জড়িত ছিল।  পাঁচটি বড়  ঘটনার ভিকটিমরা হচ্ছে ইরান, লিবিয়া, রাশিয়া, দক্ষিন কোরিয়া এবং মালয়েশিয়া।

ইতিহাসের যেন পুনরাবৃত্তি। এবার ভিকটিমের ভূমিকায় উক্রেইন। উক্রেনিয়ান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের  ফ্লাইট ৭৫২ তেহরান থেকে কিয়েভ যাবার পথে বিধ্বস্ত হল তেহরানের ইমাম খোমেনি বিমান বন্দরের কাছেই। নিহত নাগরিকদের সংখ্যায় অবশ্য উক্রেইনের চাইতে অনেক বেশী ক্ষতিগ্রস্ত ইরান আর কানাডা।  বিমান চালনার ইতিহাসে দুর্বোধ্য রহস্যের জন্ম দিয়ে ২০১৪ সালের ৮ই মার্চে  কুয়ালালামপুর থেকে বেইজিং এর পথে ২৩৯ আরোহীসহ রাত্রিকালিন বা রেড-আই  ফ্লাইট  এমএইচ ৩৭০  কোন প্রকার পেন-পেন বা মে-ডে সঙ্কেত ছাড়াই হারিয়ে গেল। একইভাবে উক্রেইনের আকাশে  এমএইচ১৭ বেলায়ও মে-ডে সংকেত  দেবার  সুযোগও হয়নি। তেহরানে উক্রেনিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটিও বিধ্বস্ত হল কোন প্রকার মে ডে সংকেত না দিয়েই।

ইরান স্বীকার করেছে উক্রেনিয়ান এয়ারলাইন্সের  বিমানটি মিসাইলে ভূপাতিত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে   মধ্যপ্রাচ্যের রক্ত  অনেকটাই নিয়ামক হয়ে উ ঠেছে। ইম্পিচমেন্ট, নির্বাচন ইত্যাদি নানা ইস্যুতে বীরত্ব গাঁথা রচনায় তেল সমৃদ্ধ  মধ্যপ্রাচ্যের রক্তে হাত না রাঙালে  রাজনীতিটা জমে উঠে না। আইএসআইএস খেলায় ভীষণ উপকারী সহযোগী জেনারেল কাসেম সোলাইমানির রক্তে হাত রাঙালে নির্বোধ আমেরিকান ভোটারদের পক্ষে পাওয়া যাবে রাজনীতির কঠিন সময়ে  এটাই ছিল সম্ভবত ট্রাম্পের  কৌশল। মর্মান্তিক এই ঘটনায় মূল দায় ইরানের উপর বর্তালেও পরিস্থিতি উস্কে দেবার দায় কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের। এই প্রশ্ন উঠছে, কানাডার প্রধানমন্ত্রীকে সংবাদ সম্মেলনে এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

শোকে মুহ্যমান কানাডা। তেহরানে দুর্ঘটনার পরেরদিন উক্রেইনের রাজধানী কিয়েভ থেকে টরেন্টোতে    উক্রেনিয়ান এয়ারলাইন্সের নিয়মিত ফ্লাইটি টরেন্টোতে পৌঁছল টিকেট কাটা ১৩৮টি আসন খালি রেখে। না, ওরা আসেনি, একটি পুরো পরিবার, নব দম্পতি, শিশু, অসংখ্য মেধাবী ছাত্রছাত্রী, ফ্যাকাল্টি মেম্বার, বিজ্ঞানীদের ১৩৮ জনের একটি বিশাল গ্রুপ যারা তেহরান থেকে কিয়েভ হয়ে কানাডায় ফেরার কথা, হারিয়ে গেলেন চিরতরে। তেহরানে বোয়িং ৭৩৭-৮০০ বিমান দুর্ঘটনায় নিহত ১৭৬ জনের মধ্যে ৬৩ জন কানাডিয়ান নাগরিক ছিল।  বাকিরা ছিলেন  কানাডায় বসবাসরত আলোকিত ইরানিয়ান যাদের অধিকাংশই ছাত্র।  নিহত মেধাবী এই ইরানিয়ান/কানাডিয়ান নাগরিকদের জন্যে অপেক্ষা করছিল মানব কল্যাণে নিয়োজিত আলোকিত ভবিষ্যৎ। বিমান দুর্ঘটনার ইতিহাসে এটি কানাডার জন্যে ভীষণ বেদনার একটি সময়।  জ্ঞান বিজ্ঞান আর গবেষণায় ইরানী বা ইরানী কানাডিয়ানদের আলাদা মর্যাদা রয়েছে। আমাদের পরিচিত অনেক বন্ধুরা হারিয়েছেন তাঁদের প্রিয়জন।

বিমান দুর্ঘটনায় এটি কানাডার দ্বিতীয় মর্মান্তিক উপাখ্যান। ১৯৮৫ সালের ২৩শে জুন   টরেন্টো-মন্ট্রিয়ল-দিল্লির এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট ১৮২ আটলান্টিকের উপরে ৯৪০০ মিটার উচ্চতায় খালিস্থানিদের বোমায় বিধ্বস্ত হয়।  নিহত হয় ২৬৮ জন কানাডিয়ান, ২৭ জন ব্রিটিশ আর ২৪ জন ভারতীয়।  ঐ ঘটনার যন্ত্রণা তাড়িয়ে বেড়ানো কানাডিয়ানদের জন্যে  উক্রেনিয়ান এয়ারলাইন্সের  বিমানটি ভূপাতিত করা  নতুন এক দুঃস্বপ্ন।

কানাডার  আলবার্টা প্রদেশের রাজধানী  এডমন্টন। প্রায় ২৮ জন মারা গেছেন  এডমন্টন থেকে এবং এটি ঐ শহরের ইরানিয়ান কমিউনিটির প্রায় ১%। আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের  ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের  অধ্যাপক দম্পতি মোজগান আর পেদ্রাম  তাঁদের দুকন্যা  ডারিয়া আর ডোরিনা সহ সপরিবারে হারিয়ে গেলেন চিরতরে। এডমন্টনের মেধাবী গাইনোকোলজিস্ট শেকুফেহ দুই কন্যা আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের  সায়েন্সের ছাত্রী সাবা আর মনোবিজ্ঞানের ছাত্রী সারা সহ শিকার হলেন ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের। পুনেহ আর আরাশ নবদম্পতি,  আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের  স্নাতকোত্তর  পর্যায়ে এই দুজন ইরান থেকে  বিয়ে করে ফিরছিলেন,  ওদের আর সংসার করা হলো না। আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের  স্নাতকোত্তর ছাত্র ছাত্রী আমির আর নাসিম হারিয়ে যাওয়াদের অন্যতম।

ভেংক্যুবার  তথা ব্রিটিশ কলাম্বিয়া থেকে হারিয়ে গেলেন  ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী ডেলারাম। আয়েশা তাঁর ১৭ বছরের কন্যা ফাতেমা সহ নিহত হলেন। প্রকৌশলী মোহাম্মেদ সাকেত তাঁর  স্ত্রী ডেন্টাল হাইজেনিস্ট ফাতেমাহ সহ মারা গেলেন। আরডালান  স্ত্রী নীলুফা আর ১৫ বছরের ছেলে সহ নিহত হলেন।

মেনিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ের  ইমুনোলজির  ডক্টরেট ফরো খাদেম, বায়ো মেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার আমির সহ অনেক ছাত্র, এলাম্নাই  উইনিপেগের বাসিন্দা নাদেরি পুত্র সাদর সহ হারিয়ে গেলেন চিরতরে।

 

অন্টারিও থেকে ডেন্টিস্ট ডঃ পারিশা ৯ বছরের কন্যা রিরা সহ, গুয়েলফ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের পিএইচডি  ছাত্র ঘানিমত, মার্কেটিং বিভাগের পিএইচডি  ছাত্র মিলাদ, সাহার  আর তাঁর কন্যা এলসা, চাকুরীজীবী সমাজকর্মী  সুজান, ইমাম, পারিনাজ সহ অনেকেই হারিয়ে গেলেন। জয়নাব আর মোহাম্মদ, আপন ভাইবোন, পড়াশুনা করেছেন টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে, চলে গেলেন পরপারে  একসাথে। ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং এর  ছাত্র  ইমাম আর মেহদি, ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ছাত্র মারজিয়েহ আর মান্সোর, উইন্ডসর  বিশ্ববিদ্যালয়ের  রিসার্চ সহকারী  ইঞ্জিনিয়ার  যাহ্‌রা , টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি  ছাত্র মোহাম্মেদ হারিয়ে যাওয়াদের মধ্যে অন্যতম। কানাডার রাজধানী অটোয়া্র সাথে সম্পর্কিত ৮ জন নিহত হয়েছেন। অটোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে  পিএইচডিরত আলমা,  পিএইচডিরত সাইদ আর মেহ্রাবান নিহতদের অন্যতম।

মন্ট্রিয়ল কানাডার ফরাসী ভাষার প্রদেশ কুবেকের  সবচেয়ে বড় আর কানাডার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর।  শিক্ষিত, মার্জিত ইরানিয়ান সমাজের  একটি অংশ এখানেও সক্রিয়।  রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক বিবাদের বাইরে ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকায় সাধারণের মাঝে পারস্য সভ্যতার ইরানীয়ানদের তাঁদের শিক্ষা, রুচি আর আচরণের জন্যে সহানুভুতি চোখে পড়ার মত। আমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি সাধারন   পশ্চিমারা আরবদের চাইতে ইরানীদের প্রতি  অনেক বেশী সহানুভুতিশীল। মাস খানেক আগে আমার গবেষণাগারে সুযোগ করে দিলাম এক ইরানী বিজ্ঞানীকে কাজ করবার জন্যে। তেহরান ক্রাশ স্পর্শ  করেছে মন্ট্রিয়ল তথা কুবেককে। মন্ট্রিয়লের  বিমান  নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোম্বারডিয়েরে কাজ করেছে প্রকৌশলী সিয়াবাশ । মন্ট্রিয়লের  কনকর্ডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশলীদ্বয় সিয়াবাশ  আর  সারা মামানি  ইরানে গিয়ে বিয়ে করে  ফিরছিলেন। না,  ওদের আর সংসার করা হলোনা। কনকর্ডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর  বাংলাদেশী কানাডিয়ান অধ্যাপক ডঃ ওয়াইজ আহমেদ ভগ্ন হৃদয়ে  স্মৃতিচারণ করছিলেন  তাঁর বিভাগের এই স্টার ছাত্র ছাত্রীদের।  আরভিন আর বিল্ডিং এনার্জি বিশেষজ্ঞ আইডা  দুজনেই মন্ট্রিয়লের  প্রেস্টিজিয়াস স্কুল অব টেকনোলজি (ETS)  থেকে  সম্প্রতি ইঞ্জিনিয়ারিং এ  পিএইচডি  করেছেন, বেড়াতে গিয়েছিলেন ইরানে, মন্ট্রিয়লে আর ফেরা হলো না। বোম্বারডিয়েরে কর্মরত মোহাম্মেদ  নিহতদের অন্যতম।  ম্যাকগিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র, দুজন এলাম্নাই  নিহত হয়েছেন।

কানাডার ইস্ট কোস্টে  নোভা স্কশিয়ার রাজধানী হেলিফাক্স হারিয়েছে তাঁদের একজন ডেন্টিস্ট শারিহ ফাঘিহিকে।

নিহতদের  মধ্যে যাদের কথা উল্ল্যেখ করেছি তা থেকে  এটা স্পষ্ট, কানাডার সব বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাঁদের আলোকিত  ছাত্রছাত্রীদের  হারিয়েছে, কানাডা হারিয়েছে গর্বিত পেশাজীবিদের স্টার সদস্যদের।  ইরান,  উক্রেইনের পাশাপাশি মূল দায়টা  যুক্তরাষ্ট্রকে বহন করতে হবে। ট্রাম্পের তথাকথিত নিরাপদ বিশ্ব উন্মাদনায় ভয়াবহ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল প্রতিবেশী কানাডা তাঁর মেধাবী নাগরিকদের হারিয়ে। উক্রেইনের দায় আছে মিসাইল উৎক্ষেপণের এরকম বিপদজনক অবস্থায় ফ্লাইট চালনায়।  মূল দায়টা ইরানের,  সেলফ ডিফেন্সের কথা বলে পার পাবেনা, এ অবস্থায় খোমেনি বিমান বন্দর বন্ধ করা উচিত ছিল।  ট্রাম্পের  দায়  নিজের রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে এরকম  ট্র্যাজেডির ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্যে।

আরও পড়ুনঃ জাতির পিতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উদযাপন ও মুজিববর্ষের ক্ষণগণনার উদ্বোধন

আরও পড়ুনঃ জাতির পিতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উদযাপন ও মুজিববর্ষের ক্ষণগণনার উদ্বোধন

আরও পড়ুনঃ ওই মহামানব আসে…

আরও পড়ুনঃ মুজিববর্ষে আমাদের প্রত্যাশা

আরও পড়ুনঃ জগতে জ্যোতির্ময় জাতির জনক

আরও পড়ুনঃ ইরানের বিধ্বস্ত ইউক্রেনের বিমানের ভিডিও প্রকাশ করল যুক্তরাষ্ট্র

আরও পড়ুনঃ ভবঘুরে মজনুর বিকৃত জীবন

আরও পড়ুনঃ যুদ্ধ এক দুঃখ

আরও পড়ুনঃ মুজিববর্ষ উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানে জাস্টিন ট্রুডো

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে cbna24.com 

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

four × one =