ফিচার্ড লেখালেখি

অবলাচরণ – ৯ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

পর্ব প্রকাশের পর….

অবলাচরণ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

বাউল বাতাস কোথা হইতে আম্র বকুলের গন্ধ মাখিয়া তাহার উপর লুটাইয়া পড়িল। অবলা সেই পাগল করা গন্ধে আবিষ্ট হইয়া মুখে সেই জটীলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের কালজয়ী ফাগুন-পলাশের গানের মুখরা ভাঁজিতে ভাঁজিতে বাগানময় ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল। বাগানের শেষ মাথায় সান বাধান পুকুর ঘাট। একদা মা দিদিরা কাঁখের কলসি রাখিয়া এই ঘাটে স্নান করিত। ঘাটটি সময়ের বাধা অতিক্রম করিয়া বুকে কলসির দাগ লইয়া একদিকে হেলিয়া পড়িয়াছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে শ্যাওলা আর বুনো লতারা আঁকড়াইয়া ধরিয়াছে তাহার রুগ্ন শরীর। কতদিন আসা হয় নাই এই পুকুর পারে ! পুকুরের জল অনেকটা শুকাইয়া গিয়াছে। হাঁটু কাদা জলে কলমির দল অফুরন্ত সবুজ মাখিয়া দিক বিদিক ছড়াইয়া রহিয়াছে। অবলা তাহার দিকে ক্ষণকাল চাহিয়া থাকিল। আসন্ন কালবৈশাখীর বার্তা পাইয়া পুকুর পারের সারি সারি শুপরী গাছ, নারিকেল গাছ হঠাৎ উন্মত্ত হইয়া মাথা দোলায়িতে লাগিল। অবলা তবুও ঠাই দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার মাথায় একী চিন্তা – উদ্যানের কোথায় সে কোন গাছ লাগাইবে, কোথায় বানাইবে সে পথভুলাদের জন্য ঘর, কিই বা রাখিবে তার কল্পনার উদ্যানের নাম। তাহার বিবেক বলিয়া উঠিল- অবলা ‘পথ’ নামটি কেমন? অবলা রোমাঞ্চিত হইলো সেই নাম শুনিয়া। তাইতো, পথ ভুলা মানুষের জন্য তাহার এই উদ্যান পথের সন্ধান দেবে, ওরা ওঁদের আপন ঘরে ফিরিয়া যাইবে – এর চেয়ে ভাল নাম আর কীইবা হইতে পারে?

সন্ধ্যার আলোটুকু হঠাৎ করিয়া নিভিয়া গেল। গভীর তমসা লইয়া ঝুপ করিয়া রাত্রি নামিয়া আসিল। পুকুর পারে ঘন জঙ্গলে জ্বলিয়া উঠিল কিছু আঁধার মানিক, মাথার উপর দিয়া উড়িয়া গেল রাতজাগা বাদুড়। বহুদিন পর ঘরে ফিরিবার এক তীব্র বাসনা জাগিয়া উঠিল তাহার অন্তরে। অমীমাংসিত প্রশ্নগুলো তাহার মাথার মধ্যে নাছোড়বান্দা পোকার মত কিলবিল করিতে লাগিল। কেমন করিয়া ফুল মানুষের মনে ছড়াইয়া দেয় সুখানুভূতি, কেমন করিয়া জন্ম লইয়াছে পৃথিবীর আদিম ফুল, কার প্রয়োজনে ? এমনি অসংখ্য প্রশ্ন প্রশ্নবোধক চিহ্ন হইয়া তাহার মনের মাঝে ঝুলিয়া রহিল।

সেই রাতে অনেক রাত অবধি অবলা জাগিয়া রহিল। তাহার পাশে তাহার মোবাইল অনাদরে পড়িয়া রইল। টেলিফোন টুংটাং শব্দ করিল, মেসেঞ্জার বিচিত্র শব্দ করিয়া তাহাকে জানান দিল – অবলা তোমার নামে চিঠি আসিয়াছে, অবলার অজান্তে ফেসবুকের পাতা অসংখ্য পোস্টে ভরিয়া গেল। অবলা একটি বারও ফোন খুলিয়া দেখিল না। অবলা যে বাঁচিয়া থাকিবার রসদ পাইয়াছে ! সে বাহিরে আনন্দ না খুঁজিয়া নিজের মাঝেই আবিষ্কার করিয়াছে এক অনাবিল আনন্দের উৎস । তাহার জ্ঞানার্জনের স্পৃহা, ভালো কিছু করিবার ইচ্ছা তাহার জীবনকে দিয়েছে এক নতুন দিশা। অবলা যতই জানে ততই আরও জানিতে ইচ্ছা করে। জানার মাঝে উদিত হয় কতো না জানা অধ্যায়। সেই সব না জানা অধ্যায়ের যবনিকা উঠাইতে যাইয়া অবলার চোখ ভারী হইয়া আসিল। সে টেবিলে মাথা রাখিয়া কখন ডুবিয়া গেল গভীর তন্দ্রায়।

অবলার জীবনে আর কেউ সাথ না দিলেও স্বপ্নেরা তাহাকে বড় সাথ দেয়। স্বপনেরা তাহাকে লইয়া যায় শৈশবে, কৈশোরে। আজো তাহার ব্যত্যয় ঘটিল না। অবলা অনেক দূর পথের যাত্রী। সাথে তার বিবেক। ঘন জংগল, উত্তুঙ্গু পাহাড় অতিক্রম করিয়া তাহারা প্রবেশ করিল ভিন্ন এক প্রকৃতির মাঝে। তাহারা বর্তমানকে শত মিলিয়ন বছর পেছনে ফেলিয়া চলিয়া আসিয়াছে ক্রিটেসাস যুগে। ফার্ন সদৃশ অতিকায় গুল্ম, সাইকড, পাইন গাছের বিশাল সারি সেই আদিম পৃথিবীতে দাঁড়াইয়া আছে। আকাশে নাই কোন পাখী। অতিকায় ডাইনোসরেরা পাইন গাছের মাথা ভাঙ্গিয়া গলাধঃকরণ করিতেছে। অবলা শিহরিত হইল। বিবেক তাহাকে অভয় দিয়া বলিল – অবলা ঐ ডাইনোসর তোমার মস্তিষ্কের সৃষ্টি। তোমরা সিনেমায়, কল্পকথায়, বিজ্ঞান কল্পকাহিনীতে মানুষের সাথে ডাইনোসরের সহবস্থান প্রত্যক্ষ করিলেও আসলে মানুষ আসিয়াছে এইতো সেদিন। তোমার মস্তিষ্ক স্থান কালের কথা না ভাবিয়া শুধু তোমার স্মৃতিকোঠায় জমে থাকা ছবিগুলকে বাস্তবের রূপ দিয়াছে।

তাহারা হাটিতে হাটিতে এক বিরাট বৃক্ষ তলে আসিয়া দাঁড়াইল। অদূরে এক ফুলেল বৃক্ষকে দেখিয়া অবলা ওকে কাঠমালতি ভাবিতেই বিবেক তাহাকে শুধরাইয়া দিয়া বলিয়া উঠিল – অবলা কাঠ মালতীর মতো দেখিতে এ গাছটিই কিন্তু ম্যাগ্নোলিয়া যা তুমি আজই বইয়ের পাতায় দেখিয়াছ। জান, এই বৃক্ষ সেই ডাইনোসরের যুগ অতিক্রম করিয়া আজো কালের যাত্রায় প্রায় অপরিবর্তীত হইয়া অনেকের বাগানেই শোভা বর্ধন করিতেছে। ওর কাছেই হয়তো তুমি জানিতে পারিবে আদিম ফুলের কথা, তোমার প্রশ্নের উত্তর…

 

চলবে..


।। সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী ।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,  ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।

 



 


অবলাচরণ – ১ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ২ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৩ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৪ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৫ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৬ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৭ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৮ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

সংবাদটি শেয়ার করুন