ফিচার্ড লেখালেখি

অবলাচরণ – ১ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ১ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

সেই রাতে আষাঢ়ের তমসাঘন আকাশ ভাঙ্গিয়া অবিশ্রাম ধারায় বৃষ্টি ঝরিল। টিনের চালে সেই বৃষ্টির ধারা অবলা চরণের মনের কোনে লুকানো হাজারো কষ্টবোধকে একসাথে জাগাইয়া তুলিল। তার সৌদামনির কথা মনে পড়িল, চোখের সামনে বড় হয়ে যাওয়া সন্তানদের কথা মনে পড়িল, যুদ্ধের সময় পাকসেনাদের হাতে নিহত বাবা-মা ও ছোটভাইটির কথা মনে পড়িল। এক অস্থির আকুতি তার হৃদয়ের একুল হইতে ওকুল পর্যন্ত বিস্তীর্ণ হইল। সন্তানদের ছোট বেলার সেই লালিত্যভরা মুখগুলো কোথা হইতে ভাসিয়া আসিল। দেখিতে দেখিতে পুরানো স্মৃতিগুলো মূর্তিমান হইয়া তাহার সহিত এক আনন্দঘন খেলায় মাতিয়া উঠিল। দরজার অর্গল ধরিয়া সৌদামনিকে নীরবে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া অবলা চরন তাকে কাছে ডাকিল। কিন্তু অবলা চরণের ডাকে সে মোটেই সারা দিল না। অবলা চরণ উচ্চ গলায় ডাকিয়ে উঠিল – সৌদামনি সৌদামনি । মুহূর্তে মনে পড়িল সৌদামনি নাই। সে যে অনন্তলোকে বিলীন হইয়াছে ! বাহিরের থকথকে ঘন অন্ধকার হইতে ব্যাঙের একটানা ঐক্যতান, টিনের চাল হইতে যত্রতত্র চুইয়ে পড়া বৃষ্টির জল তাহাকে জানান দিল – তাহার কেহ নাই, সে একা। অবলা চরণ জামার আস্তিন দিয়া নিরবে চোখ মুছিল।

তাহার ইদানীং কি যেন কি হইয়াছে। সামান্য স্মৃতিরা তাহাকে লইয়া নিষ্ঠুর খেলা করে। খুচাইয়া খুচাইয়া কষ্টগুলোকে জাগাইয়া তোলে, চোখের পাতাকে ভিজাইয়া তোলে নোনতা জলে। আজ হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর সাথে তাহার নিত্য দেখা হয়, কথা হয়। অথচ এই অবলাচরণ একসময় কতো দৃঢ় চিত্তের মানুষ ছিলেন। স্ত্রীর বিয়োগের পর তিন সন্তানকে সে মায়ের আদরে আগলে রাখিয়াছে। মেয়েটাকে পড়ালেখা শিখাইয়া একটা ভালো ছেলের হাতে পাত্রস্থ করিয়াছে। দুই ছেলেকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করিতে এতোটুকু কসুর করে নাই। সন্তানেরা নিজেদের জীবন লইয়া অন্যত্র স্থিত হইয়াছে। তাহারা তাহাকে কাছে রাখিবার জন্য চেষ্টাও করিয়াছে, কিন্তু স্বাধীনচেতা অবলা চরণকে পিতৃ পুরুষের ভিটা হইতে কেহই সরাইতে পারে নাই।

আস্তে আস্তে রাত্রি বাড়িয়া চলিল। বৃষ্টির বেগ আরও প্রবল হইতে লাগিল। বিরাট খাটের এক কোনে সে জড়সড় হইয়া কাপিতে লাগিল। তীব্র জলতেষ্টায় তার গলা শুঁকাইয়া গেল। তার আজ এক গ্লাস জল বাড়িয়া দিবার কেউ নাই। একটা সর্বগ্রাসী একাকীত্ববোধ তাকে গ্রাস করিবার জন্য চারিদিক হইতে ছুটিয়া আসিল। অবলাচরণ একাকীত্বকে বড় বেশী ভয় করে। একাকীত্ব হইতে বাঁচিবার জন্য বিস্তীর্ণ আঙ্গিনায় সে নিজহাতে রোপণ করিয়াছে অসংখ্য বৃক্ষলতা। তাহাদের সাথে কথা বলিয়া, তাহাদের পরিচর্যা করিয়া সে তাহার জীবনকে ব্যস্ততায় ভরিয়া রাখে। সময় গুলোকে ধরিয়া রাখিবার জন্য সে বৈঠকখানাতে নতুন চেয়ার টেবিল বসাইয়াছে, আর সাথে নতুন আলমিরা। আলমিরাতে থরে থরে বই। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের পাশাপাশি আরাজ আলী, হুমায়ুন আজাদ, বদরুদ্দীন ওমর সহ আরও কতো দেশ বিদেশের বই। হাতে সময় কম; সে গোগ্রাসে গিলিতে চায় সবটুকু। পড়িতে পড়িতে, জানিতে জানিতে তাহার মনমাঝে অনেক কথা ঘুরিয়া বেড়ায় । সে আকুপাকু করে সেই কথা গুলোকে কবিতার ছন্দে, কাব্যের সাঁচে বাধিয়া ফেলিতে। শব্দেরা সহসা ধরা দেয়না। তবুও সে তাহার কম্পিউটার লইয়া বসিয়া থাকে। সে স্বপ্ন দেখে একদিন সে খুব ভাল লিখিবে, ফেসবুকে সেই লেখা পড়িয়া সবাই তার জীবনবোধ, প্রজ্ঞা,ও জ্ঞানের গভীরতায় মুগ্ধ হইয়া কতো কিছু মন্তব্য করিবে। সারাদিনময় সেই মন্তব্যগুলো সে বারবার পড়িবে, উজ্জীবিত হইবে, অনুপ্রাণিত হইবে, ভালোলাগার অতলান্ত গভীরে ডুবিয়া যাইবে।

অনেক কষ্টে যৌবনের লাজুক প্রকৃতির অবলা চরণ তাহার খোলসের বাহিরে আসিয়া দাড়াইয়াছে। কৈশোর যৌবনের অপ্রকাশিত কবিতাগুচ্ছ, এলোমেলো লেখাগুলোকে ঘষিয়া মাজিয়া পড়িবার মতো সে রূপ দিয়াছে। নিজের লেখা সে নিজেই বারংবার পড়ে। আপ্লূত হয় এই ভাবিয়া – সে পারিয়াছে।

দুরুদুরু বক্ষে ফেসবুকের পাতায় প্রকাশ করে তার লেখাগুলো, তার অব্যক্ত কথাগুলো। সে লেখা দু’একজনের মনে নাড়া দেয়। তাহারা দয়াপরবশ হইয়া তাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়, কেউ লেখা পড়িয়া তার বানান ভুল ধরে। অবলা চরণ চাহিয়া থাকে তার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধবের প্রতি। যাহাদের সাথে তাহার নিত্য দেখা হয়, নিত্য কথা হয় তাহারা তাহার লেখা লইয়া উচ্চ বাচ্য করে না। ছেলে-মেয়েরা তাহাদের জায়াদের সাজাইয়া গুছাইয়া ছবি তোলে, সে ছবি ভাইরাল হয়; অথচ তাহাদের বাবার লেখাকে তাহারা উপেক্ষা করে। আত্মীয়স্বজনের এহেন নির্মম উপেক্ষায় সে ব্যথিত হয়। আস্তে আস্তে সেই কষ্টবোধ তাহার মনোজগতকে আচ্ছন্ন করে। যাহারা তাহাকে উপেক্ষা করে, তাহাদের প্রতি ভালবাসা, স্নেহ, মায়ামমতা আস্তে আস্তে উবিয়া যায়। সারা পৃথিবীকে তার পর মনে হয়। মানুষের মনোজগতের নিগুঢ় রহস্য বুঝিতে না পারিয়া সে নিমজ্জিত হয় হতাশার গভীরে। তাহার মনোজগতের ব্যথা তাহার মন হইতে শরীরে আসিয়া ভর করে। ব্যক্তি জীবনে অত্যন্ত মার্জিত ও সৎবচ্ছল মানুষটি ভালবাসার অভাবে, আস্তে আস্তে খিটখিটে এক মানুষে রূপান্তরিত হয়।

তাহার এ পরিবর্তনে ব্যথিত হইয়া তাহার কিছু বন্ধু-বান্ধব তাহাকে ভুলাইয়া ভালাইয়া পাগলের ডাক্তারের কাছে লইয়া যায়। ডাক্তার কতিপয় প্রশ্ন করিয়া সিদ্ধান্তে উপনীত হন – তাহাকে সর্বনাশা হতাশা রোগ -ফ্যাড (Facebook Addiction. Disorder) ধরিয়াছে। আত্মীয়-স্বজন বন্ধু বান্ধব নতুন রোগ ফ্যাডের কথা শুনিয়া দমকে দমকে হাসিয়া উঠে। বন্ধু-বান্ধব এই লইয়া তামাসা করিয়া বৈকালিক ভ্রমণটাকে মধুময় করিয়া তোলে। ছেলে-মেয়ে বাপের এমন দুর্মতি দেখিয়া লজ্জায় মুখ লুকায়। কিন্তু কেহই তাহার মনোব্যথার কারণ জানিতে চাহে না। সে যে তাহার সৃষ্টিকে মানুষের মাঝে বিলাইয়া দিতে চাহিয়াছিল, সে যে বলিতে চাহিয়াছিল আমায় তোমাদের একজন করিয়া লও। ‘আমায় নহে গো ভালোবাস শুধু ভালোবাসো মোর গান’ – তার এই অভিমান ভরা আকুতি পৌঁছে না কারোর কাছে … চলবে

।। সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী ।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,  ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।



সংবাদটি শেয়ার করুন