ফিচার্ড লেখালেখি

অবলাচরণ – ৭ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

পর্ব প্রকাশের পর….

অবলাচরণ – ৭ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

মনের মাঝে উদীত প্রশ্নগুলোর উত্তর পাইতে তাহার মন চঞ্চল হইয়া উঠিল। অবলা কাল বিলম্ব না করিয়া বাড়ির পথে পা বাড়াইল। কিন্তু কে যেন তাহাকে রাস্তার মাঝে টানিয়া ধরিল। অবলার চরিত্রে এই এক দোষ – একবার মনে কোন প্রশ্ন উদীত হইলে সে তাহার তৎক্ষণাৎ উত্তর পাইতে চায়, মনে কোন প্রত্যাশা জাগিয়া উঠিলে তৎক্ষণাৎ তাহা পাইবার জন্য সে অধীর হইয়া পড়ে। অথচ সে মনোবিজ্ঞানের বই পড়িয়া কতকিছুই না জানিয়াছে – কেহ তাহাকে গাল মন্দ করিলে সে তৎক্ষণাৎ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করিয়া সময় নেবে। প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করিবার পূর্বে বুক ভরিয়া নেবে এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস। এই দীর্ঘ নিঃশ্বাস তার মস্তিষ্কে অধিক অক্সিজেন জোগান দেবে আর ফ্রন্টাল-লোব তাহার স্মৃতির ভাণ্ডার ঘাঁটিয়া, কার্য-কারণ সম্পর্কের প্যাটার্ন বিশ্লেষণ করিয়া একটা যৌক্তিক উপসংহারে উপনীত হইবে। কিন্তু, বাস্তব জীবনে সে তাহা সহসা প্রয়োগ করিতে পারে না। সে মানুষের সাথে দুর্ব্যবহার করিয়া বসে। ক্রোধ অবদমিত হইলে সে ব্যথিত হয় তাহার অমার্জনীয় আচরণে।

অবলা এবারও হারিয়া গেল। বাড়িতে না যাইয়া রাস্তার অদূরে এক বৃক্ষতলে সে বসিয়া পড়িল। তাহার যে দেখিতেই হইবে যাহাদের সে বন্ধু ভাবিয়া নির্বিচারে ফেসবুকের কোঁটা পূরণ করিয়াছে কি তাহাদের পরিচয়? অবলা একে একে বাহির করিতে লাগিল তাহাদের প্রোফাইল। চোখ বুলাইতে যাইয়া সে নিজকে অত্যন্ত অসহায় বোধ করিতে লাগিল। তাহার বন্ধুরা সমস্ত বাতায়ন বন্ধ করিয়া দিয়া তাহাকে বন্ধুত্বের আহবান জানাইয়াছে আর সে নির্বিচারে সেই আমন্ত্রণও গ্রহণ করিয়াছে । সে তাহার কৃতকর্মে নিজকে ক্রমাগত দোষারোপ করিতে লাগিল। তাহার কৃতকর্মের সাথে তাহারই নামের কাকতালীয় সম্পর্ক অনুধাবন করিতে পারিয়া নিজের উপর তাহার ভীষণ অভিমান হইলো। সে ক্রোধান্বিত হইয়া তাহার বন্ধু-লিস্টি হইতে সন্দেহ ভাজন বন্ধুদের বিতাড়িত করিয়া মনে এক গভীর প্রশান্তি বোধ করিতে লাগিল।

কিন্তু তাহার মনের এই উচ্ছ্বাস দীর্ঘস্থায়ী হইলো না। কেন যেন তাহার মনের মাঝে এক বিচ্ছেদের বেদনাবোধ জাগিয়া উঠিল। বিকেলের মায়াময় আকাশ দিগন্তে ঝুলিয়া পড়িয়াছে। চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছে ঘন আবিরের রঙ। অবলা সেই দিগন্তের পানে চাহিয়া বেলাশেষে ঘরে ফেরার টান অনুভব করিল। হঠাৎ চৈত্রের হাহাকার করা শুকনো প্রান্তর হইতে এক ঘূর্ণায়মান বায়ুকুরানী সশব্দে তাহার গা ঘেঁষিয়া চলিয়া গেল। অজানা ত্রাসে কাকেরা কা কা করিয়া আকাশে উড়িয়া গেল। বৃক্ষ হইতে ঝড়িয়া পড়িল শুকানো পাতার ফুলঝুরি। অবলা সেই শুকানো পাতার মাঝে দেখিতে পাইল অসংখ্য রঙ্গের উদ্বাহু নৃত্য। বায়ুকুরানী তাহার জন্যে কোথা হইতে কুড়াইয়া আনিয়াছে বিচিত্র বর্ণের পুস্প-পত্রের সম্ভার। সেই কুড়াইয়া আনা স্তূপের মাঝে উজ্জ্বল দ্যুতি ছড়াইয়া রাখিয়াছে কিছু পলাশের ফুল। পলাশের কমলা রঙে মুহূর্তে আলোকিত হইল অবলার মন। তাহার দেহ মনে ছড়াইয়া পড়িল এক উচ্ছ্বল আনন্দবোধ, এক অনির্বচনীয় অনুভূতি। অবলা হাত বাড়াইয়া কুড়াইয়া লইল সেই আনন্দকে।

সেই আনন্দের অংশ হইয়া বিবেক মৃদু হাসিয়া অবলাকে বলিল, অবলা বায়ুকুরানী তোমার জন্য বৃক্ষের পদমূল হইতে যে পুষ্প পত্র কুড়াইয়া আনিয়া তোমার পায়ে অর্পণ করিল, তাহার মাঝ হইতে তুমি শুধু ফুলটাই তুলিয়া লইলে। আলোড়িত হইলে, পুলকিত হইলে এক গভীর আনন্দ রসে। কক্ষনো কি ভাবিয়া দেখিয়াছ প্রকৃতি কিন্তু কারুকেই পরিত্যাগ করেনাই। একদা ভুল করিয়া তুমি যাহাদের বন্ধু ভাবিয়াছিলে, আজ ক্রোধের বশবর্তী হইয়া তুমি তাহাদের সম্পর্ক ত্যাগ করিলে – তাহার কি খুব প্রয়োজন ছিল? যাহাদের তুমি ভুল বশত: গ্রহণ করিয়াছ, তাহারাই কিন্তু তোমায় আর দশজন হইতে আলাদা হইবার সুযোগ করিয়া দিয়াছে। তুমি যে চিন্তা চেতনায় তাহাদের চেয়ে ভিন্ন, তাহারা না থাকিলে তুমি তা বুঝিতেই পারিতে না। সংসারে থাকিতে হইলে পঙ্কিলতা নিয়ে অতো বাড়াবাড়ি করিতে হয় না। তুমি তোমার বিবেককে জাগ্রত কর। যা কিছু ভাল তা গ্রহণ কর, খারাপকে পরিত্যাগ কর । পঙ্কে বাস করিয়া যদি গায়ে তোমার পঙ্ক না লাগে – তাহা হইলেই তো তোমার মানব জীবন সার্থক। আজ যাহাদের তুমি ব্রাত্য মনে করিতেছ, হয়তো তোমার সংস্পর্শে ওরা একদিন পঙ্কিলতাকে ঝাড়িয়া ফেলিয়া পদ্মফুলের মতো প্রস্ফুটিত হইবে। গাছের সাথে আগাছা থাকিবেই। আগাছাকে নয় বরং পরগাছাকে এড়াইয়া চলিও। আগাছাকে কাটিয়া ফেলা যায় কিন্তু পরগাছাকে কাটিতে গেলে তোমারি ক্ষতি হইবে।

একজন সাধারণ মানুষ হইয়া বিবেকের এমন কঠিন কঠিন কথা শুনিবার ধৈর্য সে হারাইয়া ফেলিল। পলাশের সুদৃশ্য ফুলটাকে পরম যত্নে হাতে লইয়া সে পথ চলিতে লাগিল। পথে অনেকের সাথে দেখা হইলো। অনেকেই ফুলটির দিকে প্রসন্ন চিত্তে তাকাইয়া রইল – যেন কোনদিন এমন ফুল দেখেই নাই। অবলার মনে এক নতুন ভাবনার উদ্রেক হইলো – আচ্ছা, মানুষ ফুলকে কেন এতো ভালবাসে? মহার্ঘ নয় জানিয়াও কেন মানুষ একে অন্যকে ফুল উপহার দেয়? কেন পুস্পদর্শনে মনের সমস্ত বিষাদ অন্তর্হিত হইয়া মনে ছড়াইয়া পড়ে এক অনাবিল প্রশান্তি? ফুল কেমন করিয়া মানব মস্তিষ্ককে আলোড়িত করিয়া ডোপামিন, সেরোটোনিনের মতো নিউরো-কেমিক্যালে প্লাবিত করিয়া দেহমনে ভরিয়া দেয় অনাবিল সুখানন্দ ! তাহাকে সবকিছু জানিতে হইবে। সবকিছু। জানার অদম্য স্পৃহা তাহাকে তাড়িত করে। অবলা হন হন করিয়া হাঁটিয়া চলে বাড়ির পথে ..

চলবে..


।। সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী ।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,  ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।

 



 


অবলাচরণ – ১ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ২ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৩ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৪ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৫ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৬ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

সংবাদটি শেয়ার করুন