ফিচার্ড লেখালেখি

অবলাচরণ – ৩ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ-৫

অবলাচরণ – ৩ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

পূর্ব প্রকাশের পর…

বিশাল লিস্টির মাঝে অবলা চরণ কোনটি আগে কোনটি পরে বলিবে ভাবিয়া কুল পাইলো না। সমস্ত ঘরটি তার স্মৃতির জাদুঘর। সৌদামনির স্মৃতি, সন্তানদের স্মৃতি, বাবা-মার স্মৃতি। দুখ জাগানিয়া স্মৃতিগুলো কেহ আলমিরায় হাঙ্গারে ঝুলিয়া থাকে, কেহ দেওয়ালে ঝুলিয়া থাকে, কেহ একাকী ঘরের শূন্যতার মাঝে ফিসফিস করিয়া কথা বলে। অবলা চরণ সৌদামনির পরনের কাপড়ের দিকে এক নজর তাকাইয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিল। অদূরে চোখে পড়িল হাঙ্গারে ঝুলিয়া থাকা তাহার চাকুরী জীবনের স্যুট-প্যান্ট । মনে পড়িল তাহার চাকুরী জীবনের কথা। সে কক্ষনো জীবিকার জন্য চাকুরী করে নাই। অফিসের কর্মচারীদের আপদে বিপদে সে অকাতরে আগাইয়া যাইত। সবাই তাহাকে যথেষ্ট সম্মানও করিত। সম্মান পাইতে পাইতে তাহার একটা নেশা পাইয়া বসিয়াছিল। তাহার মনে হইতো হয়তো তাহার সারাটা জীবন এমনি করিয়াই কাটিয়া যাইবে। আস্তে আস্তে চাকুরী জীবনের শেষ মুহূর্ত ঘনাইয়া আসিল। একদিন সে আকণ্ঠ ফুলের মালায় ডুবিয়া হাতে পুষ্পস্তবক ও অসংখ্য মানুষের ভালবাসার অশ্রুজলে শিক্ত হইয়া নিরুদ্বিগ্ন জীবন যাপনের জন্য বাড়ি ফিরিল।

দুই একটা দিন বাসায় শুইয়া বসিয়া কাটিয়া গেল। তাহার পর তাহার আর সময় কাটে না । মাঝে মাঝে সে অফিসে যাইয়া পূরানো সহকর্মীদের সাথে গাল গল্প করিয়া সময় কাটায়। হঠাৎ সে লক্ষ্য করে আগে যাহারা তাহাকে দেখিয়া আদাব দিত, তাহারা তাহাকে উপেক্ষা করিতেছে, তাহার সহকর্মীদের আচরণে আর আগের মতো উত্তাপ নাই। তাহাদের নিরুত্তাপ আচরণ, উপেক্ষায় অবলা চরণ নিজকে অত্যন্ত অপ্রয়োজনীয় বোধ করিল। একদিন অফিসের পথে যাত্রা করিয়া উৎসাহ না পাইয়া মাঝ পথে ঘরে ফিরিয়া আসিল। খাটে শুইয়া উদাস হইয়া জানালা দিয়া দূর আকাসের পানে তাকাইয়া থাকিল।

বিবেক তাহার অতীতের স্মৃতি রোমন্থনের মাঝে এক গভীর হতাশার ছাপ অবলোকন করিয়া অবলাকে প্রশ্ন করিল – অবলা তুমি যে একদিন চাকুরী হইতে অবসর গ্রহণ করিবে তাহার কি পূর্ব প্রস্তুতি তোমার ছিল? অবলা নিরুত্তর রহিল। বিবেক প্রজ্ঞাবান ব্যক্তির মতো তাহাকে বলিল – অবলা সেদিন যাহারা কারণে অকারণে কুর্নিস করিত, আর আজ যাহারা তোমায় উপেক্ষা করে তাহারা কিন্তু এক মানুষ নয়। তাহারা সবাই সময়ের সৃষ্টি, প্রয়োজনের সৃষ্টি। আজ তোমার প্রয়োজন ফুরাইয়াছে। ফলদ বৃক্ষ যখন ফল দেওয়া বন্ধ করিয়া দেয় – মানুষ তাহাকে কাটিয়া ফেলে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। তুমি নিছক ভাবাবেগে কষ্ট পাইয়াছ, তুমি নিজকে অত্যন্ত সস্তা করিয়া দিয়া নিজের কষ্টকে বিকশিত করিবার ক্ষেত্র তৈরি করিয়াছ। অবলা, মনে রাখিও পরকে আপন করিতে যাইয়া নিজে তাহাতে বিলীন হইয়া যাইও না। একটু দূরত্ব রাখিও। অবলা চরণ বিবেকের এই কথাগুলো কোথাও পড়িয়াছে। আজ সেই কথা তাহার নিজের জীবনে খাটিবে ভাবিয়া সে ক্ষণকাল নিঃচুপ থাকিল।

অবলা চরণ জন্মসূত্রে তার বিশাল পৈতৃক বাড়ির একমাত্র অংশীদার। অভাব তাহাকে তেমন স্পর্শ করে নাই। অর্থনৈতিক ভাবে সচ্ছল অবলা চরণ অবসর জীবনে কারোর মুখাপেক্ষী হইতে চায় নাই। চাকুরী হইতে অবসর লইয়া একবার সে ভাবিয়াছিল কিছুদিন সন্তানদের কাছে গিয়া থাকিবে। চেষ্টাও করিয়াছিল কিন্তু থাকিতে পারে নাই। বিবেক তাহাকে প্রশ্ন করিল – ছেলের সাথে কি হইল যে তোমাকে বাড়ি ফিরিয়া আসিতে হইলো? তুমি দুঃখ পাইয়া চলিয়া আসিলে; মনে মনে বলিলে – ছেলে বদলে গিয়াছে। সব দোষ ছেলের ঘাড়ে, পুত্রবধূর ঘাড়ে চাপাইয়া তুমি শুধু দুঃখগুলো লইয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিলে। একবার কি তুমি নিজেকে ছেলের জায়গায় দাড় করাইয়া প্রশ্ন করিয়াছ ?

অবলা চরণ আবারও ফিরে গেল সেই অতীতে। বড় ছেলের ঘরে এক ফুটফুটে কন্যা সন্তান আসিয়াছে। অবলা চরণ তাহাকে কাছে পাইয়া সৌদামনির মৃত্যুশোক ভুলিয়া গেল। তাহাকে প্রতি মুহূর্তে কাছে রাখিবার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা দেখা দিল তাহার মাঝে। সে আস্তে আস্তে সন্তানের সংসারে সর্বত্র অনাহুত ঢুকিয়া পড়িল। সন্তানের সাধ, আহ্লাদ বলিতে কিছুই রহিল না। ছেলে যে তাহার বড় হইয়াছে, তাহার নিজের এক সংসার হইয়াছে তাহা সে ভুলিয়া গেল। তাহার স্নেহ ভালবাসা সন্তানের কাছে আস্তে আস্তে গলার কাঁটার মতো মনে হইলো। পুত্রবধূর অপটু রান্নাকে সৌদামনির সাথে তুলনা করিয়া, তাহার প্রতি যথেষ্ট সেবা যত্নের অভাব ইত্যাদি অভিযোগ ছেলেকে শুনাইতে শুনাইতে অবলা চরণ পুত্র ও পুত্রবধূ হইতে অনেক দূরে চলিয়া গেল। একদিন পুত্র করজোড়ে তাহাকে তাহাদের সংসার ছাড়িয়া যাইতে প্রার্থনা করিল। অবলা চরণ সেই যে তাহাদের ঘর ছাড়িল আর ঐ মুখ হইলো না।

আজ বিবেকের মুখোমুখি হইয়া তাহার মনে হইলো সে অনেক ভুল করিয়াছে। ছেলে তাহার প্রতি যে ব্যবহার করিয়াছে তাহাতে যে তাহারও যে ভূমিকা ছিল – এইকথা ভাবিয়া সে নিজে লজ্জিত হইলো। এক মুহূর্তে মনে হইলো সে ছেলের সাথে কথা বলিবে, পুত্রবধূকে মেয়ের মতো কাছে টানিয়া লইবে। পর মুহূর্তে তাহার রক্তের মাঝে পরম্পরা হইতে প্রাপ্ত পিতৃত্বের এক মিথ্যা অহমবোধ ও অভিমান জাগিয়া উঠিল। বিবেক তাহার পানে চাহিয়া বলিল – অবলা তুমি যে কষ্ট পাইয়াছ তাহা কিন্তু কেহই তোমাকে দেয় নাই , তুমি তাহার অনেকটাই নিজের আচরণ দিয়া, নিজের অহম, নিজের সংকীর্ণ চিন্তাধারার মাঝে অর্জন করিয়াছ। দিনে দিনে ছোট ছোট কষ্টগুলো জমা হইতে হইতে মহীরুহ হইয়া তোমার চিত্তে গভীর হতাশার জন্ম দিয়াছে – তুমি কি তাহা স্বীকার কর? অবলা চরণ নীরবে মাথা ঝাঁকাইয়া খাতায় তাহা লিখিয়া রাখিল …।


।। সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী ।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,  ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।


অবলাচরণ – ১ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ২ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার



 

সংবাদটি শেয়ার করুন