ফিচার্ড লেখালেখি

অবলাচরণ – ২ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ-৫

অবলাচরণ – ২ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

পূর্ব প্রকাশের পর…

রাত্রির শেষ প্রহরে অবলা চরণের চোখ ভাঙ্গিয়া ঘুম নামিল। অবলা চরণ ঘুমে আচ্ছন্ন হইতেই কোথা হইতে স্বপ্নেরা তাহাকে ঘিরিয়া ধরিল। আসন্ন সন্ধ্যায় যমুনার তীরে বন্ধুদের সাথে সে দাঁড়াইয়া আছে। কি একটা কথা বলিবে বলিয়া মুখ খুলিতেই তাহার দুইপাটী হইতে ঝুরঝুর করিয়া সমস্ত দাঁতগুলো ঝড়িয়া পড়িল। বন্ধুরা তাহাকে দেখিবা মাত্র অট্টহাসিতে ভাঙ্গিয়া পড়িল। অপমানিত অভিমানী অবলা চরণ তাহার ভয়াবহ কুৎসিত চেহারার দিকে এক নজর তাকিয়েই দৌড়াইতে লাগিল। তাহার পিছনে সঙ্গ নিলো একদল শিশু কিশোর। অবলা চরণ ওদের পেছনে পেছনে আসার কোন কারণ বুঝিতে পারিল না। সে ক্ষণকাল থামিয়া নিজের দিকে তাকাইতেই শিহরিয়া উঠিল। তাহারা পরনে কিছুই নাই। শঙ্কিত অবলা চরণ ধড়পড় করিয়া ঘুম হইতে জাগিয়া উঠিল।

যেদিন ডাক্তার তাহার ভিতর ফ্যাডের মতো এক অদ্ভুত রোগের সন্ধান পাইল, তাহার পর হইতেই তাহার ঘুমের পরিমাণ আরো কমিতে লাগিল। অদ্ভুত অদ্ভুত স্বপ্নেরা যেন উৎ পাতিয়া থাকে তাহার ঘুমের অপেক্ষায়। স্বপ্নের মাঝে দাঁত পড়িয়া যাওয়া, নগ্ন হইয়া রাস্তায় দৌড়ানো এ সবই যে নিরাপত্তাহীনতা, ক্ষয়িষ্ণু আত্মসম্মানবোধের বহিঃপ্রকাশ তাহা সে পেনি পার্সের লেখা ড্রিম ডিকশনারি ফর ডামিসে পড়িয়াছে; তাহার দুর্বল চিত্ত তাহা গ্রহণ করিয়াও লইয়াছে। পড়িতে পড়িতে তাহার অবচেতন মন সেই তথ্য হিপোকাম্পাসে বিশেষ ভাবে সংরক্ষণ করিয়াছে। আজকের স্বপ্ন যে ঐ সব আবোল তাবোল বই পড়ারই প্রতিক্রিয়া তাহা ভাবিতেই সে টেবিলের উপর রাখা পেনির বইটি ছিঁড়িয়া আস্তুকুরে ফেলিয়া দিল। সে কেন যে এমন ধরনের বই পড়িয়া তাহার সময় নষ্ট করিয়াছে ভাবিয়া অনুতপ্ত হইল।

প্রত্যুষের হাল্কা আলো তাহার জানালা চুইয়া গৃহ মাঝে প্রবেশ করিয়াছে। অবলা চরণ জানালা খুলিতেই হুরমুর করিয়া সে আলো ঢুকিয়া পড়িল। গতকালের বর্ষণক্লান্ত আকাশের মেঘমালাগুলো কোথায় যেন বিলীন হইয়াছে। রৌদ্রোজ্জ্বল সকালের হাল্কা একটা বাতাস তাহাকে ছুঁইয়া গেল। তাহার মনটা অনির্বচনীয় আনন্দে নাচিয়া উঠিল। সে যে ফ্যাডে আক্রান্ত, আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব অনেক বুঝানোর পরও সে তাহা মানিয়া লইতে পারে নাই । প্রত্যুষের এই মন ভাল করা বাতাবরণের মাঝে সে মনে মনে ভাবিল আজ সে নিজকেই নিজে প্রশ্ন করিবে – অবলা চরণ তুমি কি সত্যই ফ্যাডাক্রান্ত?

অবলা চরণ খাতা কলম লইয়া চেয়ারে বসিল। তাহার পড়ার টেবিলের অপর প্রান্তে তাহার বিবেক গম্ভীর হইয়া বসিয়া থাকে। বিবেক তাহাকে প্রশ্ন করিল – তোমার নাম? অবলা চরণ ক্ষীণ কণ্ঠে অনেকটা সময় লইয়া বলিল – অবলা …চরণ। বিবেক তাহার দ্বিধান্বিত উত্তরে তাহাকে প্রশ্ন করিল – অবলা তুমি কি তোমার নামটি লইয়া সন্তুষ্ট নও? অবলা চরণ ব্যথিত, লজ্জিত এক বালকের ন্যায় মাথা ঝাঁকাইল। সে তাহার মনকে অনেক প্রশ্ন করিয়াছে – কেন তাহার পিতা-মাতা এমন এক নাম রাখিল যা শুনিলেই একটা হাবা, জড় বুদ্ধি সম্পূর্ণ, অবনত মস্তক এক অসহায় মানুষের কথা মনে হয় ! নামের মাঝে লুকায়িত অসহায়তা এবং বিদ্রূপ তাহার সারাটা জীবনের উপর এক কালো ছায়া বিস্তার করিয়াছে। তাহার এই নাম তাহার আত্মসম্মানবোধ, তাহার আত্মবিশ্বাসকে নড়বড়ে করিয়া দিয়াছে। বিবেক দুঃখিত হইয়া তাহার পক্ষ লইল। অবলা চরণ মৃত পিতা-মাতাকে কাঠগড়ায় দাড় করাইয়া তাহার নামের পাশে লাল কালিতে ক্রস চিহ্ন আঁকিয়া দিল।

এইবার বিবেক সেই মনঃচিকিৎসকের মতো প্রশ্ন করিল, অবলা তুমি কি আগামী সাতদিনের জন্য ফেসবুককে ত্যাগ করিতে পারিবে? অবলা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল – কেন পারিব না? বেশ পারিব। বিবেক আবারও তাকে একি প্রশ্ন করিল। অবলা চরণ কাচু মাচু হইয়া বলিল, না, আমি পারিব না। আমি আগেও অনেক বার চেষ্টা করিয়াছি, পারি নাই। এবার বিবেক স্মিত হাস্যে তাহাকে বলিল – লিখিয়া রাখ। অবলা চরণ খাতায় তাহা লিখিয়া রাখিল। বিবেক তাহাকে স্মরণ করাইয়া দিল একজন মানুষ যখন দিনে ২-৩ ঘণ্টার উপর ফেসবুকের মতো কোন সামাজিক মাধ্যমে সময় ব্যয় করে তখন তাহার ভিতর আসক্তি জন্ম নেয়। আর সে আসক্তি হইতে প্রত্যাশা, আর প্রত্যাশা হইতে অপ্রাপ্তি, দুঃখ আর হতাশা জন্ম নেয়। তা তুমি কতো ঘণ্টা সময় ব্যয় কর? অবলা চরণ হাতের আঙ্গুলে গুনিয়া দেখিল – ঠিক পরিমাপ করিতে পারিল না। বিবেককে বলিল তেমন সময় নয় – এই সকালে ঘুম হইতে উঠিয়া, দুপরে খাবার টেবিলে, সন্ধ্যার আগে ও পরে আর রাত্রে ঘুমাইতে যাইবার আগে, আর যখন ফোন ডিঙ করিয়া বাজিয়া ওঠে তখন, আর আর যখন মন খারাপ থাকে…। বিবেক প্রশ্ন করিল – তা তোমার মন কিসে খারাপ হয়? মন খারাপের কথা বলিতে যাইয়া অবলা চরণের চোখ অশ্রুতেতে ছাইয়া গেল। জীবন সায়াহ্নে দাঁড়াইয়া অভিমানী অবলা চরণ মন খারাপের এ বিরাট লিস্টি লইয়া বিবেকের সামনে উপস্থিত হইলো … চলবে

 

।। সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী ।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,  ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।



সংবাদটি শেয়ার করুন