ফিচার্ড লেখালেখি

অবলাচরণ – ৪ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৪ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলা, তুমি কি জান- দুঃখ কি? কেন আমরা কষ্ট পাই? তোমরা অনেকেই এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিবে না। এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে যে যাইতে হইবে অনেক গভীরে-অন্তহীন গভীরে। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজিয়া পাইবার জন্যই তো গৌতম ঘর ছাড়িয়াছিলেন। তাহার পিতা রাজা শুদ্ধোধন তাহার ছেলে ঘর ছাড়িবে আশঙ্কা করিয়া তাহাকে সংসারের আপাত সুখে বাধিয়া রাখিতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু তিনি পারেননি। গৌতম যখন ঘরের বাহির হইলেন, জীবের দুঃখ, কষ্ট, দুর্দশা নিজের গায়ে মাখিয়া লইলেন তখন তাহার সামনে জগত খুলিয়া গেল। দুখের মাঝে তিনি খুঁজিয়া পাইলেন মুক্তির পথ। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর অর্জুন দুখী হইয়াছিলেন তাহারি আপন জনের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলিতে যাইয়া। শ্রীকৃষ্ণ তাহাকে দান করিয়াছিলেন দুঃখ নির্বাপণের জ্ঞান, সৃষ্টি হইয়াছিল মহান জ্ঞানের গ্রন্থ – গীতা।

অবলা, একবার ভাবিয়া দেখ দুঃখ আছে বলিয়াই কিন্তু জীবন এত রঙ্গিন, এতো বিচিত্র, এত সুন্দর। মানুষ দুঃখ পাইয়া, কষ্ট পাইয়া ভাঙিয়া পড়ে, উঠিয়া দাঁড়ায়, আবারও চলিতে শুরু করে। চলিতে চলিতে চড়াই উৎরাই পাড়ি দিয়া যখন সে উত্তুঙ্গু পর্বতের শিখরে আরোহণ করে, নীচে তাকাইয়া দেখে বহতা নদী, দূরে তাহারি পাড়ি দেওয়া ক্লান্তিকর পথের ধূসর চিহ্ন, তখন সে সমস্ত বেদনা ভুলিয়া যায়, মনে আসে দৃঢ় আত্মবিশ্বাস, উদ্বাহু মিলিয়া সে বলিতে পারে – আমি পারিয়াছি, আমি আপনাকে আবিষ্কার করিতে পারিয়াছি। তাই দুঃখকে শত্রু ভাবিও না। দুঃখের নির্যাস হইতেই সুখের সৃষ্টি। তাহাকে আলিঙ্গন কর, তাহাকে স্বীকার কর। তোমারা দুঃখকে আলিঙ্গন না করিয়া তাহাকে ভুলিয়া যাইতে চাও। এক দুঃখকে ভুলিতে যাইতে আরেক দুঃখকে আহ্বান কর। মনে রাখিও দুঃখ অজ্ঞানতার ফসল। তাহাকে ভুলিতে যাবার একমাত্র পথ হইল জ্ঞানার্জন – দুঃখকে জানা, দুঃখকে চেনা। বড় বড় মনীষীদের জীবনকে খুব কাছ হইতে দেখিলেই তুমি তাহা বুঝিতে পারিবে।

অবলা নিজকে অসহায় ভাবিয়া ক্ষণকাল নিরুত্তর থাকিল। বিবেকের দর্শনের সাথে এক হইতে যাইয়া তাহার মনে দ্বিধার সৃষ্টি হইলো। মনের অন্দরে কে যেন বলিয়া উঠিল – যতো সব বড় বড় কথা ! এসব কথা বই পুস্তকেই মানায়…। বড় বড় লোকের কথা মনে আসিতেই সে শুধু তাহাদের অন্ধকার দিকটাই দেখিতে পাইল। কবিবর নির্মলেন্দু গুনের কবিতার কথা মনে হইল – তিনি যখন লেখেন –

আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে , আমি চাই

কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করুক,

শুধু ঘরের ভেতর থেকে দরজা খুলে দেবার জন্য ।

বাইরে থেকে দরজা খুলতে খুলতে আমি এখন ক্লান্ত ।

অবলা কবিতার এ স্তবকের মাঝে সত্যকে খুঁজিয়া পাইতে চেষ্টা করে। তাহার মন বলে কবি যেন তাহারী মতো বলিতে চাহিয়াছেন – আমায় ভালবাস। গভীর আকুতিতে তিনি ভালবাসাহীন জগতের মাঝে একজন ভালবাসার মানুষকে খুঁজিয়া বেড়ান, যে ভেতর হইতে তাহার জন্য দ্বার খুলিয়া দেবে। অবলার মন বলে উঠে কবি যেন দুঃখকে স্বীকার করিতে ভয় পাহিয়াছেন – যাহাতে তিনি দশ জনের মাঝে একজন না হইয়া যান। বিবেক তাহার দ্বিধান্বিত চিত্তের মাঝে অঙ্কুরিত সন্দেহের ঘোর অন্ধকার অবলোকন করিয়া অবলাকে বাস্তবতায় ফিরিয়া নিয়া আসিল।

টিনের চালের ছিদ্রপথ হইতে একগুচ্ছে তির্যক আলোক রশ্মি টেবিলের উপর ছড়াইয়া পড়িয়াছে। তাহাতে টেবিলের উপর অপরূপ এক কম্পমান নকসা তৈরি হইয়াছে। বিবেক অবলাকে তাহার দিকে তাকাইতে বলিল। অবলা ভ্রু কুঞ্চিত করিয়া টিনের চালের ছিদ্রপথের পানে তাকাইল। মনে মনে ঠিক করিল – খুব শীঘ্র মিস্ত্রী ডাকিয়া মেরামত করিয়া লইবে। বিবেক মৃদু হাসিয়া অবলাকে প্রশ্ন করিল – অবলা তুমি শুধু টিনের চালের ছিদ্রের দিকেই তাকাইলে, তোমার টেবিলের উপর যে অপার্থিব এক মোহময় আলোর বুননি কাঁপিয়া কাঁপিয়া ভাসিয়া বেড়াইতেছে তুমি তো তাহাকে দেখিতে চাহিলে না। ইচ্ছে করিলেই তুমি ছিদ্রপথ ঢাকিয়া দিতে পার, কিন্তু এই যে মায়াবী চিত্র তাহা কিন্তু তুমি আর পাইবে না। ছিদ্র এবং আলো দুই সত্য। উভয়কেই স্বীকার কর। দুনিয়াতে অনেক মানুষ আছে যাহারা স্বল্প দর্শী। স্বল্প দর্শী হইয়াই অপরকে বিচার করে। অন্যের জীবনের শুধু স্থূল অংশই দেখিতে পায়। ছিদ্রান্বেষী হইতে যাইয়া নিজকেই ছিদ্র করিয়া ফেলে।অবলা কারোর সম্পর্কে তাৎক্ষণিক বিচার করিতে যাইও না, কৌতূহলী হও কিন্তু বিচারিক হইও না। তুমি বড় বেশী বিচারিক হইতে যাইয়া তোমার হ্রদয়ের দ্বার রুদ্ধ করিয়া ফেলিয়াছ, তুমি তোমার নিজের মাঝে সুখ না খুঁজিয়া বাহিরের জগতের কাছে হাত পাতিয়াছ, যাহা তোমার দুঃখের কারণ হইয়া দাড়াইয়েছে। একবার ভাবিয়া দেখ …।

চলবে..


।। সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী ।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,  ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।


অবলাচরণ – ১ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ২ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৩ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার



সংবাদটি শেয়ার করুন