‘প্রথম আন্তর্জাতিক এআই অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ আর প্রথমবারেই আমাদের প্রত্যেকের পদক জয়, এটা অনেক আনন্দের। যদিও আমাদের প্রস্তুতির কিছুটা ঘাটতি ছিল, তা না থাকলে স্বর্ণপদক পেতে পারতাম। পরেরবার প্রস্তুতিতে আর ঘাটতি রাখবে না’—এভাবেই নিজের উচ্ছ্বাস আর স্বপ্নের কথা একনাগাড়ে বলে গেলেন নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী মিসবাহ উদ্দিন। প্রথম আন্তর্জাতিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) অলিম্পিয়াডে রৌপ্যপদক পেয়েছেন তিনি।
মিসবাহ ছাড়াও রৌপ্যপদক পেয়েছেন সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী আরেফিন আনোয়ার আর ব্রোঞ্জপদক পেয়েছেন আরেক নটর ডেমিয়ান আবরার শহীদ এবং একাডেমিয়ার শিক্ষার্থী রাফিদ আহমেদ। দলনেতা হিসেবে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য-প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন। ৯ থেকে ১১ সেপ্টেম্বর সৌদি আরবের রিয়াদে অনুষ্ঠিত হয় বৈশ্বিক এই প্রতিযোগিতা। মরক্কো, নিউজিল্যান্ড, পোল্যান্ড, তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ২৫টি দেশের শতাধিক শিক্ষার্থী এই বিশ্ব আসরে অংশ নেন।
প্রথমবারের মতো অংশগ্রহণ
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে প্রতিযোগিতার একটি প্ল্যাটফরম ‘এআই অলিম্পিয়াড’। আমাদের দেশে গণিত অলিম্পিয়াড, জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াড আয়োজিত হয় অনেক আগে থেকেই। সেই তুলনায় এআই অলিম্পিয়াড ধারণাটি একেবারে নতুন। তরুণদের এআই প্রযুক্তিতে দক্ষ হতে উৎসাহিত করাই এটির মূল উদ্দেশ্য।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের চার শিক্ষার্থী নির্বাচনের জন্য দেশে স্বল্প পরিসরে আয়োজন করা হয় ‘বাংলাদেশ এআই অলিম্পিয়াড’। গত মে মাসে শুরু হয় দেশীয় এই প্রতিযোগিতা। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা নিবন্ধনের মাধ্যমে অনলাইন পর্বে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পান প্রতিযোগিতাটিতে। আঞ্চলিক পর্বের বাছাইকৃত শিক্ষার্থীদের নিয়ে আয়োজিত হয় অনলাইন গ্রুমিং সেশন। এরপর গত ৮ মে প্রগ্রামিং কনটেস্ট ওয়েবসাইট toph.co-তে আয়োজন করা হয় অনলাইন বাছাইপর্ব।
সেখান থেকে বাছাইকৃত শিক্ষার্থীদের নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য-প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত হয় এআই অলিম্পিয়াডের জাতীয় পর্ব। জাতীয় পর্বে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বাড়াতে ২১-২২ মে অনলাইনের মাধ্যমে চলে গ্রুমিং সেশন। এরপর চুড়ান্ত সিলেকশন ক্যাম্প এবং আন্তর্জাতিক টিম সিলেকশন টেস্টের মাধ্যমে অলিম্পিয়াডে দেশের চূড়ান্ত প্রতিনিধি নির্ধারণ করা হয়। বাছাই পরীক্ষার মাধ্যমে চূড়ান্ত হওয়া চার শিক্ষার্থী নির্বাচন করা হয় তাঁদের বুদ্ধিমত্তা ও প্রগ্রামিংয়ে দক্ষতার মাধ্যমে। এই চারজনের দলটিই সৌদি আরবের রিয়াদে এআই অলিম্পিয়াডের বিশ্ব আসরে অংশ নিয়ে পদক ছিনিয়ে আনে।
যেভাবে পরীক্ষা হলো
এআই অলিম্পিয়াডের আন্তর্জাতিক পর্ব অনুষ্ঠিত হয় দুই রাউন্ডে। গত ৯ ও ১১ সেপ্টেম্বর সায়েন্টিফিক ও ব্যাবহারিক রাউন্ড শিরোনামে দুটি ভিন্ন পরীক্ষায় অংশ নেন শিক্ষার্থীরা। দুই রাউন্ডের মোট ফলাফলের ভিত্তিতে র্যাংকিং করা হয়। সায়েন্টিফিক রাউন্ডে মোট সময়কাল ছিল পাঁচ ঘণ্টা। এই রাউন্ডে ছয়টি প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। অংশগ্রহণকারীদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে জানাশোনা ও প্রগ্রামিংয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা প্রতিফলিত হয় এই রাউন্ডে। তবে এটি পুরোপুরিভাবে লিখিত একটি পরীক্ষা। এই পরীক্ষার মোট নম্বর ৪২। পুরো নম্বর পেতে হলে অংশগ্রহণকারীদের মৌলিক কোডিংয়ে দক্ষ হতে হয়, প্রগ্রামিং ভাষা পাইথন নিয়ে ভালো জ্ঞান থাকতে হয় এবং মেশিন লার্নিংয়ের মৌলিক বিষয়গুলো আয়ত্তে থাকতে হয়। এই পরীক্ষা হয়েছিল ৯ সেপ্টেম্বর। ১০ সেপ্টেম্বর কোনো পরীক্ষা হয়নি। সেদিন একটি ‘প্রিপারেশন রাউন্ড’ রাখা হয়। দুই ঘণ্টার এই প্রিপারেশন রাউন্ডে পরবর্তী দিনের ব্যাবহারিক পরীক্ষা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেওয়া হয়। প্রতিযোগীদের পাশাপাশি বিজ্ঞানী ও এআই গবেষকদেরও সমাবেশ ঘটে এই দিনে। শিক্ষার্থীরা একে অন্যের সঙ্গে আইডিয়া শেয়ার করা থেকে শুরু করে এআই নিয়ে দক্ষতা ও সক্ষমতা নিয়ে আলোচনার সুযোগ পান সেদিন। ১১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয় ব্যাবহারিক রাউন্ড। পাঁচ ঘণ্টার এই পরীক্ষায় একটি সমস্যার সমাধান করতে হয় প্রগ্রামিংয়ের মাধ্যমে।
আন্তর্জাতিক এআই অলিম্পিয়াডের ব্যাবহারিক রাউন্ড অনুষ্ঠিত হয় জিন্দি প্ল্যাটফরমে (www.zindi.africa)। অংশগ্রহণকারীদের ব্যাবহারিক সমস্যা-সমাধান এবং কোডিং দক্ষতা পরীক্ষা করার জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয় জিন্দি। ব্যাবহারিক পরীক্ষার প্রশ্নে আফ্রিকার একটি অঞ্চলের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের বলা হয়, এমন একটি মেশিন লার্নিং প্ল্যাটফরম তৈরি করতে, যেটি এসব তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে জানাতে পারবে ওই এলাকায় কবে, কখন দাবানল হবে ও দাবানলের মাত্রা কেমন হবে? জিন্দির নিজস্ব একটি সমাধান থাকে সেখানে এবং তারা চায় তাদের সমাধানের চেয়ে উন্নত সমাধান প্রতিযোগীরা তৈরি করুন। কোনো কারণে সমস্যার সমাধানের মান জিন্দির চেয়ে খারাপ হলে নাম্বারিং করা হয় না। ব্যাবহারিক রাউন্ডও ছিল ৪২ নম্বরের। পরীক্ষা শুরুর পর ৩০ শতাংশ ডাটা বিশ্লেষণ করে একটি লাইভ লিডারবোর্ড শো করা হয়। প্রথম দুই ঘণ্টা বাংলাদেশ দলের মিসবাহ উদ্দিন লিডারবোর্ডে প্রথম স্থান দখল করে রেখেছিলেন। তবে চূড়ান্ত ডাটা বিশ্লেষণের পর মেসবাহ উদ্দিন ইনান চলে যান ১৮ নম্বরে, আরেফিন আনোয়ার ২৪, আবরার শহীদ ৪৩ ও রাফিদ আহমেদ ৬৪। ‘ব্যাবহারিক রাউন্ডে আফ্রিকা নিয়ে আমাদের কাজ করতে হয়। একটি ওয়াবসাইটে ঢুকে সেখানে মাটি, পানি, সম্পদ, জলবায়ু ইত্যাদির বিভিন্ন ডাটা দেওয়া ছিল। এসব ডাটা বিশ্লেষণ করার জন্য সবাই আলাদা আলাদাভাবে মেশিং লার্নিং মডেল বানাই। এই মডেলে যেকোনো ডাটা দিলেই তা বিশ্লেষণ করে জানিয়ে দিতে পারবে—কবে দাবানল হতে পারে, তার ভয়াবহতা কেমন হতে পারে? আমরা আমাদের মতো চেষ্টা করেছি। তবে এই রাউন্ডে যেয়ে বুঝতে পারি আমাদের প্রস্তুতিতে কিছুটা ঘাটতি ছিল। আমি হাঙ্গেরি ও নিউজিল্যান্ড টিমের সঙ্গে পয়েন্টে বেশ কাছাকাছি ছিলাম। ওরা গোল্ড মেডেল পেয়েছে। ওরা যেভাবে গ্রুমিং করেছে, যেভাবে প্রস্তুতি নিয়েছে, সেই তুলনায় আমরা নিয়েছি অনেক কম। আমরা পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে প্রগ্রামিং শিখেছি, আর ওরা প্রগ্রামিংকেই পড়াশোনা বানিয়েছে’, আক্ষেপ করে বলেন মিসবাহ।
দলনেতা অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন বলেন, ‘এর আগে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা বুলগেরিয়ায় অনুষ্ঠিত এআইয়ের বৈশ্বিক ট্রুনামেন্টে অংশ নিয়েছিল। তবে এবারের প্রতিযোগিতায় অন্যান্য দেশ বাংলাদেশকে যথেষ্ট সমীহ করেছে। অলিম্পিয়াডে আমাদের শিক্ষার্থীরা পদক অর্জন করে নিজেদের মেধারও পরিচয় দিচ্ছে। আমাদের চেয়ে অনেক উন্নত দেশের শিক্ষার্থীরা কৌতূহলী হয়ে আমাদের দলের কাছে এসে জানতে চেয়েছে, বাংলাদেশ কী পদ্ধতিতে সমস্যাগুলো সমাধান করে।’
সূত্র: কালের কন্ঠ