ফজলুল বারী
আকাশ ফোন করেছিল দু’দিন। আকাশ ইসহাক। আবার বন্ধু। সাংবাদিক ইসহাক কাজল ভাইর ছেলে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া-ব্রিটেনের সময়ের ব্যবধানে কল রিসিভ করা হয়নি। একটা অনু বার্তাও ছিল। কাজল ভাই ফোন করতে বলেছেন। সময় মিলিয়ে আর ফোন করা হয়নি। আর কোন দিন ফোন করা হবে না কাজল ভাই। তার মৃত্যুর খবরটি শোনার পর চোখ ভিজে আসে। জীবনে এমন যে কত অপরাধ জমা হয়ে আছে। তাকে নিয়ে লেখা প্রামান্য গ্রন্থেও আমার লেখার কথা ছিল। দেবো-দিচ্ছি করে সে লেখাও দেয়া হয়নি। সেটা নিয়ে অবশ্য ভাবি না। কাজল ভাইকে নিয়ে যতদিন বেঁচে থাকবো লেখা যাবে। কিন্তু কথাতো আর কোন দিন বলা হবেনা।
আমি তাকে প্রথম চিনি জানি একজন শ্রমিক নেতা হিসাবে। চা শ্রমিকদের নেতা। তার সময়ে চা শ্রমিকদের আরও জটিল দাস জীবন ছিল। তার আগে এদের নিয়ে সেভাবে তেমন বেশি কাজ করেনি কেউ। কিন্তু আমি যে পত্রিকা অফিসে তাকে প্রথম দেখি সেই পত্রিকার সম্পাদক কথিত ‘নিরপেক্ষ’ নামে রাজাকারদের প্রতি যথেষ্ট দুর্বল ছিলেন। তিনি শুধু মুক্তিযোদ্ধা নন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনকারী সংগঠন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সঙ্গে সক্রিয় জড়িত ছিলেন। সে কারনে সেই পত্রিকা তার প্রতি বেশ কিছুটা সূচিবায়ুগ্রস্ত ছিল। তিনি সেটি জানতেন বুঝতেন। আমিও সেটা জানতাম বুঝতাম। তিনি বিষয়টাকে আমল-পাত্তা দিতেন কম। সেখান থেকে তিনি সে রকম কোন টাকা বা পারিশ্রমিকও পেতেন না। মফঃস্বল সাংবাদিকদের জন্যে সম্ভবত মাসিক বরাদ্দ ছিল দু’শ টাকা! এমন অসম্মান অতিক্রম করে তিনি কাজ করে গেছেন। কারন সাংবাদিকতা তার কাছে ছিল আন্দোলনের অংশ। তার সময়ের শ্রমিক নেতারা নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতেন। কোন অন্যায় কোন দিন তাকে স্পর্শ করতে পারেনি।
অনেক ভালোবাসতেন আমাকে। লোকজনের কাছে পরিচয় করিয়ে দেবার সময় একটি গল্প বলতেন প্রায়। গল্পটা হলো আমি নাকি একবার ঢাকা থেকে এসে তার এলাকায় তাকে হারিয়ে দিয়েছিলাম। গল্পটা নূরজাহানের। মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার ছাতকছড়া গ্রামের নূরজাহানকে গ্রাম্য সালিশে ফতোয়ার বিচারে উঠোনে গর্তে দাঁড় করিয়ে প্রতীকী পাথর ছুঁড়ে মারা হয়েছিল। এই অপমানে মেয়েটি পরে বিষপানে আত্মহত্যা করে। খবর পেয়ে আমি রাতের পত্রিকার গাড়িতে অকুস্থলে ভোরের মধ্যে পৌঁছে যাই। রিপোর্টের তথ্য ছবি নিয়ে যখন সেই গ্রাম ছেড়ে বেরুচ্ছিলাম, তখন কাজল ভাইর নেতৃত্বে কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল-মৌলভীবাজারের একদল সাংবাদিক গ্রামে ঢুকছিলেন।
নূরজাহানকে নিয়ে দুই পর্বের সেই রিপোর্ট বিশেষ আলোড়ন তুলেছিল। সেই রিপোর্টের প্রভাবে ফতোয়াবাজদের গ্রেফতার-বিচার হয়। মানবাধিকার কর্মীদের প্রতিবাদ-ফলোআপের কারনে বাংলাদেশে সম্ভবত সেটিই ছিল ফতোয়ার বিরুদ্ধে প্রথম বিচার। প্রয়াত আনিসুল হক তখন টেলিভিশনে নানা ইস্যুতে প্যাকেজ অনুষ্ঠান করতেন। আনিসুল হক, স্ত্রী রুবানা হক, আব্দুন নূর তুষার আর আমাকে নিয়ে ছাতকছড়া এসে একটি অনুষ্ঠানের নানা চিত্র ধারন করেন। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে ডেল্টা লাইফ ইন্সুরেন্স প্রবর্তিত নূরজাহান স্মৃতি পুরস্কারের প্রথম পুরস্কার আমাকে দেয়া হয়। কাজল ভাই সে গল্পটা গর্ব করে বলতেন। এরপর মাগুরছড়া গ্যাস ফিল্ডে যখন আগুন লাগে আমাদের প্রায় দিন দেখা হতো। ততোদিনে আমার পত্রিকাও বদল হয়েছে।
এরমাঝে দেশান্তরী হন কাজল ভাই। থিতু হন লন্ডনে। ওখানে তিনি জনমত পত্রিকায় যোগ দেন। আর আমি ঢাকা থেকে জনমতে লিখতাম। একবার জনমত আমার বিলাত ভ্রমণের উদ্যোগ নেয়। এরমাঝে লেবাননে হিজবুল্লাহ-ইসরাইল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে আমি প্রথমে লেবাননে চলে যাই। সেই যুদ্ধ শেষে বৈরুত থেকে গেলাম লন্ডনে। আমার বিলাত ভ্রমনের পরিকল্পনা হতেই তিনি বারবার করে ফোন করতে থাকেন। তার অনুরোধ লন্ডনে আমি যাতে তার বাসায় থাকি। আমার অনেক নিকটাত্মীয় লন্ডনবাসী। এমসি কলেজ জীবনের অনেক বন্ধুও ব্রিটিশ বাংলাদেশি। কিন্তু আমি কাজল ভাইর বাসায় থাকবো শুনে তারা মনোঃক্ষুন্ন হন। কিন্তু কাজল ভাইর বাসায় থাকায় সেখান থেকে লিখতে খুব সুবিধা হয়েছে। প্রতিদিন লিখেছি ‘বিলাতের পথে পথে’।
ইসহাক কাজল ভাই ড্রাইভ করতেননা। হিথরো বিমান বন্দরে তার সঙ্গে আসেন বিলাত প্রবাসী আরেক সাংবাদিক। ড্রাইভ করছিলেন তিনিই। পথে কাজল ভাইর বানানো পান খাচ্ছেন দেখে আমি খুব মজা পাই। সেদিন ঢাকায় পাঠানো আমার একটি রিপোর্টের শিরোনাম ছিল ‘এক খিলি পান এক পাউন্ড’। লন্ডনের ফরেস্ট রোড এলাকায় তখন সপরিবারে থাকতেন কাজল ভাই। সেদিন বাসায় যাবার পথে আমার জন্যে মোবাইল ফোনের সিম, বাসের টিকেট কেনেন। প্রথম দিনেই আমার বন্ধু শাওন এসে সে বাসা থেকে আমাকে নিয়ে রাতের লন্ডন দেখায়। রাত আড়াইটার পর বাসায় ফিরেছি দেখে পরেরদিনই বাসায় প্রবেশের একটি চাবি আমাকে দেয়া হয়। সে বার লন্ডন পৌঁছার এক দু’দিন পরেই রোজা শুরু হয়ে যায়। কাজল ভাই আর আমি প্রতিদিন সেহরিও খেতাম।
কাজল ভাইর বাসায় আমার সেই জীবন নিয়ে অনেকে মজা করে বলতাম আমি ‘কাজল হোটেল এন্ড রেষ্টুরেন্টে’ থাকি খাই। প্রায় প্রতিদিন আমরা একসঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে জনমত অফিসে যেতাম। লন্ডনের সাংবাদিক-সাংস্কৃতিক কর্মী অনেকের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ তার মাধ্যমেই হয়। তাদের প্রায় সবার সঙ্গে তার হৃদ্য-শ্রদ্ধার সম্পর্ক দেখি। আবার অনেকে মজা করে বলতেন কাজল ভাইর কাছে মেনন ভাইর কোন বদনাম পাবেননা। আমি লন্ডনে থাকতেই সেখানে এসে যথারীতি কাজল ভাইর বাসায় ওঠেন ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন। ইউরোপের কোন একটি দেশ ঘুরে দেশে ফেরার পথে তিনি লন্ডন এসেছেন। পাজামা-পাঞ্জাবি ছাড়া শার্ট-প্যান্ট পরা রাশেদ খান মেননকে আমি তখনই প্রথম দেখি। তখন বুঝতে পারি ‘কাজল এন্ড রেস্টুরেন্টে’ শুধু রাশেদ খান মেনন অথবা আমি নই, এমন লন্ডন পৌঁছে অনেকেই এখানে এসে ওঠেন। এদের মধ্যে আমিই প্রায় একমাস লম্বা সময়ের জন্যে সেখানে ছিলাম।
বিলাতে আমি প্রিন্সেস ডায়ানার কবরে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু ইসহাক কাজল ভাইর ইচ্ছা আমি যাতে কার্ল মার্ক্সের সমাধিতে যাই। রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে লন্ডনে দীর্ঘ সময় ছিলেন কার্ল মার্ক্স। এখানেই তার মৃত্যূ হয়। পর্যটনের গুরুত্ব বিবেচনায় কার্ল মার্ক্সের নানা স্মৃতি সংরক্ষন করেছে ব্রিটিশ সরকার। তার সমাধিতে নিয়ে যান বিলাতের সিপিবি ও উদিচীর নেতা গোলাম মোস্তফা। পথে যেতে যেতে তিনি বলেন আমার মতো লোকজনকে নিয়ে যেতে যেতে সেই সমাধিতে তার যাওয়াটা পাঁচশ বার ছাড়িয়েছে! কার্ল মার্ক্সের সমাধির আশেপাশের কবরগুলো দেখে চমকে উঠি। ফিলিস্তিন সহ বিশ্বের নানা দেশের কমিউনিস্ট নেতাদের কবর সেখানে। যারা বিলাতে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়ে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত লন্ডনেই বসবাস করেছেন। তাদের সবার সমাধি কার্ল মার্ক্সের সমাধির চারপাশে হওয়াতে সেটি সেখানে পর্যটনের গুরুত্বও বাড়িয়েছে। কার্ল মার্ক্সের সমাধিতে যাবার ব্যবস্থার জন্যেও কাজল ভাইর প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে আছি।
দেশে তাকে দেখেছি একজন সৎ সংগ্রামী চা শ্রমিক নেতার বেশে। বিলাতে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন শব্দ শ্রমিক। একমাস একসঙ্গে থেকে আমি তার জীবন দেখেছি যেখানে পদে পদে ধরে রেখেছেন নিজস্ব সততার স্বকীয়তা। যে দেশের জন্যে তিনি যুদ্ধ করেছেন সে দেশ ছেড়ে যাওয়া নিয়ে একটা দূঃখ-অপরাধবোধও তার মাঝে ছিল। বড় ভালো একজন মানুষ ছিলেন ইসহাক কাজল ভাই। মঙ্গলবার এ লেখা তৈরি করতে করতে তার ছেলে আকাশের সঙ্গে ম্যাসেঞ্জারে বার্তা বিনিময় চলছিল। বুধবার লন্ডন সময় দুপুর দেড়টায় প্রয়াত কাজল ভাইর দাফন হবে। চিরদিনের ভালো মানুষটার প্রানহীন দেহখানাও বুধবার চিরদিনের জন্যে চলে যাচ্ছে। অনেক ভালো থাকবেন কাজল ভাই। আমরা আমৃত্যু বলে যাবো আপনি একজন বড় ভালো মানবিক সৎ মানুষ ছিলেন।
লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী সাংবাদিক
আরও পড়ুনঃ