ফিচার্ড লেখালেখি

অবলাচরণ – ৫ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ-৫

অবলাচরণ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

পর্ব প্রকাশের পর….

‘তুমি তোমার নিজের মাঝে সুখ না খুঁজিয়া বাহিরের জগতের কাছে হাত পাতিয়াছ’ – বিবেকের এই কথাগুলো তাহার মনের মাঝে বার বার প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। ক্ষণিক সুখের জন্য সে অন্যের দুয়ারে হাত পাতিয়াছে – এই কথা ভাবিয়া অবলার মন এক গভীর দীনতায় ভরিয়া গেল। অবলা ফিরিয়া গেল তার অতীতের কাছে।

ছেলের সংসার হইতে সদ্য বিতাড়িত হইয়া অবলা তখন তাহার নিজের গৃহে ফিরিয়া আসিয়াছে। তাহার মনের মাঝে এক অস্থির টানপরন। তখনি তাহার ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাথে পরিচয়। হাতের মুঠোর মাঝে অজস্র জ্ঞানের খাজানা পাইয়া সে তাহার মুঠি ফোনটাকে আপন জনের চেয়েও ভালবাসিয়া ফেলিল। সাধারণ মানুষ যতটুকু জানতে পারলে তৃপ্ত হয়, অবলা সেখানে তৃপ্ত হইতে পারে না। সে কেন যেন সমাজে প্রতিষ্ঠিত লেখক কবিদের জীবনের বিতর্কিত অংশ খুঁজিয়া পাইতে নিজকে নিয়োজিত করিল। সেই বিতর্কিত তথ্যগুলো নিজের ভাষায় সাজাইয়া গোছাইয়া, ফেসবুকের পাতায় পোস্ট করিয়া সে নিজকে প্রজ্ঞাবান ভাবিয়া অত্যন্ত গর্বিত বোধ করিতে লাগিল।

প্রথম প্রথম অনেকেই তাহার পোস্টগুলো পছন্দ করিয়াঞ হরেক রকম মন্তব্য করিয়া তাহাকে উৎসাহ দিতে লাগিল। অনেকেই তাহার প্রতি বন্ধুত্বের আহ্বান জানাইতে লাগিল। অবলা কোন কিছু না ভাবিয়ে অকাতরে তাহাদের আহবানে সারা দিতে দিতে একসময় তাহার বন্ধুর সংখ্যা ফেসবুকের কোটা ছাড়াইয়া গেল। কালক্রমে অবলার চরিত্রে এক বিশাল পরিবর্তন আসিল। সে নিজকে অত্যন্ত কেউকেটা ভাবিয়া গভীর অতৃপ্তিতে তাহার তথাকথিত বন্ধুদের পোষ্টকে অবজ্ঞা করিতে লাগিল।

এ যে এক লেন-দেনের জগত, এ জগতে ক্ষণিক বন্ধুত্বকে টিকাইয়া রাখিতে যে অনেক অপ্রিয় চাটুকারিতা করিতে হয়, তাহা সে বুঝিতে পরিল না। লেন-দেনের টানপরনে অনিবার্য ভাবে তার পোস্টে লাইক পাইবার সংখ্যা দিন দিন কমিতে লাগিল। অবলার অতৃপ্ত-বোধ আরও বেশী প্রবল হইলো। সে অতৃপ্ত-বোধ, সেই লাগামহীন প্রত্যাশা অত্যন্ত ধীর গতিতে তাহার মনোজগতকে আচ্ছন্ন করিল। অবলা আজ বিবেকের মুখোমুখি হইয়া অবনত মস্তকে সে তাহার দুর্বলতা মানিয়া লইল।

অবলার ঘর হইতে অনতিদূরে রাস্তার বাকে বিরাট এক বটবৃক্ষ। খোলা জানালা দিয়া সেই বটবৃক্ষের বিস্তৃত ডালপালা চোখে পড়ে। বিবেক অবলাকে ঘরের ভেতর থেকে বাহির করিয়া বট বৃক্ষের কাছে লইয়া গেল। প্রাচীন বটবৃক্ষের পাদমূলে সান বাধানো এক উঁচু পাটাতন। সময়ের ভারে তাহা ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। সেই ভাঙ্গা পাটাতনে দুজন পাশাপাশি বসিয়া পথচারীদের আনাগোনা দেখিতে লাগিল। বিবেক নীরবতা ভাঙ্গিয়া অবলাকে বলিল – অবলা তাকাইয়া দেখ চারিদিকে জীবনের কতো কোলাহল। জীবনের পথ ধরিয়া কতো পথিক ছুটিয়া চলিয়াছে। কেহ ক্ষুধিত তৃষ্ণার্ত হইয়া আমাদেরই মতো বটমূলে আশ্রয় লইয়াছে। দেখ, অদূরে একজন বসিয়া বসিয়া কি যেন আকাশ-পাতাল ভাবিতেছে। তাহার চোখে মুখে দুঃখের দুঃসহ যাতনা বোধ। দেখ, আরেকজন বসিয়া বসিয়া আপন মনে একাএকি হাসিয়া যাইতেছে। হয়তো এখানেই ঐ বেদনাহত মানুষটি এমন কারো দেখা পাইবে যে তাহার কাঁধে হাত রাখিয়া তাহাকে দাঁড়াইতে সাহায্য করিবে, হাস্যচ্ছল মানুষটিও হয়তো খুঁজিয়া পাইবে তাহারী মত কোন মানুষকে। হয়তো কারোর এই ক্ষণিক দেখা এক চিরস্থায়ী সম্পর্কের বীজ বপন করিবে। হয়তো কারোর সাথে আর দেখা হইবে না। হয়তো কেউ কাউকে খুঁজিতে আসিয়া রাস্তার পানে তাকাইয়া আজীবন এই বটমূলে বসিয়া থাকিবে। অবলা, তোমাদের এ সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক কিন্তু এই বটগাছটির মতো। এখানে ভিন্ন ভিন্ন পথের আত্মীয় অনাত্মীয় জনের সাথে দেখা হয়, কথা হয়। কেহ বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করে, কেহ কাহাকে ভালবাসিয়া ফেলে। অনেকে সে বন্ধুত্বের আবেদন, ভালবাসার আবেদন অগ্রাহ্য করিতে পারে না। ক্ষণিক ভালোলাগার মোহে সে ভালবাসার পেছনে, সে বন্ধুত্বের পেছনে কোন স্বার্থ, কোন অভিসন্ধি আছে কিনা খুচাইয়া দেখিতে ব্যর্থ হয়। মোহ কাটিয়া গেলে যখন সম্পর্কের মৃত দেহ গলিয়া পচিয়া গন্ধ ছড়ায় তখন সে তাহাকে আপন করিয়া লইতে পারে না।

অবলার মনে প্রশ্ন আসে তাহলে বন্ধুত্ব কি এক মোহ? মোহ একদিন কাটিয়া যাইবে ভাবিয়াও তাহলে মানুষ কেন বন্ধু খুঁজিয়া বেড়ায়? বিবেক কোন উত্তর না দিয়া বটগাছ থেকে ঝুলে পড়া এক ঝুরির দিকে তাকাইয়া থাকে। অবলার বিস্মৃত অতীতের কথা মনে পড়ে। একদা এই খানে বন্ধুরা মিলিয়া খেলা করিত। বয়ো সন্ধিকালে তাহারি কিছু দুষ্ট বন্ধু এই বটের গাছের গায়ে যোগ চিহ্ন দিয়া প্রতিবেশী মেয়েদের নাম লিখিয়া রাখিত। অনেকে তাহার চেয়েও অনেক বেশী কদর্য কথা লিখিয়া অনাবিল মজা কুড়াইত। সে সৌদামনিকে সেই ছোট্ট বয়সে ভালবাসিয়া ফেলিয়াছিল। সেই ভালবাসার কথা সে এক পাথর খণ্ড দিয়া বটবৃক্ষের কোন এক ঝুলন্ত ঝুরিতে লিখিয়া রাখিয়াছিল। স্কুলে যাওয়া আসার পথে যদি সৌদামনির চোখে পড়ে সেই প্রত্যাশায়। সময়ের স্রোতে সেই লেখা বিবর্ণ হইয়া গিয়াছে। যোগ চিহ্নটা কালের নিষ্ঠুর পরিবর্তনকে উপেক্ষা করিয়া আজো টিকিয়া আছে দেখিতে পাইয়া অবলার চোখে অশ্রুতে ভরিয়া গেল।

অবলাচরণ– ৫

চলবে..


।। সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী ।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,  ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।



 


অবলাচরণ – ১ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ২ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৩ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

সংবাদটি শেয়ার করুন