কিংবদন্তি অভিনেতা, নাট্যকার, কবি ও চিত্রকর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
বিদ্যুৎ ভৌমিক ।। হাসপাতালে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর না ফেরার চলে গেলেন বাংলা ছবির মহাতারকা, কিংবদন্তি অভিনেতা, নাট্যকার, কবি ও চিত্রকর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। । নোভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত সেপ্টেম্বের কলকাতার বেলভিউয়ে ভর্তি হন সৌমিত্র। তিনি একটা সময়ে ক্যানসারেও আক্রান্ত হয়েছিলেন। ফলে কখনও উন্নতি কখনও অবনতি, এই দোলাচলেই চলছিল হাসপাতাল-বন্দি সৌমিত্রর জীবন। পরিশেষে অভিনেতাকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করে ব্যর্থ হন চিকিৎসকেরা। ১৫ নভেম্বর রবিবার ভারতীয় সময় দুপুর ১২: ১৫ মিনিটে কলকাতার বেলভিউ নার্সিংহোমে ৮৫ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলা চলচ্চিএের কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তার মৃত্ুতে সর্বএই গভীর শোকের ছায়া নেমে আছে । পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি, ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ টালিউড/ বলিউড চলচ্চিএ অভিনেতা অঙ্গনের অনেকেই গভীরশোক প্রকাশ করেন। গান স্যালুটের মাধ্যমে ক্যাওড়াতলায় শ্ণশাণে শেষ বিদায় জানানো হয় কিংবদন্তি এই অভিনেতাকে ।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় পরিবারের আদি বাড়ি ছিল অধুনা বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার শিলাইদহের কাছে কয়া গ্রামে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পিতামহের আমল থেকে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যরা নদীয়া জেলার কৃষ্ননগরে থাকতে শুরু করেন । সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সেখানেই জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারী । সৌমিত্রর পিতৃদেব মোহিত কুমার চট্টোপাধ্যায় কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতি করতেন । সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কলকাতার সিটি কলেজ থেকে প্রথমে আইএসসি এবং পরে বিএ অনার্স (বাংলা) পাস করার পর পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজ অফ আর্টস-এ দু-বছর পড়াশোনা করেন।কলেজে বাংলা অনার্স নিয়ে পড়ার সময় তৎকালিন স্বনিমধন্য নাট্যব্যক্তিত্ব শিশির কুমার ভাদূড়ীর সাথে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের যোগাযোগ ঘটেছিল এবং শিশির কুমার ভাদুড়ির অভিনয় সৌমিত্রকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। তাই তখন থেকে অভিনয়কে জীবনের প্রধান লক্ষ্য করে নেবার কথা দেখেছিলেন সৌমিত্র।
অভিনেতা হিসেবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন একজন জনপ্রিয়, তুখোড় দর্শকনন্দিত অভিনেতা, তাছাড়া একজন আবৃত্তি শিল্পী হিসেবেও তার নাম অত্যন্ত সম্ভ্রমের সাথেই উচ্চারিত হয়। তাছাড়াও তিনি ছিলেন কবি এবং অনুবাদকও। কিংবদন্তি ও বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ৩৪টি সিনেমার ভিতর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ১৪টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তার সুদীর্ঘ ষাট বছরের চলচ্চিত্রজীবনে তিনশোরও বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন কিংবদন্তি ও বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের সবচেয়ে পছন্দের অভিনেতা । ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে সৌমিত্র প্রথম সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় অপুর সংসার ছবিতে শর্মিলা ঠাকুরের বিপরীতে অভিনয় করেন। ১৯৬০ সালে তপন সিংহের পরিচালনায় ক্ষুধিত পাষাণ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৬১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত পুনশ্চ চলচ্চিত্রে প্রথমবারের মত মৃণাল সেনের পরিচালনায় অভিনয় করেন। ১৯৬২ সালে অজয় করের পরিচালনায় সূচিত্রা সেনের সঙ্গে সাত পাকে বাঁধা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন । পরবর্তীকালে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মৃনাল সেন, তপন সিংহ, অজয় করের মত বিখ্যাত পরিচালকদের সঙ্গেও কাজ করেছেন ও তাদের পরিচালিত বিভিন্ন চলচ্চিএে সাফল্যের সাথে অভিনয় করেছেন । বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে সত্যজিত রায়ের পরিচালনায় জনপ্রিয় ছায়াছবি ছিল অশনি সংকেত যেখানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বাংলাদেশের ববিতা বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন ।সিনেমা ছাড়াও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বহু নাটক, যাএা, এবং টিভি ধারাবাহিকে সাফল্যের সাথে অভিনয় করেছেন। অভিনয় ছাড়াও তিনি নাটক ও কবিতা লিখেছেন, নাটক পরিচালনা করেছেন। তার অভিনীত চরিত্রগুলোর ভিতরে সব থেকে জনপ্রিয় হল ফেলুদা। তিনি সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় সোনার কেল্লা এবং জয় বাবা ফেলুনাথ ছবিতে ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত ফেলুদার প্রথম ছবি সোনার কেল্লা বের হওয়ার পর সত্যজিৎ রায় স্বীকার করেন যে, তার চেয়ে ভালো আর কেউ ছবিটি করতে পারতেননা। তাই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আরেকটি Nickname হল ফেলুদা । কিংবদন্তি অভিনেতা হিসেবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় লিজিয়ঁ অব অনার, দাদাসাহেব ফালকে, বঙ্গভূষণ, পদ্মভূষণ এবং জাতীয় স্তরে আরও অনেক পুরস্কার পেয়েছেন।
আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও সৌমিত্রকে ধরে রাখতে পারলেন বলে বেলভিউয়ে দাঁড়িয়ে এমন আক্ষেপ করতে শোনা যায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। টুইটারে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে লেখেন, ‘ফেলুদা আর নেই। অপু আমাদের বিদায় জানিয়েছেন। বিদায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। উনি এক জন কিংবদন্তী। বাংলা, ভারতীয় এবং আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র এক জন মহান অভিনেতাকে হারাল। ওঁকে খুব মিস করব আমরা। বাংলা চলচ্চিত্র জগৎ অভিভাবকহীন হয়ে গেল’।
মহাতারকা ও কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে আমরা গভীরভাব শোকাহত ও ব্যথিত । বাংলা চলচ্িএ একজন উজ্জল নক্ষএকে হারাল । কিংবদন্তি অভিনেতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করছি ।
সূত্র : উইকিপেডিয়া ও আনন্দ বাজার পত্রিকা
১৫ নভেম্বর ২০২০
এসএস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন