কোভিড প্যান্ডেমিকের বর্ষপূর্তি |||| ডঃ শোয়েব সাঈদ
গত বছরের এই দিনে অর্থাৎ ১১ই মার্চ ২০২০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১১০ টি দেশের ১ লক্ষ ১৮ হাজার সংক্রমণের কঠিন পরিস্থিতিতে করোনা ভাইরাস উদ্ভূত রোগ কোভিড-১৯ এর বিস্তারকে গ্লোবাল প্যানডেমিক ঘোষণা করে। সংস্থাটির মহাপরিচালক ডঃ তেদ্রোস আধানম গেব্রেয়েসাস সংক্রমণের ভয়াবহতা বিষয়ে সদস্য দেশগুলিকে সতর্ক করে দেন এবং অনতিবিলম্বে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেন।
অতপর আজতক বিশ্ববাসীকে মোকাবিলা করতে হল কঠিন একটি বছর। এই মুহূর্তে অর্থাৎ ২০২১ সালের ১১ই মার্চে ১১ কোটি ৮৬ লক্ষ সংক্রমণ আর ২৬ লক্ষ ৩২ হাজার মৃত্যুর কঠিন বোঝা নিয়ে বিশ্বকে লড়াই করতে হচ্ছে কোভিড মহামারির বিরুদ্ধে।
কঠিন এই পরিস্থিতির মধ্যেই বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি আশা ছড়িয়েছে জনমনে। বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় এই মুহূর্তে চারটি প্রধান ভ্যাকসিন তীব্র লড়াইয়ে লিপ্ত ভাইরাসটির বিরুদ্ধে।
২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু খ্যাত ভাইরাস এইচ১এন১ এর পেনডেমিকের পর বিশ্বকে আবারো মোকাবিলা করতে হচ্ছে নতুন এই প্যানডেমিক, সার্স-সিওভি-২ উদ্ভূত কোভিড-১৯ পেনডেমিক।
সার্স-সিওভি-২ ভাইরাসটি অবশ্য মানুষের শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের প্রথম করোনা ভাইরাস নয়, প্রায় ৬-৭টি ভাইরাস ইতিমধ্যে চিহ্নিত হয়েছে যার সবগুলির উৎস জীবজন্তু। ২০০৩ সালে চীন আর ভিয়েতনামে সিভেয়ার একুউট রেস্পিরেটরি সিনড্রোম করোনা ভাইরাস (সার্স-সিওভি-১) আর ২০১২ সালে সৌদি আরবে মিডল ইস্টার্ন রেস্পিরেটরি সিনড্রোম করোনা ভাইরাস (মার্স) বেশ ভুগিয়েছে মানব সভ্যতাকে। মার্স ছড়িয়ে গিয়েছিল প্রায় ২৭ টি দেশে।
কোভিড-১৯ এর জন্যে দায়ী SARS-CoV-2 (সার্স-সিওভি-২) ভাইরাসটিকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া প্যানডেমিক সংকট আর সংকট মোকাবিলায় ব্যস্ত বিশ্ব বদলে গেছে প্রবলভাবে, বদলে দিয়েছে আমাদের ব্যক্তিগত জীবন, পেশাগত জীবন, অর্থনীতি, যোগাযোগ সবকিছু।
২০১৯ সালের নভেম্বরের শেষের দিকে পেশাগত কাজে আমাকে উড়তে হয় মাইসিটি মন্ট্রিয়ল থেকে এস্টোনিয়ার রাজধানী টালিন আর ডেনমার্কের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর অরহুসে। সার্স-সিওভি-২ ভাইরাসটি তখন হানা দিয়েছে চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে।
বিষয়টি তখনই চীনা কর্তৃপক্ষের নজরে আসলেও রাজনৈতিক কারণে চেপে রাখা হয়েছিল। যুক্তরাজ্যের গার্ডিয়ান পত্রিকার ১৩ই মার্চ ২০২০সংখ্যায় চীন সরকারের অপ্রকাশিত ডাটার উপর প্রকাশিত সংবাদসূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয় কোভিড-১৯ এর সংক্রমণের প্রথম ঘটনাটি পাওয়া যার ২০১৯ সালের ১৭ই নভেম্বর। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টে বলা হয় আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন ভাইরাসের ঘোষণার কয়েক সপ্তাহ আগেই কর্তৃপক্ষের ভাইরাস সংক্রমণের বিষয়টি জানা ছিল।
কয়েক সপ্তাহের এই গোপনীয়তা কিংবা সিদ্ধান্তহীনতা এই মহামারি সংকটকে ভয়াবহভাবে ত্বরান্বিত করেছে। চীনের ত্বরিত সিদ্ধান্তে সক্ষমতা, তথ্য প্রকাশে স্বচ্ছতা হয়তো কোভিড মহামারি নিয়ন্ত্রণে আরো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারতো।
চীনা কর্তৃপক্ষ সরকারীভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে জানায় যে তাঁরা ৮ই ডিসেম্বরর প্রথম সংক্রমণ শনাক্ত করে। চীনা কর্তৃপক্ষ মানুষ থেকে মানুষের সংক্রমণের বিষয়টি ২১ জানুয়ারি ২০২০ সাল পর্যন্ত স্বীকারই করেনি। মূলত ডিসেম্বর মাসে সীমিত আকারের এই নতুন ভাইরাসটি নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়।চীনের উহান মিউনিসিপ্যাল স্বাস্থ্য কমিশন ২০১৯ সালের শেষ দিনে অর্থাৎ ৩১ শে ডিসেম্বর হুবেই প্রদেশের উহান শহরে কিছু নিউমেনিয়া জনিত অসুস্থতার কথা জানান যা পরে নতুন ধরণের করোনা ভাইরাস সংক্রমণ হিসেবে চিহ্নিত হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২০ সালের ৪ঠা জানুয়ারি ১১ মিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্য চীনের সাংস্কৃতিক আর অর্থনৈতিক হাব উহানের এই নিউমোনিয়া ঘটনাটি সামাজিক মাধ্যমে জানিয়ে দেয় এবং পরের দিন নতুন ভাইরাসের খবরটি রোগ বিস্তারের প্রথম সংবাদ হিসেবে ছাপানো হয়। জানুয়ারির ৫ তারিখ নাগাদ ৫৯ টি সংক্রমণের কথা জানা যায় তবে কোন মৃত্যুর ঘটনা জানানো হয় নি। জানুয়ারি ১০ তারিখ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ভাইরাসটি নিয়ে বিস্তারিত টেকনিক্যাল নির্দেশনা প্রকাশ করেন।
জানুয়ারীর ৭ তারিখ চীন এই অজানা ভাইরাসের জেনেটিক সিকোয়েন্স করার কথা জানান আর ১২ তারিখ ভাইরাসটির জেনেটিক সিকোয়েন্স প্রকাশ করে। এভাবে জানা হয়ে যায় চীনের এই অজানা রোগটির নাম হচ্ছে কোভিড-১৯, যার কারণ হচ্ছে নোভেল করোনা ভাইরাস সার্স-সিওভি-২।
জানুয়ারির ১৩ তারিখ চীনের বাইরে থাইল্যান্ডে প্রথম কোভিড-১৯ সনাক্ত হয়। তখন পর্যন্ত কারো ধারণার মধ্যে ছিলনা কতোটা ভয়াবহ হতে পারে কোভিড-১৯ বিশ্ব সভ্যতা আর বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্যে।
করোনা নিয়ে তোলপাড়ের শুরু হচ্ছিল এশিয়ার দেশগুলোতে ফেব্রুয়ারি মাসে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, ফার ইস্টের জাপান, কোরিয়া তখন আক্রান্ত হতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সংক্রমণ কিন্তু চীন থেকে ছিলনা, ছিল ইতালি থেকে। মার্চের ৮ তারিখ বাংলাদেশে প্রথম সংক্রমণের খবর মেলে।
উহানের এই ভাইরাসটিকে দেখা গেল ভারত বাংলাদেশ হয়ে পশ্চিমে যাওয়ার চাইতে সরাসরি ইরান, মধ্যপ্রাচ্য আর ইউরোপে চলে গেল দ্রুততার সাথে ব্যবসা বানিজ্য, অনুকূল আবহাওয়া আর গ্লোবালাইজেশনের সুযোগে।
কানাডায় প্রথম সংক্রমণের ঘটনা পাওয়া যায় ২৫শে জানুয়ারি টরেন্টোর বাসিন্দা চীনের উহান ফেরত এক ভদ্রলোকের মাধ্যমে।
গত এক বছরের এই কোভিড মহামারির সময় ব্যক্তিগত দায়বোধ থেকে মানবতার কল্যাণে সচেষ্ট থেকেছি কোভিড সংক্রান্ত টেকনিক্যাল বিষয়গুলো সহজবোধ্য বাংলায় পাঠকদের কাছে উপস্থাপনের জন্যে। কোভিডের নানা বিষয়ে লিখেছি প্রায় অর্ধ শত কলাম।
বাংলাদেশ থেকে আমাদের সময় ডট কম, বিডি নিউজ ২৪ ডট কম, আমাদের নতুন সময়, কানাডা থেকে সিবিএনএ ২৪ ডট কম, ভোরের আলো পত্রিকাগুলোর কাছে কৃতজ্ঞ কোভিড সংক্রান্ত কলামগুলো সঠিক সময়ে পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেবার জন্যে। আমাদের সময় ডট কম এর প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা।
কোভিড প্যান্ডেমিকের বর্ষপূর্তি |||| ডঃ শোয়েব সাঈদ লেখকঃ কলামিস্ট এবং মাইক্রোবিয়াল বায়োটেকনোলজিস্ট। কানাডার একটি বহুজাতিক কর্পোরেটে ডিরেক্টর পদে কর্মরত।
এস এস/সিএ