কোভিড ভ্যাক্সিন সমাচার ।।।। ডঃ শোয়েব সাঈদ
জুন মাসের প্রথম দিকে “কোভিড ভ্যাকসিন এবং বাংলাদেশ” শীর্ষক কলামে ভ্যাক্সিন উদ্ভাবন দৌড়ে এগিয়ে থাকা প্রতিযোগীদের বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছিলাম, লিখেছিলাম বৈশ্বিক এই দৌড়ে বাংলাদেশের ভ্যাক্সিন সংগ্রহের উদ্যোগের বিষয়ে। দেড় মাসের ব্যবধানে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভ্যাক্সিন বিষয়ে আবারো লিখতে হচ্ছে। ভ্যাক্সিন উদ্ভাবন প্রক্রিয়া এবং উদ্ভাবনে সাম্প্রতিক অগ্রগতি নিয়ে এবারের লেখা।
কোভিড ভ্যাক্সিন উদ্ভাবনে কাজ করছে বিশ্বব্যাপী শতাধিক প্রোজেক্ট। মিডিয়ার মাধ্যমে প্রায়ই কোন না কোন প্রোজেক্টের হালহকিকতের খবর জনগণ জানতে পারছে। ভ্যাক্সিন উদ্ভাবন প্রক্রিয়া অত্যন্ত ব্যয়বহুল, অনিশ্চিত আর সময়সাপেক্ষ। যিনি সফল হয়ে আগে বাজারে চলে আসতে পারবেন, উনিই বাজিমাত করবেন আর চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিবেন প্রতিযোগীদের লগ্নি, সময় আর শ্রমকে। প্রতিযোগিতার এই তীব্রতায় মাঠে থাকতে চাচ্ছে সবাই, নিউজ না হবার বিষয়ও নিউজ হচ্ছে প্রিম্যাচুউরভাবে, বিজ্ঞান সাংবাদিকতার অদক্ষতায় গুরুত্বহীন খবরও গুরুত্ব পাচ্ছে। এরকম অবস্থায় ওয়াকিবহাল মহল যেখানে বিভ্রান্ত, সেখানে সাধারন জনগণের পক্ষে প্রকৃত অবস্থা বুঝা কঠিন। তাই ভ্যাক্সিন উদ্ভাবনের সাম্প্রতিক অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করার আগে ভ্যাক্সিন উদ্ভাবন প্রক্রিয়া নিয়ে কিছু তথ্য শেয়ার করতে চাচ্ছি।
ভ্যাক্সিন উদ্ভাবন প্রক্রিয়া নিয়ে দেশে দেশে নিজস্ব গাইডলাইন আছে। বিভিন্ন দেশের নির্দেশনায় কিছুটা পার্থক্য থাকলেও মোটাদাগে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে একটা ঐক্যমত আছে। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইনকে স্ট্যান্ডার্ড ধরা হয়। সিডিসি এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন, স্বীকৃতি, সন্তুষ্টির জন্যে ভ্যাক্সিন উদ্ভাবন প্রক্রিয়া হতে হবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুসারে।
ভ্যাক্সিন উদ্ভাবন প্রক্রিয়ায় সিডিসি’র গাইডলাইনটি ব্যাপকভাবে অনুসরন করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে সিডিসি আর এফডিএ (ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিসট্রেশন) মূলত সমন্বিত কাঠামোতে কাজ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা্র সাথে সহযোগিতার মাধ্যমে। সিডিসি’র গাইডলাইন অনুসারে ভ্যাক্সিন উদ্ভাবন প্রক্রিয়াটির ৬টি ধাপ আছে, কোন কোন ধাপে কয়েকটি ফেজ/পর্যায় থাকে। ধাপ ৬টি হচ্ছে ১) অনুসন্ধানী বা এক্সপ্লোরেটরি ২) প্রাক ক্লিনিক্যাল ৩) ক্লিনিক্যাল ৪) রেগুলেটরি রিভিও এবং অনুমোদন ৫) উৎপাদন ৬) মান নিয়ন্ত্রণ।
সর্ব প্রথম ধাপ অনুসন্ধানী বা এক্সপ্লোরেটরিতে ভ্যাক্সিন উদ্ভাবনে মনস্থির করে তথ্য উপাত্ত, রেফারেন্স সংগ্রহ এবং গবেষণাগারে মৌলিক গবেষণা সহ ন্যাচারাল বা সিনথেটিক এন্টিজেন, এন্টিবডির উৎপত্তি ইত্যাদি বিষয়ে প্রাথমিক কাজ করা হয় ভ্যাক্সিনের সম্ভাব্য ক্যান্ডিডেট বিষয়ে ধারণা পেতে। ভ্যাক্সিন উদ্ভাবনে ভ্যাক্সিন ক্যান্ডিডেট আর ভ্যাক্সিন এক কথা নয়। ভ্যাক্সিন ক্যান্ডিডেট হতে পারে অসংখ্য, এর মধ্য থেকে গুটি কয়েক ভ্যাক্সিন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কথিত আছে ড্রাগ উদ্ভাবনে ১০ হাজার গবেষণা থেকে মাত্র ৫ টির মত শেষতক উদ্ভাবন, সেফটি আর অনুমোদনের বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে বাজারে আসতে পারে। ড্রাগের মত ভ্যাক্সিনেও একই রকম অনিশ্চয়তা; অসংখ্য ভ্যাক্সিন ক্যান্ডিডেট থেকে হাতেগুনা কয়েকটি শেষতক রোগ দমনে ভূমিকা রাখতে পারে।
অনুসন্ধানী ধাপের পজিটিভ ইঙ্গিত উৎসাহ যোগায় রেগুলেটেড এনিম্যাল ট্রায়ালের প্রস্তুতি নিতে। রেগুলেটেড এনিমেল ট্রায়ালের জন্যে রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। এথিক্যাল কমিটির অনুমোদনের বিষয়টি এই ধাপ থেকে গুরুত্বপূর্ণ। কি ধরণের প্রাণীতে ট্রায়াল করা হবে, তাঁদের সংখ্যা, লাইসেন্স প্রাপ্ত মানসম্মত সাপ্লাইয়ের কাছ থেকে প্রাণী সংগ্রহ, প্রাণীগুলোর লালন পালন সঠিক পদ্ধতিতে হয়েছে কিনা, স্বাস্থ্য এবং এদের স্যাক্রিফাইজের নৈতিক আর আইনগত দিকগুলো অনুমোদন প্রক্রিয়ায় জরুরী বিষয়। এনিম্যাল ট্রায়ালের এই ধাপটিকে বলা হয় প্রি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। অসংখ্য ক্যান্ডিডেট ভ্যাক্সিন এই পর্যায়ে এসে থমকে দাড়ায় এন্টিবডি উৎপাদনে ব্যর্থতার কারণে। কোভিড ভ্যাক্সিন উৎপাদনের মূল মন্ত্রটা হচ্ছে SARS-CoV-2 ভাইরাসের এন্টিবডি তৈরির সক্ষমতা। এন্টিবডি উৎপাদনে ব্যর্থতা কিংবা নিরাপদ ভ্যাক্সিন উৎপাদনে কোন ত্রুটি এই পর্যায়ে ভ্যাক্সিন উদ্ভাবন প্রক্রিয়াকে ব্যর্থ করে দিতে পারে। রেগুলেটেড এনিম্যাল ট্রায়ালের আগে ছোট আকারে বিভিন্ন প্রাণীর উপর ট্রায়াল চালানো হয়ে থাকে। রেগুলেটেড এনিম্যাল ট্রায়ালের আগের পর্যায়ে ২-৩ টি প্রাণীর উপর পরিচালিত ট্রায়ালের উপর ভিত্তি করে ভ্যাক্সিন আবিস্কারের সরব ঘোষণা পদ্ধতিগতভাবে ভুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ। ভ্যাক্সিন ক্যান্ডিডেট সম্পর্কে ধারণা পেয়েই ভ্যাক্সিন আবিস্কারের ঘোষণা অপরিপক্ক আচরণ এবং দিনশেষে উদ্যোক্তাদের ভাবমূর্তির জন্যে ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ।
ইদুর, বানর সহ বিভিন্ন প্রাণীর উপর চালিত বড় আকারের এনিম্যাল ট্রায়াল বা প্রাক-ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সফলতার উপর ভিত্তি করে পিয়ার রিভিউড পর্যাপ্ত ডাটা, তথ্য প্রমাণ সমেত ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষের কাছে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্যে আবেদন করতে হয়। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অর্থ হচ্ছে মানব শরীরে পরীক্ষা নিরিক্ষা করা। নৈতিকতা আর মানুষের নিরাপত্তা জনিত কারণে এটি একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর ধাপ এবং ধাপটি আবার ৩ কিংবা ৪ পর্যায়ে বিভক্ত। প্রথম পর্যায়ে ১০০ জনের কম ছোট একটি গ্রুপে ট্রায়াল পরিচালনা করা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে আরও বেশী সংখ্যক মানুষের মধ্যে বয়স এবং স্বাস্থ্য ভিত্তিক বিবেচনায় ট্রায়াল চালানো হয়। তৃতীয় পর্যায়ে হাজার হাজার মানুষের মধ্যে ট্রায়াল পরিচালনা করা হয়। অনেক ভ্যাক্সিন উদ্ভাবনে চতুর্থ পর্যায়েও হিউম্যান ট্রায়াল চালানো হয়। চতুর্থ পর্যায়টি মূলত অনুমোদন আর লাইসেন্স প্রাপ্তির পর ভ্যাক্সিনের কার্যকারিতা কিংবা নিরাপত্তার ত্রুটি বিচ্যুতি বের করবার জন্যে ব্যবহার করা হয়।
স্বাভাবিক সময়ে অনুসন্ধানী বা এক্সপ্লোরেটরি থেকে প্রাক ক্লিনিক্যাল আর ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সব পর্যায়ে ডাটা সংগ্রহ, বিন্যাস, ব্যাখ্যা আর বিশ্লেষণ শেষে এক পর্যায় শেষ করে অন্য পর্যায়ে বা ধাপে যেতে হয় এবং এতে বছরের পর বছর লেগে যায়। কিন্তু কোভিড পরিস্থিতিতে ভ্যাক্সিন উদ্ভাবন সময় কমিয়ে আনার জন্যে একটি পর্যায়ের ট্রায়াল শেষে ডাটা কম্পাইল,বিশ্লেষণের জন্যে অপেক্ষা না করে পরবর্তী পর্যায় শুরুর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। জরুরী অবস্থায় সময় আরও কমিয়ে আনার চেষ্টায় আমলাতান্ত্রিক, প্রশাসনিক অনুমোদনগুলোকে দ্রুততর করা হলেও ভ্যাক্সিন বিষয়ে জনস্বাস্থ্যজনিত সেফটি বিষয়ে ছাড় দেবার সুযোগ নেই। প্রাক ক্লিনিক্যাল আর ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পর্যায়গুলো কম্প্রোমাইজ করার কোন সুযোগ নেই। একটি নেগেটিভ কন্ট্রোল, একটি পজিটিভ কন্ট্রোল আর একটি এক্সপেরিমেন্টাল মোট তিনটি খরগোসের উপর চালিত ট্রায়ালে ভ্যাক্সিন উদ্ভাবনের ঘোষণাটি দেশপ্রেমের দৃষ্টিকোণ থেকে আবেগতাড়িত একটি এপিসোড হলেও দিনশেষে বিজ্ঞান মনস্কতার বাস্তবতায় প্রাক ক্লিনিক্যাল আর ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সফলতা অর্জনের মাধ্যমেই এর সত্যিকারের আত্মপ্রকাশ নিহিত। সঠিক বায়ো সেফটি লেভেলের আন্তর্জাতিক মানের ল্যাব অবকাঠামো, ট্রায়াল সফল হলে ডাটাগুলোর আন্তর্জাতিক পিয়ার রিভিউড গ্রহণযোগ্যতা, উৎপাদনে যাবার বিশাল কর্মযজ্ঞ, সর্বোপরি মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ইনভেস্ট করার ঝুঁকি নির্ভর কঠিন ভ্যাঞ্চার উতরে গিয়েই সাফল্যকে ধরতে হবে।
ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সফলতার পর ভ্যাক্সিন উদ্ভাবনকারী রেগুলেটরি রিভিউ শেষে লাইসেন্সের জন্যে আবেদন করবে। কোভিড পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সরকার এই পর্যায়ে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমিয়ে নজিরবিহীন দ্রুততার সাথে ভ্যকাসিনের অনুমোদন দিতে আইনকানুন শিথিল করেছে।
অনুমোদনের পর উৎপাদন। এটি বিশাল এক কর্মযজ্ঞ। গ্লোবাল ফার্মা জায়েন্টগুলোর এই ক্ষেত্রে সক্ষমতা থাকলেও তৃতীয় বিশ্বের ছোটখাট ফার্মাদের জন্যে এটি বিরাট এক চ্যালেঞ্জ। উৎপাদন অবকাঠামো, মেশিনারি, দক্ষ জনশক্তি, পরামর্শক, সাপ্লাই চেইন ইত্যাদি ইস্যুতে সময়মত সরকারি সাহায্য কিংবা জয়েন্ট ভ্যাঞ্চার সহযোগীর সহযোগিতা ছাড়া পুরো সফলতাই থমকে যেতে পারে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি, মুনাফা আর পুজিবাদের ভ্যাক্সিন থেকে সুবিধে আদায়ের চেষ্টা পুরো প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তার করবে। উৎপাদনে লাইসেন্স প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরধারী থাকে। উৎপাদন প্লান্টের সক্ষমতা, বিভিন্ন রেগুলেটরি সনদ, কর্মীদের দক্ষতা ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়ে অবস্থান হতে হবে সন্তোষজনক। গবেষণাধর্মী এবং একই সাথে উৎপাদন সক্ষমতায় অগ্রগামী আন্তর্জাতিক ফার্মা কোম্পানিগুলো অনেকটাই সুবিধেজনক অবস্থানে থাকে।
উৎপাদনের পর মান নিয়ন্ত্রণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। ইতিমধ্যে বিনিয়োগকৃত বিপুল অর্থের জন্যে এটি ঝুঁকিপূর্ণ একটি ধাপ। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফেজ ৪ এর মাধ্যমে উৎপাদিত ভ্যাক্সিনের কার্যকারিতা পরীক্ষা নিরিক্ষা করা হয়ে থাকে। ভ্যাক্সিনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া রিপোর্টিং সিস্টেম এবং ভ্যাক্সিন সেফটি ডাটা লিঙ্কের মাধ্যমে মান নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
ভ্যাক্সিনের সুখবরের জন্যে বিশ্ববাসী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে এবং এই সুখবরটি পাওয়া চাই যত শীঘ্র সম্ভব। তবে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে এর সেফটি আর কার্যকারিতার সাথে সমঝোতা করার সুযোগ নেই। ধরুন একটি ভ্যাক্সিনে এক হাজার জনের মধ্যে একজন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় গুরুতর অসুস্থ হলেন, তার অর্থ হচ্ছে ১০ কোটির মধ্যে প্রায় ১ লক্ষ মানুষের জীবনহানির আশংকা। এই অবস্থায় ভ্যাক্সিনের অনুমোদন স্বাভাবিকভাবেই আটকে যাবে। কোন কোন ক্ষেত্রে ভ্যাক্সিন সুস্থ করার চেয়ে সংক্রমণকে উস্কে দেয়, এই ফেনোমেননকে বলে এন্টিবডি ডিপেন্ডেন্ট এনহেন্সমেন্ট। ভ্যাক্সিন উদ্ভাবনে অসংখ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয় যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে। এন্টিবডির কার্যকারিতার মেয়াদ, সিনিয়র সিটিজেনদের দুর্বল ইমিউনিটি, একটি ধাপে সফল হলেও অন্য ধাপে অহরহ ব্যর্থতার প্রেক্ষাপট ইত্যাদি অসংখ্য বাধা বিপত্তি পেরিয়ে সফলতার অনিশ্চিত গন্তব্যে হাঁটতে হয়। দেখা গেল খরগোশের উপর শর্টকাট ট্রায়ালে একটি পজিটিভ ইঙ্গিত পেলেন, ইদুরে উপর বড় আকারের রেগুলেটেড ট্রায়ালে কিছুই পেলেন না, আবার ইদুরে সফল হলেও বানরে গিয়ে আটকে গেলেন তখন হিউমেন ট্রায়াল পর্যন্তই যেতে পারবেন না। আবার হিউমেন ট্রায়ালে গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া জনিত কারণে পিছিয়ে আসতে হল বা প্রোজেক্ট বাতিল করতে হল। পোলিও ভ্যাক্সিনের ক্ষেত্রে ১৯৫৫ সালে কাটার ইন্সিডেন্টে ভ্যাক্সিন দিতে গিয়ে একটিভ পোলিও ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল ২৫০ জন যার মধ্যে অনেকেই পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হন, কয়েকজন মারা যায়। বিনিয়োগকৃত অর্থ উঠে আসার অনিশ্চয়তা আরেকটি বড় ইস্যু। মিলিয়ন্স ডলার এমনকি বিলিয়ন ডলার খরচ করে ফেলে সফলতার প্রান্তে এসে গিয়ে দেখলেন আপনার আগে অন্য এক প্রতিযোগী আগে এসে মার্কেট নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিল। এরকম ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ পরিস্থিতির কারণেই ধনী দেশগুলো এবং বিল গেটসের মত ধনীরা এগিয়ে এসেছে আর্থিক সাহায্য নিয়ে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বরাতে জানা যায় ভ্যাক্সিন নিয়ে বিশ্বব্যাপী দেড় ডজন প্রোজেক্ট অগ্রগতির গুরুত্বপূর্ণ ধাপ অর্থাৎ ক্লিনিক্যাল পর্যায়ে রয়েছেন। প্রাক ক্লিনিক্যাল পর্যায়ে আছে অসংখ্য। শ’খানেক সক্রিয় প্রোজেক্টের মধ্যে প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের খবরে আপাতত আগ্রহ নেই, এখন গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মানব ট্রায়ালের খবরাখবর এবং এর অগ্রগতি। যারা প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদন ধাপ পর্যন্ত আসতে পারেননি অর্থাৎ একেবারেই প্রাথমিক স্তরে আছেন, বিভিন্ন স্তরে নিজেদের কারিগরি আর আর্থিক সক্ষমতা, লজিস্টিক আর ঝুঁকির হিসেব না করেই ভ্যাক্সিন আবিস্কারের ঘোষণা দিয়ে বসে আছেন, মাস ছয়েকের মধ্যে ভ্যাক্সিন উদ্ভাবনের আশাবাদের কথা বলে চলেছেন, তাঁদের জন্যে শুভকামনা। সময়ই বলে দিবে এই ধরণের আগাম ঘোষণা কতোটা বাস্তবতা ভিত্তিক আন্তরিক গবেষণাধর্মী আর কতোটা জেনেশুনেই রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক আর মিডিয়ায় প্রচারণা সর্বস্ব চমক। করোনাকালের দীর্ঘ সময় বাংলাদেশ ব্যস্ত থাকছে স্বাস্থ্যখাতের ভয়াবহ দুর্নীতির নানা এপিসোডে। এর পাশাপাশি মাঝে মধ্যেই জাতি প্রি-ম্যাচুউরড বৈজ্ঞানিক আবিস্কারের তথ্যে উজ্জীবিত হচ্ছে, মন খারাপ করছে, পক্ষে বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছে, দিন শেষে বিজ্ঞান সাংবাদিকতার নামে রাজনৈতিক ভাষ্য হচ্ছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছেনা। ফ্যাক্ট নয় আবেগে ভাসতেই আমাদের আনন্দ, ঠকতে পছন্দ করি আবার যেচে ঠকে এসে কখনো বুদ্ধিজীবি কখনো দেশপ্রেমিকের অভিনয় করি। বাল্যকাল থেকেই শুনছি “বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ”। এখন এর বিপরীতে আবেগের তোড়ে আমরা বেগটাকেই থামিয়ে দিচ্ছি। ভারী ভারী টেকনিক্যাল শব্দ চয়নে তাজ্জব বনে গিয়ে দেশপ্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকি, ফ্যাক্ট আর সম্ভাব্যতা নিয়ে ভাবি না বরং বিজ্ঞান চর্চার স্বাভাবিক নিয়মে ফ্যাক্ট নিয়ে যারা ভাবে তাঁদের দেশপ্রেমটাকে কটাক্ষ করি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কোভিড সংকটকালে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি কেমন করে বাংলাদেশে চিকিৎসা, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি জনকল্যাণমুখী হওয়ার চাইতে স্বার্থান্বেষী চক্রের স্বার্থমুখী। জনকল্যাণমুখী বিজ্ঞান গবেষণায় জাতি অবশ্যই কৃতার্থ থাকবে।
প্রসঙ্গে ফিরে আসি; যে প্রোজেক্টগুলো এই মুহূর্তে মানব ট্রায়ালের ধাপ অতিক্রম করছে সফলতার সাথে তাদের খবর শুনতে আগ্রহী বৈশ্বিক জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশে সংক্রমণের তীব্রতায় প্রতিদিনই হারাচ্ছি অসংখ্য পরিচিত জন। সাতসাগরের পার থেকে আজকাল আমাদের প্রতিটি সকালের শুরু বাংলাদেশের খবরে এক রকম উৎকণ্ঠা নিয়ে। পরিবারে সদস্য, বন্ধু বান্ধবরা যখন আক্রান্ত বিশেষ করে যাদের হাসপাতালে যেতে হয়, ফলশ্রুতিতে পারিবারিক বিপর্যয়ের কঠিন পরিস্থিতিটি ভুক্তভোগী ছাড়া অনুধাবনযোগ্য নয়। জীবনের কঠিনতম এই অধ্যায়ে আমরা চেয়ে আছি চাতক পাখির মত কার্যকরী একটি ভ্যাক্সিনের আশায়।
ভ্যাক্সিন উদ্ভাবনে বেশ কয়েকটি প্রোজেক্ট খুব সম্ভাবনা নিয়ে এগুচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের লাইফ সায়েন্স গবেষণার এপেক্স বডি ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথ (এনআইএইচ) এই মুহূর্তে ১৮ টি বায়োফার্মা কোম্পানির সাথে কোভিড ড্রাগ আর ভ্যাক্সিন উদ্ভাবনে কাজ করছে। ভ্যাক্সিন উদ্ভাবনে বৈশ্বিক তৃষায় কিছু আইন কানুন শিথিল হয়েছে। কোভিড ১৯ দমনে ভ্যাক্সিনের কার্যকারিতা ৫০% হলেই ব্যবহারের অনুমোদন দেবার নতুন গাইডলাইন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ গত ৩০শে জুন।
ভ্যাক্সিন উদ্ভাবনে দরকার বিপুল পরিমান অর্থ। যুক্তরাষ্ট্রের সরকার উদ্ভাবনের দৌড়ে এগিয়ে থাকা তিনটি ভ্যাক্সিন ক্যান্ডিডেটকে ফেজ ৩ হিউম্যান ট্রায়ালে আর্থিক সহায়তা করতে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল ভিত্তিক কোম্পানি মডার্না’র ম্যাসেঞ্জার আরএনএ ভ্যাক্সিন mRNA-1273, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি এসট্রাজেনেকার যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত ভ্যাক্সিন AZD1222 (ChAdOx1 nCoV-19) আর ফাইজার-বায়ো এন টেকের BNT162 ভ্যাক্সিন এই সহায়তা পেতে যাচ্ছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় আর এসট্রাজেনেকার ভ্যাক্সিনটিকে এই মুহূর্তে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় মনে করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বিলিয়ন ডলার চুক্তি আর যুক্তরাজ্যের সাথে শত শত মিলিয়ন ইউরোর চুক্তি বিনিয়োগ সমস্যা সমাধান করেছে। ম্যাসিভ উৎপাদনে এসট্রাজেনেকার মত জায়ান্ট ফার্মা কোম্পানির সক্ষমতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এই তিনটি কোম্পানি ভ্যাক্সিন উদ্ভাবনে ফেজ ২, ৩ বা ২-৩ এর মাঝামাঝি রয়েছে।
চীনাকোম্পানি CanSino Bilogistics এর ভ্যাকসিন AdV5-nCov এর জন্যে কানাডা সরকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমতি দিয়েছে ডালহৌসী বিশ্ববিদ্যালয়ের কানেডিয়ান ভ্যাক্সিনোলজি সেন্টারে মে মাসে। কিন্তু কানাডা এখনো ভ্যাক্সিন ক্যান্ডিডেটটি হাতে পায়নি। সম্ভবত Huawei এর প্রধান অর্থ কর্মকর্তা মেং ওয়ানজু ইস্যুতে রাজনৈতিক কারণে বিলম্ব হচ্ছে। কিন্তু চীন নিজে জুনের শেষদিকে তাঁদের সেনাবাহিনীকে এই ভ্যাক্সিন ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে।
রাশিয়া ইতিমধ্যেই একটি ভ্যাক্সিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষ করেছে। রাশিয়া বলছে ভ্যাক্সিনটি কাজ করছে এবং ব্যবহারের নিরাপদ। ভ্যাক্সিনের অনুমোদন আর উৎপাদন প্রক্রিয়া নিয়ে অবশ্য এখন পর্যন্ত বিস্তারিত জানা হায়নি।
আমরা আশা করছি এই বছরের শেষ নাগাদ ভ্যাক্সিনের মুখ দেখবো, হঠাৎ করেই এক সকালে বস্তুনিষ্ঠ সুখবর আমাদের আশ্বস্ত করবে। তবে ভ্যাক্সিনের বৈশ্বিক চাহিদা পূরণে আমাদের ২০২১ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে। ভ্যাক্সিন আসা পর্যন্ত আমাদের হাতে ভ্যাক্সিনের মতই কার্যকরী উপায় হচ্ছে সংক্রমণের চেইনটি ভেঙ্গে দেওয়া। কঠোরভাবে লকডাউন পালন, সামাজিক শারীরিক দূরত্ব সহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাই হচ্ছে সংক্রমণের চেইনটি ভেঙ্গে দেবার আপাতত একমাত্র অস্ত্র। ঢাকায় আর অন্যান্য শহরে এলাকাভিত্তিক লকডাউন যেখানে কঠোর ছিল সফলতা সেখানে দৃশ্যমান এবং এটি বৈশ্বিকভাবেও প্রমাণিত।
লেখকঃ কলামিস্ট এবং মাইক্রোবিয়াল বায়োটেক বিষয়ে বহুজাতিক কর্পোরেটে ডিরেক্টর পদে কর্মরত।
সিএ/এসএস
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন