কোভিড যুদ্ধ কৌশলে দ্বান্দ্বিকতা
কোভিড-১৯ গত ৫ মাস যাবৎ প্রলয় নাচনে ব্যস্ত রেখেছে মানব সভ্যতাকে। শুরুতে ধারনা করা যায়নি কি পরিনতির দিকে অকস্মাৎ ধাবিত হচ্ছে জ্ঞানীগুণী মানুষদের পরিশ্রম আর আত্মত্যাগের বিনিময়ে গড়ে উঠা বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি নির্ভর বর্তমান বিশ্ব। চীন থেকে বের হয়ে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ আর আমেরিকায় চালানো তাণ্ডবে জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি সবই বিধ্বস্ত। আজতক প্রায় ৪০ লাখ সংক্রমিত মানুষ আর প্রায় পৌনে ৩ লাখ প্রাণহানির পর উত্তর গোলার্ধ থেকে ক্রমশ দক্ষিণমুখী হচ্ছে কোভিড প্রলয়। উত্তরের সর্বনাশের ধারা দক্ষিণ গোলার্ধের এশিয়া আফ্রিকায় একই মাত্রায় থাকে কিনা কিংবা প্রবাহিত ঘূর্ণিঝড়ের সতর্ক সঙ্কেতের মত ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে কিনা এরকম আশংকা আর প্রত্যাশার মধ্যেই কোভিড যুদ্ধে দেশে দেশে রণ কৌশলে পরিবর্তন এসেছে। মার্চ আর এপ্রিলে লকডাউনের সাজসাজ রবের সেই পরিবেশ অনেকটাই প্রশমিত; এই মে মাসে এসে কেমন জানি আপোষকামিতার অবগুণ্ঠনে আশ্রয় নিতে চাইছে রণকৌশল। তাণ্ডবে পিকে উঠে নামার সময় এসেছে যাদের, তাঁদের দেখাদেখি যারা এখনো পিকে আছে বা পিকে উঠেনি তাদেরও গা ছাড়া ভাবে কোভিড যুদ্ধে আমাদের ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। অর্থনীতির অনিশ্চিত গন্তব্য সম্ভবত ক্লান্তির সবচেয়ে বড় কারণ।
এই ক্লান্তি আমাদের চিন্তা চেতনায়, সিদ্ধান্তে এমনকি মনুষ্যত্বে একটা দ্বান্দ্বিক সংকট তৈরি করছে। এই সমস্যাটি উত্তর দক্ষিণের সব দেশেই চোখে পড়ছে। মানব সমাজে মানবিকতা আর মনুষ্যত্বের অনুকূলে আর প্রতিকূলে লড়াইয়ে ক্ষেত্রটি সব সময় সক্রিয় থেকেছে এবং এই দ্বন্দ্বে দিনশেষে অবশ্য বিজয় মনুষ্যত্বের পক্ষেই থেকেছে। বাংলাদেশ সহ বিশ্বব্যাপী কোভিড যুদ্ধে ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী পুলিশ সহ দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত কোভিড সেনাদের আত্মত্যাগ, অকুতোভয় চিত্তে লড়াইয়ের অসংখ্য এপিসোডের পাশাপাশি কিছু নোংরা, হীনমন্যতা আমাদের ভাবিত করেছে বটে। ব্রাজিলে পাবলিক বাস থেকে কোভিড ভয়ে নার্সদের নামিয়ে দেবার ঘটনা, দেশে দেশে কোভিডে মৃতদের সৎকারে অসহযোগিতা আমরা কম বেশী জানি। বাংলাদেশে কোভিডে মৃত বাবার লাশ দাফনে পাড়া প্রতিবেশীর বাধার মুখে সারা রাত সন্তানের গ্রামে গ্রামে অসহায়ের মত ঘুরে বেড়াবার মর্মস্পর্শী কাহিনী, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যে ডাক্তার সেবা দিল কোভিডে, সেই ডাক্তার নিজেই যখন কোভিডে আক্রান্ত হল তাঁর প্রতি প্রতিবেশীদের নির্দয় আচরণ, কোভিডে অসুস্থ হবার পর স্ত্রী, সন্তান কর্তৃক পরিত্যাক্ত হয়ে বোনের বাড়ীতে করুণ মৃত্যুর নানান উপাখ্যান মানব সভ্যতার গায়ে দগদগে ক্ষতচিহ্ন হিসেবে থেকে যাবে যুগ থেকে যুগান্তরে। শিক্ষা সমাজ সভ্যতার মৌলিক কাঠামো। অশিক্ষা আর কুশিক্ষা সভ্যতার ভিত্তিটাকে দুর্বল করে দেয়।
একজন মৃত মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস, হাঁচি কাশির কোন কারবার নেই, তাই একজন জীবিত মানুষের চাইতে তো মৃতজনের সংক্রমণে অংশ নেবার সম্ভাবনা অনেক কম। শবদেহ পরিষ্কার আর আচ্ছাদিত করেন যারা তাঁদেরকে দায়িত্ব পালনকালে যে কোন তরলের সংস্পর্শ থেকে বাঁচবার জন্যে প্রয়োজনীয় পিপিই পরেই করতে হয়। এই পর্বের পর থেকে দাফন পর্যন্ত ঝুঁকির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এই বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বার বার জানানোর পরেও এবং মৃতদেহ সৎকার করতে গিয়ে সংক্রমণের উদাহরণ না থাকার পরেও কোভিডে মৃতদের সৎকারে সামাজিক সমস্যাগুলো মূলত অজ্ঞতার দায়, কুসংস্কারের দায়। এই সমস্ত বিচ্ছিন্ন ঘটনার ত্বরিত সমাধানে আবার পুলিশ সহ সমাজের বিবেকবান অনেকেই এগিয়ে এসেছেন জাতি ধর্ম নির্বিশেষে আর এখানেই মানবতার শেষ হাসিটুকু আমাদের প্রেরণা যোগায়।
চোখের সামনে একটি মশা আমাদের উদ্বিগ্ন করে, আবার পেছনে হাতির উপস্থিতি আমরা টের পাইনা। এই মানবিক চরিত্রের রূপায়নে আমরা কোভিড সংকটে জনারণ্যে মিশতে ভীত না হলেও কেউ কোভিড আক্রান্ত হয়েছে জানলে অতি প্রতিক্রিয়া আর ভয়ে এতটাই অমানবিক হয়ে যাই যে কোভিড আর ভীতিকর কুষ্ঠ রোগের পার্থক্য ভুলে যাই। মাইকোব্যাক্টেরিয়াম লেপ্রী জনিত কুষ্ঠ, মাইকোব্যাক্টেরিয়াম টিউবারকিউলোসিস সৃষ্ট যক্ষ্মা, ভ্যারিওলা ভাইরাসের গুটি বসন্তে আর ভিব্রিও কলেরা নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত কলেরার সাথে লড়াই করে বিজয়ী যে জাতি, সেই জাতির SARS-CoV-2 ভাইরাস সৃষ্ট কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত মানুষের প্রতি অমানবিক আচরণে থমকে দাড়াতেই হয়। বিশ্বব্যাপী প্রায় লাখখানেক স্বাস্থ্যকর্মী সেবা দিতে গিয়ে কোভিডে আক্রান্ত; অসংখ্য ডাক্তারের আত্মত্যাগের পাশাপাশি মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন ২৫০ জন নার্স। এই সমস্ত ফ্রন্টলাইন যোদ্ধাদের প্রতি সন্মান প্রদর্শন তো সভ্যতার দায়। স্বার্থপরতা আর অজ্ঞতার সংমিশ্রনজনিত মানবিক দুর্বলতা যুগে যুগে বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় দ্বান্দ্বিক অবস্থান তৈরি করলেও এই কোভিড সংকটে এই দ্বন্ধের বিশাল ব্যাপ্তি আমাদের বিচলিত করছে। সমসাময়িক বিশ্ব সভ্যতায় অর্থনীতির বিশালত্ব, নির্ভরশীলতার সংস্কৃতি আর পারস্পরিক প্রতিযোগিতা কৌশল নির্ধারণে দ্বিধার মূল কারণ।
এই মে মাসে এসে দেখলাম অনেক দেশই লকডাউনের চাপটা নিতে পারছে না। নিউ ইয়র্ক সহ যুক্তরাষ্ট্রে অব্যাহত মৃত্যুর মিছিলের পরেও ক্রমশ লকডাউন শিথিলতার দিকে এগুচ্ছে মার্কিন প্রশাসন। প্রশাসন হয়তো ভাবছে পিকে উঠে নামার এই সময়ে লকডাউন শিথিল করে অর্থনীতি রক্ষা করাটা জরুরী। সবকিছুতেই ট্রাম্পের নিজস্ব একটা মারমুখী স্টাইল আছে, করোনা সংকটেও এর ভিন্নতা নেই, তাছাড়া নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মত জটিল হিসেব-নিকেশ তো রয়েছেই। গণতন্ত্র, মানবিকতা আর মাল্টিকালচারালিজমের বৈশ্বিক রোল মডেল কানাডা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশী হলেও নিজস্ব স্টাইলে চলতে পছন্দ করে। কোভিড ব্যবস্থাপনায় উপচে পড়া রোগীর হাত থেকে স্বাস্থ্যখাতকে রক্ষার কৌশলে ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফটা যতটুকু সম্ভব চাপিয়ে রেখেছে। অনেক প্রদেশে পিকটা নীচের দিকে নেমে আসছে। কুবেক প্রদেশ আর মন্ট্রিয়লে অবস্থা ভাল নয়। করোনা সংকটে জনগণকে অর্থনৈতিক দুরবস্থা থেকে রক্ষার চেষ্টায় কানাডা সরকার বৈশ্বিক উদাহরণ হয়ে আছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির করুণ অবস্থা থেকে জনগণকে রক্ষার জন্যে চিন্তিত প্রশাসন। অনেক প্রদেশই লকডাউন শিথিলতার দিকে এগুচ্ছে। মন্ট্রিয়লের অবস্থা খুব খারাপ থাকায় শিথিলতার ঘোষণা দিয়ে আবারো পিছিয়ে যেতে হয়েছে; মে মাসের শেষের দিকে শিথিলতার বিষয়টি ভাবছে সরকার। সামনে অর্থনীতির যে সংকট অপেক্ষা করছে, সেই ভয় এবং তার সাথে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির বাস্তবতায় লকডাউন কঠোর আর শিথিলের দ্বান্দ্বিক অবস্থানে ঘুরপাক খাচ্ছে সবাই। কোটি কোটি মানুষ চাকুরী হারিয়েছে, আশঙ্কা করা হচ্ছে এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে ১৬০ কোটি মানুষ চাকুরী হারাবে। শুধু এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্রে চাকুরী হারিয়েছেন আড়াই কোটি মানুষ। একজন মাইক্রোবায়োলজিস্ট হিসেবে কোভিডের বৈশ্বিক মহামারি থেকে বাঁচতে হলে কঠোর লকডাউনের এডভোকেসীর পক্ষে থাকার পরেও একজন ইন্ডাস্ট্রিয়াল মাইক্রোবায়োলজিস্ট হিসেবে কর্পোরেট ব্যবসা বানিজ্য আর হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান, মুখ থুবড়ে পড়া অর্থনীতির ভয়াবহ বিষক্রিয়া থেকে জগৎ-সংসারকে বাঁচাবার বিষয়টি যখন মাথায় আসে তখন লকডাউন শিথিলতার প্রতি দুর্বলতা স্পষ্ট হতে থাকে।
উত্তর থেকে দক্ষিণমুখী করোনার আগ্রাসনে জাতিসংঘ আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আশংকা শুধু আফ্রিকাতে আগামী একবছরে কোভিডে আক্রান্ত হবে সাড়ে ৪ কোটি মানুষ আর মৃত্যু হবে ২ লাখ মানুষের। অন্যদিকে ভেঙ্গে পড়া অর্থনীতির করালগ্রাসে দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হবে ৮২ কোটি মানুষ। এই উভর সংকটে ব্যাক্তি চিন্তা থেকে রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণে সিদ্ধানহীনতা, বার বার রণকৌশল বদলে চাপ, গরীব দেশগুলোর দিশেহারা অবস্থায় সিদ্ধান্তের সঠিক বেঠিকের দোলাচলে পুরো বিশ্ব। এই অবস্থায় লকডাউন শিথিলতার সদা সমালোচনা মুখর বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থাকে অতি সম্প্রতি মনে হচ্ছে কৌশল বদলানোর দিকে ঝুঁকছে, শর্ত সাপেক্ষে লকডাউন শিথিলতার কিছু নির্দেশনায় এগিয়ে এসেছে। পশ্চিমের উন্নত দেশগুলোতে কিংবা জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া মত দেশগুলোতে শর্ত মানার সক্ষমতা আর অন্যদিকে আফ্রিকা, বাংলাদেশ, ব্রাজিল আর ভারতের মত দেশগুলোতে শর্ত মানার শৈথিল্যে পরিণতির ভিন্ন প্রেক্ষাপট তৈরি করে।
কানাডায় কোভিড সংকটে যারা চাকুরী হারালেন, ব্যবসা হারালেন, আয় হারালেন, অধিকাংশের সাত দিনের মাথায় তাঁদের সংশ্লিষ্ট ব্যাংক একাউন্টে সংকট মোকাবিলার জন্যে সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুসারে টাকা জমা হয়ে গেল; সংসার চালানোর আর্থিক সংকট মোকাবিলা করতে হয়নি কাউকে। অন্যদিকে যতটুকু জানা যাচ্ছে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিশেষ করে বড় বড় শহরগুলোতে ভিক্ষুকের সংখ্যা ভয়াবহ আকারে বাড়ছে, একই চিত্র ঢাকায়। বাংলাদেশে দিনে এনে দিনে খায় লোকের সংখ্যা দু কোটি। এদের অনেককেই বাধ্য হয়ে হাত পাততে হচ্ছে। কর্মহীন, আয়হীন অবস্থায় গরীব দেশগুলো তো বটেই, কানাডার মত ওয়েলফেয়ার রাষ্ট্রগুলো কিংবা উন্নত দেশগুলোর পক্ষেও বেশীদিন চলা সম্ভব নয়। ফলে চাপ বাড়ছে অর্থনীতির চাকা ধীরে ধীরে সচল করবার জন্যে।
পশ্চিমা দেশগুলোতে লকডাউনে ঋতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। হিমাঙ্কের নীচের তাপমাত্রা লোকজনকে ঘরে থাকতে সরকারী নির্দেশনার প্রয়োগে খুবই সহায়ক। শীতের দেশগুলোতে লোকজন চাতক পাখির মত তাকিয়ে থাকে সামারের কয়েক মাসের উষ্ণ, আরামদায়ক আর প্রাণখোলা আবহাওয়ার জন্যে। ব্যবসা বানিজ্য, পর্যটন, বিনোদন, অবকাশ উদযাপন সবই মূলত সামার কেন্দ্রীক। সামার ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে বাইরে যেতে। গত পরশু কাজের দিনে ড্রাইভে বের হয়েছিলাম মাই সিটি মন্ট্রিয়লের অবস্থা দেখতে। পার্কে পার্কে লোকজনের উপস্থিতি দেখে মনে হচ্ছিল মন্ট্রিয়লের মত কোভিডে-১৯ দ্বারা হার্ডহিট শহরের পক্ষেও সামারে বা গ্রীস্মকালীন আবহাওয়ায় বাইয়ে যাবার আহ্বান উপেক্ষা করা কঠিন। ফলে সরকারকে কৌশল নির্ধারণে ভাবতে হচ্ছে কিছুটা খুলে দিয়ে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রেখে কিভাবে কোভিড কর্তৃক জীবনের সর্বনাশ আর অর্থনীতির সর্বনাশের মাঝে একটা ভারসাম্য তৈরি করা যায়। কুবেক প্রদেশের শিথিলতার কৌশল ইতিমধ্যেই সমালোচিত। এই কৌশলের ফলাফলটা কি দাড়ায় তার জন্যে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। দ্বিতীয় ঢেউের ধাক্কায় কোভিড আমাদের আরো কাহিল করে কিনা কিংবা এই চেক এন্ড ব্যালেন্সের কৌশল “মৃত্যু/স্বাস্থ্য বনাম বিশ্ব অর্থনীতি রক্ষার” কঠিন চালে উতরে যাবার পথ তৈরি করে কিনা জানতে বা আভাস পেতে হলে জুলাই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে।
বাংলাদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় আর অর্থনৈতিক প্রেক্ষিতে লকডাউনে শিথিলতা বা উদাসীন্য কিংবা আকস্মিক কোন ঘটনায় লকডাউন ভেঙ্গে ফেলার বিষয়ে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। এটাই আমাদের বাস্তবতা আর কোভিড যুদ্ধে এই বাস্তবতা মনে রেখেই সম্ভবত প্রশাসন নীতি নির্ধারণ করছে। সরকারী তথ্য উপাত্তে বাংলাদেশে কোভিড পরিস্থিতি তুষের আগুনের মত ধিকিধিকি করে জ্বলছে। পশ্চিমাদের মত এক্সপোনেনশিয়াল ফেজ বা পিকে উঠবার পরিস্থিতির চেনা রূপটি এখানে অনেকটাই ভিন্নতর। টেস্টের সীমাবদ্ধতা একটি কারণ হলেও তথ্যের বিশ্লেষণে পরীক্ষা বনাম প্রাপ্ত সংক্রমণের হার অনেকটাই উচুতে, প্রায় ১২-১৩%। বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৪৫% এর বয়স তিরিশের উপরে এবং এদেরকে সংক্রমণের মোটামুটি টার্গেট গ্রুপ ধরলে মোট টার্গেট জনসংখ্যা প্রায় ৮ কোটি। এই ৮ কোটির ১২% হলে প্রায় কোটি লোকের বর্তমান বাস্তবতায় তাত্ত্বিকভাবে কোভিডে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা। লকডাউন কঠোর বা শিথিলতা বা অন্যান্য ফ্যাক্টরের কারণে এই তাত্ত্বিক সংখ্যার উঠানামা হতে পারে। বাংলাদেশে সংক্রমণের মাধ্যমে এন্টিবডি তৈরি করে হার্ড ইমিউনিটির কথা যারা ভাবছেন তাঁদের জানা উচিত ভ্যাকসিন ছাড়া এটি সম্ভব নয়। তাছাড়া বাংলাদেশের জনসংখ্যার বিশালত্ব আর সফল হার্ড ইমিউনিটিতে ইমিউন হবার শতকরা হারের অতি উচ্চ টার্গেট তাঁদেরকে হতাশ করতেই পারে।
বাংলাদেশে কোভিড পরিস্থিতি দ্রুত পিকে উঠবার চাইতে তুষের আগুনের মত জ্বলে থাকবার প্রবণতা সবচেয়ে বেশী চিন্তার কারণ, এতে সংকট দীর্ঘ মেয়াদে পেইন দিতে থাকবে। আমাদের বড় পেইনটা হচ্ছে অভাব আর অভাবের সাথে দীর্ঘ লড়াইয়ের অক্ষমতা। পশ্চিমাদের সাথে আমাদের আইন মানা, পেটের দায় ইত্যাদি নানান সূচকে পার্থক্যের পাশাপাশি কোভিড যুদ্ধ কৌশলেও বিরাট পার্থক্য। পশ্চিমারা পিক থেকে নামার সময় যেখানে আস্তে আস্তে শিথিলতা আনতে চাচ্ছে বাংলাদেশ সেখানে পিকে উঠার আগেই শিথিলতার দিকে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে অবশ্য যুক্তি হচ্ছে এমনিতেই যখন সবকিছু শিথিলভাবে মানা হচ্ছে তখন প্রাতিষ্ঠানিক ভাবেই এটা করা হলে ক্ষতি কি?এক্ষেত্রে পশ্চিমাদের মত “মৃত্যু/স্বাস্থ্য বনাম অর্থনীতি রক্ষা” কৌশলের পরিণতি আমাদের কতোটা বিপদে ফেলবে বা আস্তে আস্তে উত্তরণের পথ করে দেবে দেখার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে।
ইতিহাস সাক্ষ্য যুদ্ধ সহ বিশ্বের অনেক বড় বড় অর্থনৈতিক সংকটে অন্যান্য খাতের মত স্বাস্থ্যখাতও বিপর্যস্ত হয়েছিল অনেকবার কিন্তু এবার পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। এবারের সংকটটির সুচনা স্বাস্থ্যখাত দিয়ে এবং স্বাস্থ্যখাতের এই তীব্র সংকটটি বিশ্বায়নের সুযোগে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতি। কোভিড সংকটের দীর্ঘায়িত এপিসোডটি স্মরণকালের ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের সুচনা করতে যাচ্ছে যাতে বেকারত্ব, দুর্ভিক্ষ সহ দুর্বিষহ সামাজিক, মানসিক এবং শারিরিক প্রতিক্রিয়ায় অভিঘাতে অস্থির করে তুলবে বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থা। স্বাস্থ্য আর জীবন রক্ষার প্রায়োরিটিকে যেমন অর্থনীতির জন্যে বলি দেয়া যাবেনা তেমনি অর্থনীতির সংকটকেও উপেক্ষা করা যাবে না। শ্যাম রাখি না কূল রাখি এই অবস্থায় আমাদের শেষতক মানবিকতার পথেই হাঁটতে হবে এবং এটাই সভ্যতার শিক্ষা। অর্থনীতির পাশাপাশি কোভিড সংকটে এখন সবচেয়ে অমানবিক আর ক্ষতিগ্রস্ত খাত হতে আমাদের দৈনিক স্বাস্থ্য সেবা; বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন ক্যান্সার, হৃদরোগ, কিডনি রোগ সহ বিভিন্ন রোগের রোগীরা। দৈনিক স্বাস্থ্য সেবার এই করুণ অবস্থা থেকে উত্তরণে জরুরী ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কোভিড ব্যবস্থাপনায় নিয়ন্ত্রণ হারানো চলবে না আর উপেক্ষা করা যাবে না জনগণের স্বাস্থ্য আর মৃত্যুর ঝুঁকিকে । শিথিলতার পথে যেতে হলে চেক এন্ড ব্যালান্সের মাধ্যমেই করতে হবে। নিউজিল্যান্ড আর কোরিয়ার সফলতার উদাহরণ তো আমাদের সামনেই রয়েছে।
লেখকঃ কলামিস্ট এবং মাইক্রোবিয়াল বায়োটেক বিষয়ে বহুজাতিক কর্পোরেটে ডিরেক্টর পদে কর্মরত এবং সিবিএনএ-এর উপদেষ্টা।
সিবিএনএ/এসএস
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে cbna24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন