ক্লেমি চার্চিল থেকে রেণু মুজিব |||| ড. শোয়েব সাঈদ
বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, রাজনৈতিক নেতৃত্ব আর মানবকল্যাণ নির্ভর এই মানবসভ্যতা বহু কীর্তিমান নারী-পুরুষের অবদানে এগিয়ে চলেছে অবিরত। সভ্যতার এই ক্রমশ উত্থানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা কীর্তিমান নারীর সফলতার পেছনে নিবেদিত কোন পুরুষের গল্পটির চেয়ে অধিক জনপ্রিয় আর প্রচলিত হচ্ছে কীর্তিমান পুরুষের সফলতার পেছনে নিবেদিত আর নিষ্ঠাবান স্ত্রীদের গল্প।
পশ্চিমা বিশ্বে স্ত্রীদের এই অবদানের নানা কীর্তি বিবিধভাবে বিধৃত হয়ে ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এরকম অনেক মহীয়সী নারীর জন্ম হলেও তাঁদের অবদানের বৈশ্বিক স্বীকৃতির বিষয়টি কখনো তেমনভাবে উঠে আসেনি।
রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রনায়ক, জনগণের মুক্তির জন্যে লড়াকু ব্যক্তিদের জীবন সদা বিপদসংকুল। সত্যনিষ্ঠ আর অধিকার আদায়ে আপোষহীন জীবনাচারে দরিদ্রতা, জেল-জুলুম, মৃত্যুর ঝুঁকি মত নানা অনিশ্চয়তায় ভরপুর থাকে উনাদের চলার পথ বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে।
উইনস্টন চার্চিল ইংরেজ রাজনীতিবিদ, নোবেল বিজয়ী লেখক এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে ব্রিটিশ রাজত্বের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিশ্ব ইতিহাসে অন্যরকম পরিচিতি। চার্চিলের স্ত্রীর নাম ক্লেমেন্টাইন ওগিলভি হোজিয়ের (ক্লেমি)। ইতিহাসখ্যাত এই ক্লেমি-চার্চিল দম্পতি। ইতিহাসখ্যাত এই কারণে চার্চিলের মত একজন কীর্তিমান রাষ্ট্রনায়কের সফলতার পেছনে প্রেরণাদায়ী স্ত্রীর বৈশ্বিক গল্পের বহুল প্রচারিত অন্যতম সেরা এপিসোডটি হচ্ছেন এই ক্লেমি চার্চিল।
তাঁদের ৫৭ বছর দাম্পত্যে শুধু চার্চিলকে নানা রকম বিপদের হাত থেকে বাঁচিয়ে বিখ্যাত হয়ে উঠেননি ক্লেমি, উপরন্তু চার্চিলের রাজনীতি, সংসার আর ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধানে ছিলেন সাক্ষাৎ এক দেবী। ক্লেমি চার্চিলের বন্দনায় মুগ্ধ বিশ্ব মিডিয়া।
ক্লেমি চার্চিলের মত নির্ভরতা আর দায়িত্বশীলতায় এগিয়ে থাকা মহীয়সী স্ত্রীদের গল্পে উপমহাদেশীয় উদাহরণ হচ্ছেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব (রেণু)। ১৯ বছরের ক্লেমির সাথে প্রথম দেখা হয় ২৯ বছরের চার্চিলের। তিন বছরের রেণুর সাথে ১৩ বছরের মুজিবের বিয়ে সাবস্থ্য হয় পারিবারিকভাবে। ক্লেমি আর রেণু উভয়েই উনাদের বর থেকে ছিলেন ১০ বছরের ছোট। উভয় দম্পতির ঘর আলো করেছিলেন পাঁচ পাঁচটি সন্তান।
ক্লেমি ছিল চার্চিলের রাজনৈতিক উত্থানের নেপথ্য শক্তি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিজয়ী ব্রিটেনের যুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী প্রধানমন্ত্রীর প্রেরণার উৎস, অসুস্থ চার্চিলের শয্যাপাশে কর্তব্য পরায়ণ এক স্ত্রী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালো অধ্যায়ে বিশ্বের দরকার ছিল চার্চিলের মত নেতৃত্বের আর চার্চিলের দরকার ছিল ক্লেমির মত মহীয়সী নারীর প্রেরণা আর সার্বক্ষণিক সাহচর্য।
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির জন্মের প্রয়োজনে অনিবার্য ছিল বঙ্গবন্ধুর মত নেতৃত্ব আর বঙ্গবন্ধুর প্রয়োজন ছিল শেখ ফজিলাতুন্নেছা রেণুর মত মহীয়সী নারী, যার ভালবাসার ছায়ায় আর নির্ভরতায় বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি দিনশেষে বিশ্ব মানচিত্রে এঁকে দিয়েছিলেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
রাজনীতিবিদ শেখ মুজিব একটি দেশের রূপকার; অনেক বিশেষণ তার প্রাপ্য এবং দিনশেষে ইতিহাস তাঁকে প্রাপ্য মর্যাদায় অভিষিক্তও করেছে। একজন মানুষকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করার সময় দুয়েকটা এমন বিষয় পেয়ে যাবেন যা পুরো চরিত্রটির সারসংক্ষেপ হয়ে দাড়ায়। আবেগহীন মানুষের সাহচর্য আমি খুব একটা উপভোগ করি না। আমলা, শিক্ষক, পেশাজীবী, রাজনীতিবিদ ইত্যাদি সফল পরিচয়ের আড়ালে আমি বরাবরই আবেগটাকে খুঁজে ফিরি। একজন ভালমানুষ আবেগহীনতায় রবোটিক ধাঁচে কেবল ব্যাক্তিত্বের উত্তাপই ছড়াবেন অথচ সাথে যদি আবেগটা থাকে তবে প্রাণের স্পর্শে উত্তাপ আর আলো দুটোই ছড়াবেন। আমি আলোটাকে উপভোগ করতে চাই ভরা জ্যোৎস্নার স্নিগদতায়। ব্যক্তিত্বে উত্তাপ আর আলোর এই চমৎকার সমন্বয়ের কারণেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে আমি অনুভব করি বড় এক ক্যানভাসে, বিনম্র শ্রদ্ধায়।
বিশ্ব ইতিহাসে একজন সফল রাজনৈতিক, রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর এই সফলতার পুরোটা জুড়েই রয়েছেন বেগম মুজিব। স্বামীর দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে সংসার সামলানোর ঘটনায় ক্লেমি চার্চিলের সাথে বেগম মুজিবের মিল থাকলেও ত্যাগের মহিমার বেগম মুজিব অনেক বেশী উদ্ভাসিত।
শেখ ফজিলাতুন্নেছা, জন্ম ১৯৩০ সালে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় , ১৯৩৮ সালে বিয়ে হয় আত্মীয় শেখ মুজিবের সাথে। ব্রিটিশ ভারতে কোলকাতা কেন্দ্রিক রাজনীতিতে স্বামীর উপস্থিতির কারণে অনেকটা সময় সংসারের হাল একাই ধরে রাখতে হয়েছে ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের। পাকিস্থান আমলে আবার পরিপূর্ণ রাজনৈতিক নেতা স্বামীর উপর জেল জুলুম হুলিয়াজনিত কারণে বছরের পর বছর সংসারের হাল ধরে রাখতে হয়েছে দায়িত্বশীলতা আর নির্ভরতার উজ্জ্বল এক দৃষ্টান্তে।
স্ত্রীর প্রতি ভালবাসা প্রকাশে পশ্চিমাদের চেয়ে আমাদের ধরণটা ভিন্ন। ক্লেমিকে লেখা চিঠিতে চার্চিল বলেছিলেন কিভাবে উনার জীবন ক্লেমির কাছে ঋণী, আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন সবটাতেই ক্লেমি, ক্লেমি শিখিয়েছিল কিভাবে ঝড়ের রাতেও রত্ন কুঁড়াতে হয়।
বঙ্গবন্ধুর প্রকাশভঙ্গিটা তো আমাদের সংস্কৃতিজাত। বেগম মুজিবের অবদানের কথা বঙ্গবন্ধু তাঁর মত করেই প্রকাশ করে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে শুরুতেই এই প্রকাশভঙ্গিটা দেখতে পাই। বঙ্গবন্ধু বলছেন, ‘আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বললো, বসেই তো আছো, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী’। বেগম মুজিব শুধু তাগাদা দিয়েই দায়িত্ব পালন করেননি, বিভিন্ন সূত্রে আমরা জানি বঙ্গবন্ধু লিখছে কিনা এর ফলোআপ থেকে শুরু করে লেখাগুলো সংগ্রহ, সংরক্ষণ আর নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করেন।
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বাংলাদেশের জন্মের এক অমূল্য দলিল আর এই দলিলটি অক্ষত অবস্থায় জনগণের কাছে পৌঁছে যাওয়াটি বেগম মুজিবের প্রজ্ঞার একটি উদাহরণ মাত্র।
বেগম মুজিব ব্রিটিশ, পাকিস্থান আর বাংলাদেশ; মোট তিন আমলে বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ অংশ। জাতির জনকের জায়া, বঙ্গবন্ধুর সন্তাদের জননীরূপে দায়িত্বশীলতা আর নির্ভরতায় সর্বোচ্চ প্রশংসায় অভিষিক্ত হওয়ার চাইতে আরও বৃহত্তর বলয়ে বিস্তৃত ছিল বেগম মুজিবের অবদান। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মত ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহে বেগম মুজিবের অবদান চিরস্মরনীয়।
বঙ্গবন্ধুর মত একজন রাষ্ট্রনায়কের পাশে থেকে প্রেরণার উৎস হওয়া থেকে বঞ্চিত হতে চাননি বেগম মুজিব আর তাই ৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে দুর্বৃত্তদের বুলেটে স্বামীর সাথেই চলে যেতে হয়েছিল অনন্তলোকে। একজন কীর্তিমান পুরুষের সফলতার উৎসে স্ত্রী হিসেবে দায়িত্বশীলতা, নির্ভরতা, ত্যাগ তিতিক্ষা আর সর্বোপরী আত্মত্যাগের বিরল এক মহিমার নজির রেখে গেছেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। এই মহীয়সী নারীর প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।
ক্লেমি চার্চিল থেকে রেণু মুজিব |||| ড. শোয়েব সাঈদ লেখকঃ কলামিস্ট এবং মাইক্রোবিয়াল বায়োটেকনোলজিস্ট। কানাডার একটি বহুজাতিক কর্পোরেটে ডিরেক্টর পদে কর্মরত।
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান