সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে কাউকে গুম করে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্দি করে রাখা হতো, কাউকে গুম করে কিছুদিন পরে মামলা দিয়ে চালান করে দিতো আবার কাউকে গুম করে কিছুদিন পরে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হতো বলে জানান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। এ ছাড়া টর্চার সেলে নিয়ে বন্দিদের ঘূর্ণায়মান চেয়ারে শক্ত করে বেঁধে, ইলেক্ট্রিক শর্ট দিয়ে প্রচণ্ড বেগে ঘুরানো হতো। আবার মইয়ে বেঁধে ঘুরানো হতো। এতে করে ভিক্টিমের নাড়ি-ভুড়ি উলট-পালট হয়ে যেতো।
গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ তিনজনের বিরুদ্ধে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে প্রসিকিউশন। এদিন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা মামলার সপক্ষে তাদের আংশিক যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। প্রসিকিউশন জানায়, রাষ্ট্রপক্ষের উপস্থাপন শেষে, আসামিপক্ষের আইনজীবীরা তাদের যুক্তিতর্ক তুলে ধরবেন, পরে রাষ্ট্রপক্ষ এর জবাব দিবেন। এটি হলো মামলার সর্বশেষ ধাপ। পরে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হবে। এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের পরবর্তী যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য আজ সোমবার দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল।
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম ট্রাইব্যুনালকে বলেন, বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের গ্রেপ্তার করার পরে, তার পরিবারের প্রথম চেষ্টা থাকতো যে তাকে যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তা যেন স্বীকার করা হয়। এটা করতে ঘুষের লেনদেন হতো। এটা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে, মিরপুরের একটি ঘটনা হচ্ছে বোনকে তার ভাই বলছে যে তুই তাড়াতাড়ি এক লাখ টাকা নিয়ে আস নাহলে আমাকে মেরে ফেলবে। বোন পুলিশের হাত-পা ধরে কান্নাকাটি করে বলে কিছুক্ষণ রাখেন আমি আসছি। সে ভোর রাতের আগেই ৫০ হাজার টাকা নিয়ে গেছে। পরে পুলিশ বলছে, তুই সময় মতো আসিস নাই কেন আমরা তাকে মেরে ফেলেছি। অর্থাৎ তাকে ক্রসফায়ারে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, একজনকে র্যাব ধরে নিয়ে গিয়ে মিরপুরে বেড়িবাঁধের দিকে মেরে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। সেবার ৩ জনকে নিয়েছে, দ্বিতীয় জনকে গুলি করার পরে তার মাথায় ঝাকড়া চুল ছিল, গুলি করায় তার মাথায় আগুন ধরে গিয়েছিল, তখন যে গুলি করেছে সে হেসে বলে দেখেছিস গুলি করলাম তার চুলের মধ্যে আগুন ধরে গেলো। পরে তৃতীয় জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তিনি বলেন, পাখির মতো গুলি করে মানুষ মারতো। মানুষ মেরে আবার হাসতো। তাজুল বলেন, আমরা এমন অপরাধী পেয়েছি, এমন এভিডেন্স পেয়েছি, যে গুলি করার আগে ভিক্টিমদের এক ধরনের সিডিটিপ পুশ করা হতো। এতে করে তাদের কোনো বোধ থাকতো না, তারা কোনো প্রতিবাদ করতে পারতো না। তাদেরকে মাথায় যম টুপি পরিয়ে গুলি করা হতো।
তিনি বলেন, এক অপরাধী প্রথম দিকে ক্রসফায়ারের পূর্বে হাতে এক ধরনের মৌজা ব্যবহার করতো যেন গুলি করার পরে রক্ত তার হাতে না লাগে। কিন্তু পরবর্তীতে তার নেশা এমন হয়ে গিয়েছিল যে, কোনো মৌজা ব্যবহার করতো না, মানুষকে গুলি করে, সেই রক্ত ও মগজ তার হাতে না লাগলে তার কোনো ফিলিংস হতো না। তখন সে খালি হাতে ক্রসফায়ার দিতো।
তিনি বলেন, গুম করার পরে ভিক্টিমদেরকে ট্রলারের মধ্যে নিয়ে মাঝ নদীতে, সাগরে নিয়ে যাওয়া হতো। তাদেরকে গুলি করে কমান্ড ছুরি দিয়ে পেট কেটে ফেলে দেয়া হতো যেন লাশ খুঁজে না পাওয়া যায়। এ ছাড়াও একজন অফিসার তার গাড়ির মধ্যে ১০ কেজি ওজনের হাতুড়ি রাখতো, যাকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত হতো তাকে ধরে আনার পরেই হাতুড়ি দিয়ে মাথায় মেরে হত্যা করা হতো।
আইনি ব্যাখ্যা দিয়ে প্রসিকিউশনের পক্ষে যুক্তিতর্কে শুরু করেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম: যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময়ে তিনি আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে আদালতকে বলেন, কেউ যদি বলে যে সে তার সুপিরিয়র অফিসারের কমান্ডে কাজ করেছেন, যেহেতু আইনে ইন্ডিভিজুয়াল অপরাধের কথা বলা হয়েছে, এসব কথা বলে বাঁচার কোনো সুযোগ নেই।
তিনি সেনাবাহিনীর বিচার নিয়ে আইনি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, অনেক সময় এই ডিবেট তোলা হয় যে মিলিটারি অফিসারদের বিচার তাদের নিজস্ব আদালতে করবে। কিন্তু সেনাবাহিনীর কেউ যদি ক্রাইমস অ্যাগেইনেস্ট হিউম্যানিটি, ওয়ারক্রাইস এবং জেনোসাইডের মতো অপরাধ করে তাহলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অধীনেই তাদের বিচার করা যাবে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে পাকিস্তানি বাহিনী ওয়াহিদুলকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইনে বিচার করা হয়েছিল। যদিও রায় হয়নি বলে যোগ করেন তাজুল।
বিচারকদেরও জবাবদিহিতা থাকা উচিত: ট্রাইব্যুনালের অভিমত: বিচারকদেরও জবাবদিহিতা থাকা উচিত বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। চিফ প্রসিকিউটর যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের একপর্যায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের কর্মকাণ্ড তুলে ধরেন। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের সময় যে জাজমেন্ট প্রথমে ওপেন কোর্টে দেয়া হয়েছিল, পরে চূড়ান্ত রায়ের সময় সেই রায়ের অংশটুকু বাতিল করে দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন তিনি। প্রধান বিচারপতির মতো আসনে অধিষ্ঠিত থেকে খায়রুল হক এই স্বেচ্ছাচারী কাজ করেছেন।
এসময় ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বলেন, অ্যাডমিনিস্ট্রেটর অব জুডিশিয়াল রয়েছে। কিন্তু জাজদের অ্যাকাউন্টিবিলিটির কোনো ব্যবস্থা নেই। অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলা পড়ে আছে, আমরা বিচার করতে পারছি না। জনগুরুত্বপূর্ণ মামলা রেখে সরকারের অথরিটি পালন করছেন। তাদের একটা সিস্টেমের মধ্যে আসতে হবে। বিচারের নামে স্বাধীনতা মানে তো আপনি যা খুশি তা করবেন। এটার নাম স্বাধীনতা না। জুডিশিয়াল কাউন্সিলেরও যদি কেউ অফেন্স (অপরাধ) করে তাদেরও জবাবদিহিতা বা বিচারের আওতায় আনার একটা সিস্টেম থাকতে হবে।
সূত্র : মানবজমিন
এফএইচ/বিডি
CBNA24 রকমারি সংবাদের সমাহার দেখতে হলে
আমাদের ফেসবুক পেজে ভিজিট করতে ক্লিক করুন।
আমাদের ইউটিউব চ্যানেল ভিজিট করতে পোস্ট করুন।