জানা অজানা ফিচার্ড

চা বাগানের পুজোর আমেজ | জীবন পাল

লেখক এবং চা বাগান

চা বাগানের পুজোর আমেজ | জীবন পাল

১. শহরের মত চা বাগানে পাড়ায় পাড়ায় পুজোর আয়োজন করা হয়না৷ প্রায় প্রতিটি চা বাগানেই একটি করে দুর্গামন্দির আছে। মন্দিরের পাশেই আছে নাটমন্দির। পুজোর আয়োজনটা করা হয় সেখানেই। আর চা বাগানের পুজোর আনন্দটা সেই মন্ডপকে ঘিরেই। পুজোর ৩ দিন এই মন্ডপকে কেন্দ্র করে ছোটখাটো অনেক দোকান বসানো হয়ে থাকে। যার মধ্যে থাকে খাবার দোকান, বাচ্চাদের খেলনার দোকান, কসমেটিকসের দোকান, ছবি বা ফটোর দোকান ইত্যাদি। যেখানে রীতিমতো ছোটখাটো একটা মেলা বসে যায়। পুজোর দিনগুলোতে এসব দোকানগুলোতে দিনে শুধুমাত্র শিশুদের ভীড় থাকলেও সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে সব বয়সীদের ভীড় দেখা যায়। যে ভীড় থাকে মধ্যরাত পর্যন্ত। আগে যখন চা বাগানগুলোতে পুজোর সময় যাত্রাপালা হতো তখন তো সারারাত বাগানের প্রতিটি লাইনের মানুষজনের আনাগোনা লেগে থাকতো এই মন্দিরকে ঘিরে। যার ফলে মন্দিরকে ঘিরে বসা এসব দোকানগুলোতেও ভীড় লেগে থাকতো সারারাত। চা বাগানগুলোতে বিনোদন বলতে এই পুজোর দিনগুলোকে ঘিরেই। পুজোর এই ক’টাদিন পুরো বাগান বন্ধ থাকে। চা বাগানে একটানা ছুটি বলতে কিন্তু এই দুর্গাপুজায়। তাছাড়া বাগানের শ্রমিকদের জন্য এরকম ছুটি মানে স্বপ্ন ছাড়া কিছু নয়। কেননা, চা বাগান টানা এতদিন বন্ধ রাখাটা অসম্ভব। চা বাগানগুলোর অধিকাংশ শ্রমিক সনাতন ধর্মাবলম্বী হওয়ায় পুজো উপলক্ষে কয়েকদিন বাগান বন্ধ রেখে ছুটি দিতে হয়। সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব বলে কথা!

২. পুজোর সময় সবকটি চা বাগান বন্ধ থাকে। এই সুযোগটাকে কাজে লাগাতে আত্মীয় স্বজনদের সাথে পুজোর আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে এক চা বাগান থেকে আরেক চা বাগানে ছুটে যান তারা। চেষ্টা করে থাকেন একদিনের জন্য হলেও যেন আত্মীয় স্বজনদের সাথে পুজোর একটি দিন কাটাতে পারেন। সকলের সাথে বসে একবেলা ভাল খাবার খেতে পারেন। এতেই যেন নিজেদের সন্তুষ্টি খুঁজে পায়।
চা বাগানে সারাবছর তিনবেলার মধ্যে একবেলা কষ্ট করে খেলেও পুজোর সময়ের এই ৩ দিন পরিবার, আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে পেট ভরে খাওয়ার চেষ্টা করেন। এর জন্য পূর্ব প্রস্তুতি থাকে সারাবছর ধরে। ভাল খাবার বলতে এই ৩ দিনের জন্য সারাবছর ধরে বাড়িতে পালন করা মুরগীই একমাত্র ভরসা। খুব যতœ করে সারাবছর এই মুরগীগুলোকে লালন পালন করে বড় করে থাকেন। যাতে পুজোর এই কয়েকটাদিন মাংস দিয়ে ভাত খেতে পারেন। পুজোর সময় পেট ভরে ভাত খাওয়ার চিন্তা দূর করার পরিকল্পনাটাও থাকে বছর জুড়ে। পুজোর দিনগুলোর কথা চিন্তা করেই মুষ্টি চাল জমিয়ে রাখতে ভুল করেনা বাড়ির উপার্জনকারী শ্রমিক মহিলারা। পুজোর দিনগুলোতে সবাইকে নিয়ে মাংস দিয়ে পেট ভরে খাওয়ার মধ্যেই চা বাগানের আনন্দ।
তবে, সকলের জন্য নতুন কাপড় কেনাটা কষ্টসাধ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। যদিও বাড়ির শিশু সন্তানদের জন্য নতুন কাপড় কেনার চেষ্টা থাকে প্রায় প্রতিটি পরিবারের। চা বাগানে পুজোর সময় বাড়ির অনেক পুরুষরা বাড়তি আনন্দ হিসেবে লাংগি খাওয়ার আসরে যোগ দিয়ে থাকেন। বাড়ির যুবক থেকে শুরু করে বয়স্করাও যে যার বয়সীদের সাথে এই আসরে অংশগ্রহণ করে থাকেন।

৩. চা বাগানের পুজোর প্রধান আকর্ষন থাকে সন্ধ্যার আরতি। আরতি শুরুর আগেই যেন মন্দিরে উপস্থিত থাকতে পারে সেজন্য সন্ধ্যার আগেই সবকাজ শেষ করে ফেলার একটা অস্থিরতা থাকে প্রতিটি বাড়িতেই। ৩ দিনের একদিনেও সন্ধ্যার আরতি দেখা থেকে কেউ বঞ্চিত হতে চাননা। সব বয়সীদের উপস্থিতি আরতির সন্ধ্যাবেলাটা ম-পের আনন্দটা যেন কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়ে থাকে। যে আনন্দটা কষ্টে পরিণত হয়ে যায় দশমির দিন। প্রতিমা বিসর্জন দেওয়ার সাথে সাথে নিরব আঙ্গিনায় পরিণত হয়ে যায় ৩ দিনের জাঁকজমকপূর্ণ ম-প প্রাঙ্গন। নিরবতা নেমে আসে যেন পুরো বাগান জুড়ে। মনের মধ্যে আবার একটি বছরের প্রতিক্ষায় নিজেদের প্রকৃত ঠিকানায় কর্মব্যস্ততায় হারিয়ে যায় সেই দু’টি পাতা একটি কুড়ির রাজ্যে।

লেখকঃ জীবন পাল, সাংবাদিক



সংবাদটি শেয়ার করুন