ফিচার্ড সাহিত্য ও কবিতা

ছোট গল্প।।  ঘুণ পোকা ।। উম্মেসা খাতুন

ছোট গল্প।।  ঘুণ পোকা ।। উম্মেসা খাতুন


১.
আরাবুল তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে তাকালেই একটি মাঠ দেখতে পায়। বিরাট একটি মাঠ।পাম্পের মাঠ। পাম্পের জলে এই মাঠের সমস্ত জমি চাষ হয় বলে গ্রামের মানুষ মাঠটিকে “পাম্পের মাঠ” বলে। আবার অন্য মাঠের তুলনায় এই মাঠে ফসলও খুব ভালো হয় বলে এই মাঠের সমস্ত জমির দামও খুব বেশি। এই মাঠেই আরাবুলের দশ বিঘা জমি রয়েছে, দশ বিঘা জমি। ডাকলে কথা বলে সেসব জমি। বিকেলে রোদ কমে যাওয়ার পর আরাবুল তাই একবার মাঠে নামবে ভাবল, জমি দেখতে।
২.
আরাবুল এখন গ্রামে থাকেনা, শহরে থাকে। শহরে তার শ্বশুর বাড়িতে থাকে। তা সত্ত্বেও গ্রামে তার সমস্ত বিষয় সম্পত্তি রয়েছে। ঘরবাড়ি ও পুকুর, বাগান থেকে শুরু করে মাঠান জমি। গ্রামেই সবকিছু রয়েছে তার। গ্রাম থেকে সে কিছুই নিয়ে যায়নি শহরে। তার বন্ধু নূরুল দেখাশোনা করে। শহরে যাওয়ার সময় আরাবুল তাকে দেখাশোনার ভার দিয়ে গেছে। তবে বছরে একবার করে আরাবুল গ্রামে আসে, এই জ‍্যৈষ্ঠ মাসে। আম,কাঁঠাল পাকার সময়। যখন আসে নূরুলের কাছেই খায়। আর নূরুল তাকে ফসলের সব হিসাব ঠিকঠাক বুঝিয়ে দেয়। দু-চার দিন গ্রামে থেকে আরাবুল তারপর আবার শহরে চলে যায়।নিজের বাগানের গাছে পাকা টাটকা কিছু ফল ব‍্যাগে ভরে নিয়ে। নূরুলই তাকে মোড়ে রেখে আসে।
৩.
শহরে যাওয়া আরাবুলের পাকা বারো বছর চলছে। দু-হাজার আট সাল থেকে দু-হাজার উনিশ সাল ধরে হিসেব করলে পাকা বারো বছরই হচ্ছে। বারো বছর একেবারে কম সময় নয়। একটা যুগ। তার আগে আরাবুল গ্রামেই ছিল। গ্রামের মাঠ, ঘাট, বন-জঙ্গল, নদী-নালা  সব তার আপনজন ছিল। বাবার সঙ্গে সে জমিতে চাষবাস করত। পড়াশোনা করে চাকরি পেয়েছিল না বলে বাবার সঙ্গে পূর্বপুরুষদের সেই আদি পেশা চাষবাসটাকেই বেছে নিয়েছিল। তারপর হঠাৎ একদিন তার বাবা মারা গেলে আরাবুল একা হয়ে গেল। তারপরই সে চাষবাস ছেড়ে শহরে চলে গেল।
আরাবুলেরস্ত্রী, রোজি বিবি। বিয়ের পরে রোজি বিবি। তার আগে সে রোজি খাতুন ছিল। সে ছাড়া আরাবুলের শ্বশুর-শাশুড়ির আর কেউ ছিল না। না কোন ছেলে, না কোন মেয়ে।রোজিই একমাত্র। সেই হিসেবে রোজির মা-বাবার দেখভালের দায়িত্ব কিন্তু রোজির উপরই পড়ে। কিন্তু এতদূর থেকে সে তাঁদের দেখবে কী করে? উভয়ের সুবিধার জন্য তারা তাই শহরেই চলে যায়।

কিছুদিন হল রোজির মা মারা গেছেন। রোজির বাবারও শরীর খুব একটা ভালো নেই।তিনিও কবে নেই হয়ে যাবেন। তবু যে ক’টা দিন বেঁচে আছেন দেখাশোনা তো তাঁদের করতে হবে। তারপর যেদিন পুরোপুরি নেই হয়ে যাবেন তারা ফের গ্রামে ফিরে আসবে।কারণ, আরাবুলের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা সবকিছুই গ্রামে। গ্রামে তার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী সবাই রয়েছে। রয়েছে তার পুরনো কত স্মৃতি। যে কারণে আরাবুল আবার গ্রামেই ফিরে আসবে। কিছু কিছু মানুষ থাকে গ্রামের মানুষ হয়েও তারা গ্রামকে মেনে নিতে পারেনা। অবহেলা করে। শহরকেই বেশি পছন্দ করে। আরাবুল তাদের দলে পড়েনা। শহরের চাইতে গ্রামকেই তার বেশি ভালো লাগে, গ্রামকেই সে বেশি পছন্দ করে, গ্রামেই সে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কথায় আছে না, গ্রাম স্বর্গ! সে আবার তাই গ্রামেই ফিরে আসবে। এসে পূর্বপুরুষদের সেই আদি পেশা চাষবাসে আবার মন দেবে।কারণ, আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষের প্রধান জীবিকাই হল কৃষিকাজ। সুতরাং কাজটা সে ছাড়বেনা, আঁকড়ে ধরে থাকবে।
৪.
সে এলেও তার দুই ছেলে গ্রামে আসবে না বা আসতে চাইবেনা। কারণ,তাদের জন্ম যে গ্রামে নয়, শহরে। তারা বড়ও যে হচ্ছে শহরে। পড়াশোনাও করছে শহরে। শহরের ইট, কাঠ, পাথর, সরু গলি আর বদ্ধ হাওয়াই যে তাদের কাছে এখন অত্যন্ত প্রিয় হয়ে গেছে।ফলে গ্রামের পরিবেশ যতই মনোরম হোক, গ্রামের আকাশ যতই উদার হোক, গ্রামের মাঠ যতই খোলা হোক, গ্রামের নদী কুলকুল করে যতই প্রবাহিত হোক, গ্রাম যতই স্বর্গ হোক তবু গ্রাম তাদের ভালো লাগবে না। গ্রামে মন বসবে না। গ্রামের পরিবেশের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারবেনা। আর এই জন্যই তারা গ্রামে আসতে চাইবে না। তারা আসতে না চাইলে আরাবুলও তাদের আসার জন্য পীড়াপীড়ি করবে না। কারণ,গ্রাম যতই স্বর্গ হোক সরকারি সুযোগ সুবিধা কিন্তু শহরেই বেশি। তাই তারা না আসতে চাইলে না আসবে। আরাবুল তাদের আনবে না। শহরেই রেখে দেবে। তার শ্বশুর মশাইয়ের যে বাড়িটায় তারা এখন রয়েছে ওই বিরাট বাড়িটা তার শ্বশুর মশাই আগেই আরাবুলের দুই ছেলে ও রোজির নামে লিখে দিয়েছেন। না হলে তিনি মারা যাওয়ার পর তাঁর ভাই ভাইপোরা যদি ভাগ পেয়ে যায়। যে কারণে আরাবুলের ছেলেরা যদি শহরে থাকতে চায় তো থাকবে। তার কোনও আপত্তি নেই, কোনও দ্বিমত নেই। গ্রাম থেকে মাঝে মাঝে শহরে গিয়ে তারা ছেলেদের শুধু দেখে আসবে,দেখে…
৫.
শহরে যাওয়ার আগে আরাবুল তার বিষয় সম্পত্তি যেমন, পুকুর, বাগান এবং মাঠান জমি নিয়ে খুব চিন্তায় ছিল। গ্রামে এসব রেখে সে শহরে যাবে কী করে? গেলে তো এসবের কিছুই ঠিক থাকবে না।পুকুর ভর্তি মাছ তবু পুকুরে একটা মাছ থাকবে না। সব শালা বারো ভূতে ধরে খাবে। বাগান ভর্তি ফলের একটাও ফল থাকবেনা। সব শালা ভূতেরা পেড়ে খাবে। শুধু গাছের ফলই পেড়ে খাবেনা। গাছের ডালপালাও ভেঙে নিয়ে চলে যাবে। যেন ভূতেদের সব বাপেদের গাছ! তার বাপেরা লাগিয়ে রেখেছে! যখন যা ইচ্ছে তাই করবে!ফলে গাছ মরে যাওয়ার ভয় থাকবে বেশি।গাছ তো আর এমনি এমনি বড় হয়নি। কষ্ট করে গাছ মানুষ করতে হয়েছে। গাছ বড় করতে তার বাবাকে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়েছে। ছোটবেলায় সে তার বাবাকে গাছের পিছনে প্রচুর মেহনত করতে দেখেছে। গাছ লাগানোর পর গাছের কী যত্ন আর পরিচর্যা করা! গরু,ছাগলে মুখ দেবে বলে বাঁশের রেলিং দিয়ে গাছ ঘিরে রাখা থেকে শুরু করে সকাল সন্ধ্যা দু-বেলা নিয়ম করে গাছের গোড়ায় জল দেওয়া।গাছ যাতে মরে না যায় এবং তাড়াতাড়ি যাতে সুষ্ঠুভাবে বেড়ে উঠতে পারে।ঠিক ছেলে মানুষ করার মতো করে তার বাবা গাছ মানুষ করেছেন। আর সেই গাছ, সেই বাগান ভূতেরা নষ্ট করে দেবে! না,এ হতে পারে না। কোনভাবেই এটা হতে দেওয়া যাবেনা।তার বাবা আজ পৃথিবীতে বেঁচে নেই ঠিকই। কিন্তু তার বাবার সম্পদ তো বেঁচে রয়েছে।হঠাৎ মারা যাওয়ার কারণে সে তার বাবার অন্তিম সেবা করতে পারেনি। কিন্তু তার জন্য যে সম্পদ তিনি রেখে গেছেন সেই সম্পদের সে ঠিকই যত্ন নেবে। বাবার রেখে যাওয়া সম্পদ সে কোনভাবেই নষ্ট হতে দেবেনা।আর তার জন‍্যই সে নূরুলকে দেখাশোনার ভার দিয়ে গেছে। ফলে ভূতেরা কিছুই করতে পারেনি। হয়তোবা করার চেষ্টা করেছিল।কিন্তু ওইসময় নূরুল দেখে ফেলে তাদের টুঁটি চেপে ধরতে চেয়েছিল বলে পারেনি। যে কারণে আরাবুলের এখন খুব ভালো লাগছে, খুব ভালো লাগছে।
৬.
আরাবুল শহরে যাওয়ার দিন কয়েক আগে নূরুল একবার তার কাছে এসেছিল। আরাবুল তখন ঘরে বসে তার বাবার পুরনো রেডিওটা দীর্ঘদিন না বাজানোর ফলে নষ্ট হয়ে পড়েছিল সেটা মোছাঘষা করে শহরের ভালো মেকানিকের কাছে নিয়ে গিয়ে সারিয়ে নিয়ে আবার বাজাবে বলে মোছাঘষা করছিল। কিন্তু রোজি ঘরের বাইরে বারান্দায় ছিল। নূরুল রোজিকে জিজ্ঞেস করেছিল, “আরাবুল বাড়ি আছে গো?”
রোজি “আছে” বলেছিল।
নূরুল তখন রোজিকে “কোথায় আছে, একবার ডেকে দাও তো” বলেছিল।
রোজি আরাবুলকে ডেকে দিয়েছিল,”তোমায় ডাকছে গো, বেরিয়ে এসো।”
কিন্তু না বেরিয়ে আরাবুল রোজিকে জিজ্ঞেস করেছিল,”কে ডাকছে?”
নূরুল বলেছিল,”আমি ডাকছি রে, আরাবুল।”
“কে,নূরুল?”
“হ‍্যাঁ।”
“দাঁড়া আসছি। “আরাবুল ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল,”কী হল,বল।”
নূরুল বলেছিল, “তোর কাছে একশোটা টাকা হবে? আমি তোকে কাল দিয়ে যাবো।”
“হবে, নিয়ে যা।”
নূরুল টাকাটা নিয়ে চলে আসতে গেলে আরাবুল বলেছিল, “চলে যাচ্ছিস?”
“হ‍্যাঁ। কেন,কিছু বলছিস?”
“বলছিলাম তো।”
নূরুল বলেছিল, “কথাটা আজ না শুনে কাল শুনলে হবেনা? আজ একটু ব‍্যস্ত আছি।বাড়িতে শ্বশুর-শাশুড়ি এসেছে। তরিতরকারি কিছু নেই। গিয়ে কিনে দিতে হবে।”
“ও,তাই নাকি? ঠিক আছে, যা তাহলে।”
নূরুল চলে এসেছিল।
৭.
পরেরদিন কথামতো নূরুল আবার এসেছিল এবং আরাবুলকে টাকাটা দিয়ে বলেছিল, “তুই কাল কী কথা বলবি বলছিলি, এখন বলবি নাকি?”
“বলব,বস।”
নূরুল বসেছিল, “বল।”
আরাবুল বলেছিল,”কথাটা হল, রোজির মা-বাবার শরীর খুব একটা ভালো নেই। আমাদের এখন তাঁদের দেখাশোনা করা দরকার। কারণ,আমরা ছাড়া তাঁদের তো আর কেউ নেই।তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, ওনারা যতদিন বেঁচে আছেন আমরা ওখানে গিয়ে থাকব।তারপর ওনারা মারা যাওয়ার পর—- কিন্তু মুশকিলটা হল, আমার পুকুর, বাগান, গাছ,জমি এসব নিয়ে। আমি বাড়িতে না থাকলে এসবের কী হবে? লোকে সব লণ্ডভণ্ড করে দেবে না?”
নূরুল বলেছিল, “তা দেবে বৈকি। তোকে তাহলে এক কাজ করতে হবে, কাউকে দেখাশোনার ভার দিয়ে যেতে হবে। তাহলে কেউ কোন ক্ষতি করতে পারবে না।”
আরাবুল অমনি নূরুলকে বলেছিল, “কাকে আর দেখাশোনার ভার দিতে যাবো, ভারটা তুই-ই নে না! তুই তো আমার ছেলেবেলার বন্ধু, তোকে আমার কোন অবিশ্বাস নেই। বাগানে যা ফল, জমিতে যা ফসল আর পুকুরে যা মাছ হবে তুই খাবি আর আমাকে দিবি।বছরে একবার করে আমি আসব।”
“ঠিক আছে।”
তখন থেকে নূরুল আরাবুলের সবকিছু দেখাশোনা করে।
৮.
গত পরশুদিন আরাবুল গ্রামে এসেছে। এসে গ্রামে তার যত পুরনো বন্ধু-বান্ধব এবং শুভানুধ্যায়ী ছিল তাদের সবার সঙ্গে দেখা করেছে। পুকুর,বাগান,গাছ ঘুরে দেখেছে। সব ঠিক আছে। কোন জিনিসের কোন ক্ষতি হয়নি। বরং নূরুলের হাতের অধিক পরিচর্যা পেয়ে গাছ গুলো আরও সবুজ আরও সতেজ হয়ে উঠেছে। শুধু মাঠেই তার নামা হয়নি।আজ বিকেলে মাঠে নামবে বলে ঠিক করেছে।
ঘড়িতে এখন দুপুর বারোটা বেজে এক মিনিট বাজছে। বছ‍র খানেক বাড়িটা তালাবন্ধ থাকায় উঠোনটা আগাছার জঙ্গলে পুরো জঙ্গল হয়ে আছে। পরশুদিন এলেও তা পরিষ্কার করার সময় হয়নি আরাবুলের। সকালের দিকে পুকুরের জলে জাল টেনে তিন কিলো ওজনের একটা মাছ ধরে নূরুলকে দিয়ে মাছের ঝোল-ভাত করতে বলে আজ বেলা দশটার পরে পরিষ্কার করতে শুরু করেছে। পরিষ্কার হয়ে গেলে সাবান মেখে চান করবে।তারপরই নূরুল মাছ, ভাত নিয়ে চলে আসবে। আরাবুল খেয়ে ঘুমাবে। তারপর রোদ কমে গেলে বিকেলের দিকে মাঠে নামবে।নেমে সব জমি দেখে সন্ধ্যার আগে মাঠ থেকে উঠে আসবে। আকাশে ঠিক ঝিকিমিকি বেলা থাকতে। পাখিরা নীড়ে ফেরার প্রাক্-মুহূর্তে।
৯.
রোদ কমে গেলে বিকেলের দিকে আরাবুলের ঘুম ভাঙল এবং কথামতো সে মাঠে নামল।নেমে জমি দেখে সন্ধ্যার আগে মাঠ থেকে উঠে আসতে লাগল। আসতে আসতে হঠাৎই তার মনে পড়ে গেল যে, সে যে জমিটার আল দিয়ে এখন হাঁটছে ওটা এক দাগে পাঁচ বিঘা। মানে পাঁচ বিঘার দাগ। জমিটা একসময় তার বাবার নামে ছিল।কিন্তু এখন নেই।এখন একটা নষ্টা মেয়ের নামে রয়েছে।কথাটা মনে পড়ে যাওয়ায় আরাবুল আর ওই জমির আল দিয়ে হাঁটল না।বার কয়েক ঘৃণার থুতু ফেলে অন্য জমির আল ঘুরে উঠে আসতে লাগল।
১০.
ঘটনাটা আজকের নয়। অনেক দিন আগের পুরনো ঘটনা। আরাবুল তখন ক্লাস ইলেভেনের ছাত্র। সেই সময় আরাবুলের বাবা মহাম্মদ আলি জমিটা ওই নষ্টা মেয়েটাকে লিখে দেন।মেয়েটা হল রাবেয়া বিবি। আরাবুলের গর্ভধারিণী মা।তবু আরাবুলের চোখে সে একটা নষ্টা মেয়ে ছাড়া আর কিছুই না।কারণ,নষ্টা মেয়েদের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য আরাবুল তার মধ্যে দেখেছে।আরাবুল তাই মেয়েটাকে জমি দেওয়ার ব‍্যাপারে তার বাবাকে কঠিনভাবে নিষেধ করেছিল,”ওকে জমি দিতে হবেনা,ওকে জমি দিবেন না।”
“কিন্তু আমি তো আর অন্য কাউকে জমি দিচ্ছি না, জমি দিচ্ছি তোর মাকে।”
“তাও দিতে হবেনা। আপনার জমি আপনার নামেই থাকুক।”
“তোর মায়ের নামে থাকলে কী হবে? আমার নামে থাকলেও যা তোর মায়ের নামে থাকলেও তাই। আমার নামে থাকলেও পরে তুই পাবি। তোর মায়ের নামে থাকলেও পরে তুই-ই পাবি। কারণ,তুই ছাড়া আমাদের তো আর কেউ নেই।”
“জমি নিয়ে যদি পালিয়ে যায়? তখন কী হবে?”
“কোথায় পালিয়ে যাবে?”
“মেয়েদের পালিয়ে যাওয়ার আজকাল জায়গার অভাব আছে নাকি? কত জায়গা। ধরে নিন, আপনাকে বাদ দিয়ে অন্য কোন ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গেল। তখন আমি কি আর ওই জমি পাবো? পাবোনা। যে ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যাবে সে পাবে। ও তার ছেলেপুলে হলে তারা পাবে।”
“ধুর পাগল! তাই কখনও হয় নাকি?”
“না হওয়ার কী আছে? হতেও তো পারে। আজকাল চার-পাঁচ ছেলের মাও পালিয়ে যাচ্ছে।পালিয়ে যাওয়াটা মেয়েদের কাছে আজকাল ফ‍্যাশান হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
“তবে সবাই যাচ্ছে না। বলতে পারিস, কেউ কেউ যাচ্ছে। যারা খুব খারাপ মেয়ে কেবল তারাই যাচ্ছে। তোর মা সেরকম মেয়ে নয়। তোর মা ভালো মেয়ে, খুব ভালো মেয়ে। তোর মা যাবেনা, আমার বিশ্বাস। আমি তোকে এটা চ‍্যালেঞ্জ করে বলতে পারি।”
“খুব ভালো মেয়ে আপনি জানলেন কী করে?”
“কেন জানব না? তোর মা আমার স্ত্রী না! একটা স্বামী তার স্ত্রীকে যতটা জানবে পৃথিবীর আর কেউ জানবেনা।”
“তাই নাকি?”
“হ‍্যাঁ।”
“জমি তাহলে দিবেনই?”
“দিব বলেইতো ঠিক করেছি এবং কথাও দিয়েছি। তাহলে না দিলে হয়? তুইই বল, না দিলে হয়? কথার খেলাপ হবেনা! কথার খেলাপ করা মহাপাপ। তাছাড়া না দিলে তোর মা তোকে এবং আমাকে কাউকেই সেভাবে ভালোবাসবেনা এবং রান্না করে দিবেনা। দিনরাত গালিগালাজ আর মন্দ ব‍্যবহার করবে। সেটা কি খুব ভালো দেখাবে?”
“বেশি ভালোবাসা পাওয়ার জন‍্যই কি তাহলে আপনি—-”
“হ‍্যাঁ, সেটা বলতে পারিস।”
“কিন্তু আপনার ছোট ভাই সেফাতুলও তো তার স্ত্রীকে জমি দিয়েছিল। আপনার মতো বেশি ভালোবাসা পাওয়ার আশায় এবং আপনার চেয়ে বেশি জমি দিয়েছিল,পুরো দশ বিঘা।নিজের নামে মাত্র কয়েক বিঘা জমি রেখে সব দিয়েছিল। কিন্তু আপনার ছোট ভাই তার স্ত্রীর কাছ থেকে ভালোবাসা পেয়েছে কি? পায়নি। বরং আপনার ভাইকে সে ডিভোর্স দিয়ে জমি নিয়ে পালিয়ে গেছে এবং তার হাঁটুর বয়সী একটা ছেলেকে বিয়ে করেছে।সুতরাং ও যে তেমনটা করবেনা তার কি কোন নিশ্চয়তা আছে? কোন গ‍্যারান্টি আছে?”
“সেফাতুলের স্ত্রী পাক্কা একটা খানকি মেয়ে। ওর কথা বলিস না। কিন্তু তোর মা মোটেও ওরকম মেয়ে নয়। একটা পরহেজগার মেয়ে। পাঁচ অক্ত নামাজ পড়ে। কোরান পড়া জানে এবং রমজান মাসে পুরো একমাস রোযা রাখে। এছাড়া ভবিষ্যতে হজে যাওয়ারও তার ইচ্ছে আছে। তাহলে সেই মেয়েটাকে আমি খারাপ বলি কী করে, তুই বল।”
“এসবের দিক থেকে কিন্তু আপনার ভাইয়ের স্ত্রী পাখি বিবিও কম ছিল না। সেও নামাজ পড়ত, রোযা রাখত। সুতরাং সব মানুষের ধর্ম পালন দেখে তার চরিত্রের বিচার করা যায়না। কারণ, চরিত্র বদলানোর জন্য এরা কেউই ধর্ম পালন করে না। পরকালের ভালোর জন‍্যও না। ধর্মটা এদের কাছে একটা মুখোশ মাত্র। তাই,যারা এদের ধর্ম পালন দেখে চরিত্রের বিচার করে তারা কখনোই বুদ্ধিমান নয়, বরং বোকা।…”
আরাবুল এত ক‍রে বললেও তার বাবা তার নিষেধ শুনেছিলেন না। জমিটা লিখে দিয়ে তবেই থেমেছিলেন। ব‍্যস,তারপরই মাত্র ছ’মাসের মাথায় তার মা পালিয়ে যায়। পাড়ার কুমারের সাথে। কুমার হিন্দু নয়,মুসলমান।তার বাবার নাম আমিন সেখ। তার আগের বউ,ছেলে সব ছিল।
১১.
আরাবুলের মা কুমারের সাথে পালিয়ে যাওয়ার পর তার ঘর করতে শুরু করেছিল। ফলে কুমার তার আগের বউকে তালাক দিয়ে তার বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। সঙ্গে তার ছেলেপুলেদেরও। তবু আরাবুলের বাবা পরে আবার তাকে নিতে চেয়েছিলেন। বিষয়টা জানতে পেরে গিয়ে আরাবুল তার বাবাকে ভীষণ বকা বকেছিল, “আপনি বলে ওই খানকি মাগীকে আবার নিতে চাইছেন?”
“তুই শুনলি কোথায়?”
“যেখানেই শুনি আমি শুনেছি। আপনি শুধু বলেন না,নিতে চাইছেন কিনা!”
“হ‍্যাঁ,চাইছি।”
“কেন নিতে চাইছেন? আপনার কি মনে রাগ, ঘৃণা, লজ্জাবোধ বলে কিছু নেই? আপনি কী রকম মানুষ একটা?”
“থাকবে না কেন? আছে।”
“আছে তো নিতে চাইছেন কেন? উত্তর দেন।”
“আমি অন্য কারণে নিতে চাইছি। ওকে নিয়ে আবার সংসার করব বলে নয়। ভুলিয়ে ভালিয়ে ওকে দেওয়া জমিটা আবার ফিরিয়ে নেবো বলে।”
“না, তার আর দরকার নেই। কারণ,আমাদের ভাগ্য ভালো যে,খানকি মাগী আমাদের মেরে দিয়ে পালিয়ে যায়নি। এসব ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মেয়ে‌ কিন্তু স্বামী সন্তানের মেরে দিয়ে পালিয়ে যায়। সেদিক থেকে আমরা বড় বাঁচা বেঁচে গেছি। আর আপনি জমি ফিরিয়ে নেওয়ার আশায় ওকে আবার—– এবার যদি ও আমাদের সবাইকে মেরে দিয়ে পালিয়ে যায়?খানকি মেয়েদের কি কোন বিশ্বাস আছে?”
সুতরাং এরপর তিনি আর ওকে নিতে চাননি।অন্য মেয়েকে পরে আর বিয়েও করেননি।বিয়ে করে পরে যদি সেই মেয়েও ওর মতো হয়!
১২.
আরাবুলের মা যে এ গ্রেডের একটা চরিত্রহীনা মেয়ে ছিল আরাবুল সেটা ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়ই বুঝেছিল। কিন্তু আরাবুলের বাবা সেটা জানতেন না। কারণ,তার বাবা যে বাড়িতে থাকতেন না। কলকাতায় রাজমিস্ত্রি কাজের ঠিকাদারি করতেন। বছরে দু-চারবার বাড়ি আসতেন। বাড়ি এলেও বাড়িতে বেশিদিন থাকতেন না। বড়জোর চারদিন। তারপর আবার লেবার, মিস্ত্রি নিয়ে চলে যেতেন। যে ক’টা দিন বাড়িতে থাকতেন আরাবুলের মা তার বাবার সঙ্গে খুব ভালো ব‍্যবহার করত। বাড়ি থেকে কখনো বের হতো না। কোন পরপুরুষের সঙ্গে মিশত না। এমনকি কোন পরপুরুষকে তার মুখটা পর্যন্ত দেখাত না।নিজের শরীরটা আর সুন্দর মুখটা পর্দার আড়ালে সবসময় ঢেকে রাখত। ধর্ম কর্ম করত, কোরান পড়ত, ওয়াজ নসিহত শুনত আর নামাজ পড়ত। সে যে একটা পাক্কা চরিত্রবান মেয়ে এবং একটা ভালো পরহেজগার স্ত্রী সেটা তার বাবাকে দেখাত। আর তার বাবা সেটা ধরে নিয়েই বসেছিলেন। কিন্তু নিজের কর্মক্ষেত্রে তিনি যেই চলে যেতেন অমনি তার মা সব ছেড়ে দিত। তখন কী বা পর্দা করা, কী বা নামাজ পড়া, কী বা কোরান পড়া! সাজগোজ করে আলগা মাথায় অর্ধেকেরও বেশি বুক উদোম করে পাড়া পাড়া ঘুরে বেড়াত। তার মাংস বহুল নিতম্বে ঢেউ তুলে। আরাবুলের বাবা তো এসব কিছু দেখতে পেতেন না। কিন্তু বাড়িতে থাকত বলে আরাবুল সব দেখতে এবং শুনতে পেত। তাইতো, সে একদিন তার মাকে বলেছিল, “মা,বাবা বাড়িতে না থাকলে তুমি অত সাজগোজ করে পাড়া পাড়া ঘুরে বেড়াও কেন?”
“আমার মন চায় তাই বেড়াই। তাতে তোর কী শুনি!”
“আমার ভাল্লাগেনা।”
“তোর ভাল্লাগার সাথে আমার কী সাথ?”
“তাও মেয়েমানুষের অত পাড়া বেড়ানো ঠিক নয়। লোকে আ-কথা কু-কথা বলবে। সেসব কি শুনতে ভালো লাগবে?”
“যে শালা বলবে সে শালাকে তখন দেখে নেবো।সে শালার অণ্ডকোষ কেটে নেবো।”
“মা,মেয়ে মানুষ হয়ে তুমি—–”
“হ‍্যাঁ, কী ভেবেছিস আমাকে! আমি পাড়া বেড়াই পাড়া বেড়াবো।”
“না মা, তুমি পাড়া বেড়াবে না।”
“কী বললি! পাড়া বেড়াবো না?”
“না, বেড়াবে না। আমি তোমাকে নিষেধ করছি।”
“তুই কি আমার ভাতার নাকি যে, আমি তোর নিষেধ শুনব? তুই আমাকে নিষেধ করার কে শুনি!”
“ছি:মা,ছি:!”
“তুই যতই ছি-ছি কর,আমি কিন্তু পাড়া বেড়াবোই।”
“ঠিক আছে, বেড়াও। এরপর বাবা বাড়ি এলে বাবাকে সব বলে দেবো। দিয়ে তোমাকে আচ্ছা করে মারতে বলব এবং হাত, পা ভেঙে দিয়ে বাড়িতে ফেলে রাখতে বলব। যাতে তুমি আর কোনদিন পাড়া বেড়াতে না পারো।”
“বলে দিস! তোর বাবাকে আর তোকে তাহলে খাবারের সাথে বিষ মাখিয়ে দিয়ে মেরে দেবো। আমাকে তোরা চিনিস না। আমি কেমন মেয়ে তখন চিনবি।”
ফলে আরাবুল তার বাবাকে তার মায়ের ব‍্যাপারে ভয়ে কোনদিন কোন কথা বলত না, আরাবুলও না। সুতরাং তার মা সাহস পেয়ে গিয়ে যখন যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াত। একদিন তো আরাবুল কুমারের সঙ্গে….তাকে দেখেই ফেলেছিল। আরাবুল তাদের দেখে ফেললেও আরাবুলকে তারা দেখেছিল না। দেখলে পরে কী যে হতো! হয়তো তারা তাদের চরিত্র দোষ ঢাকার জন্য তাকে মেরে দিত। দিয়ে মাটি খুঁড়ে পুঁতে রাখত। পরে আরাবুলও তাকে আর কোনদিন বুঝতে দেয়নি যে,সে তাদের কুকীর্তি দেখেছে।সে তাদের গোপন পাপ দেখেছে। সে তাদের গোপন পাপের খবর সব জানে।
কিছুদিন বাদে তার বাবা এসেছিলেন। আরাবুল তার বাবাকেও ঘটনাটা বলেছিল না। বলতে তার সম্মানে বেধেছিল। মায়ের এতবড় কুকীর্তির কথা পরমপূজনীয় বাবাকে সে বলবে কী ভাবে? কাউকে বলতে না পারার দুঃখে আরাবুল সবসময় কেমন মনমরা হয়ে থাকত। যে নারীকে সে পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ নারী বলে চিনে এসেছে, যে নারীকে সে মা বলে জেনে এসেছে, যে নারীকে সে হৃদয় মন্দিরে অধিষ্ঠিত করে মাতৃ রূপে পূজা করে এসেছে এতকাল তার চরিত্রে এত কালিমা! তার চরিত্রে এত কলুষতা! তার চরিত্রে এত পাপ! এত দাগ! বাবাকে সেদিন তার জমি দিতে বারণ করার কারণই ছিল এটা। তার বাবা আসল বিষয়টা জানতেন না বলেই সেদিন জমিটা দিয়েছিলেন। জানলে পরে কক্ষনো দিতেন না, কক্ষনো না। আরাবুল এখন বুঝতে পারছে যে,পরে যা হতো হতো বিষয়টা তার বাবাকে জানানো উচিত ছিল। একটু খারাপ হয়তো লাগতো, তার বাবার শুনে একটু কষ্ট হয়তো হতো,কিন্তু তার বাবার জমির মধ্যে যেটা সেরা জমি সেই জমিটা হারাত না। তার বাবার নামে থাকত। তার বাবা মারা গেছেন। সুতরাং এখন তার নামে থাকত। তার আরও পাঁচ বিঘা জমি বেশি হতো।পাঁচ বিঘা জমির আজকাল কী দাম! সেই ঘুণ পোকাটা আরাবুলকে এখন সবসময় কুরে কুরে খায়, সবসময় কুরে কুরে…
—————-

উম্মেসা খাতুন, জেলা-মুর্শিদাবাদ।পশ্চিম বঙ্গ,ভারত।

সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

সংবাদটি শেয়ার করুন