মুক্তিযুদ্ধ

জীবন কথা মুক্তিযুদ্ধের বিদেশি সেনানী লুসি হল্ট

লুসি হল্ট
লুসি হল্ট
সেলিম কামাল: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অনেক বিদেশি নাগরিকের অবদান সম্পর্কে আজ আমরা সবাই কম-বেশি জানি।
 
অসীম সাহসিকতার সঙ্গে একেকজন বিদেশি নাগরিক স্বাধীনতার জন্য, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এ দেশের মানুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ে গেছেন। ইংল্যান্ডের লুসি হল্ট তাদের অন্যতম।
 
মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে তিনি আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে ইংল্যান্ডের নিশ্চিত সুখের জীবন ছেড়ে চলে এসেছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। উন্নত দেশের সব সুযোগ-সুবিধা দু’পায়ে ঠেলে তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত এক জাতির সেবায় নিয়োজিত করেছিলেন নিজেকে।
 
তিনি সিস্টার লুসি হেলেন ফ্রান্সিস হল্ট। ১৯৩০ সালের ১৬ ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের সেইন্ট হেলেন্সে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬০ সালে মানবিক কাজে অংশগ্রহণের জন্য তিনি বরিশালের অক্সফোর্ড মিশন চার্চে যোগ দিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আসেন।
যখন এসেছিলেন, ছিলেন নিতান্তই ত্রিশ বছর বয়সী এক যুবতী। কিন্তু এ দেশে আসার পর এ দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর মানুষের সারল্যে তিনি এতটাই আবিষ্ট হন যে, এরপর আর কখনও তিনি তার নিজের দেশ ইংল্যান্ডে ফিরে যাননি!
 
লুসি একাধারে দীর্ঘ ৫৯ বছর ধরে নীরবে-নিভৃতে সেবা করে যাচ্ছেন এ দেশ আর তার মানুষের। বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসা এই নারী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন অনেক প্রতিকূল পরিবেশে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর চরম অত্যাচার, নির্যাতন দেখেও দমে যাননি, বুক ভরা সাহস নিয়ে চিকিৎসা আর সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছেন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারণ মানুষকে।
 
পাকিস্তানি সামরিক-জান্তা অবশ্য তাকে মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকেই নিরাপত্তার অজুহাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। লুসি সেই নির্দেশ অমান্য করে থেকে যান এ দেশেই।
 
পাকিস্তানি সামরিক-জান্তার নির্দেশে বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তান) ত্যাগ না করে মুক্তি-পাগল বাঙালির পাশে দাঁড়িয়ে, তাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
 
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে চার্চ বন্ধ হয়ে যায় এবং লোকজনকে সেখান থেকে বের করে দেয়া হয়। লুসি সেখান থেকে চলে যেতে অস্বীকৃতি জানান এবং আহত মুক্তিযোদ্ধা আর সাধারণ জনগণকে চিকিৎসা সেবা দেয়া শুরু করেন। যশোরের ফাতেমা হাসপাতালে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় অবস্থান করে আহতদের চিকিৎসা আর সেবা দিয়ে আমাদের মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন।

 

যুদ্ধ শেষ হলে তিনি আগের মতো মানবতার কল্যাণে কাজ করে যেতে থাকেন। তবে ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে চিঠি লিখে শুভেচ্ছা জানান, আর সঙ্গে নিজের হাতে অ্যাম্ব্রয়ডারি করা একটি রুমাল পাঠান উপহার হিসেবে।
 
ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সে সময় ব্যস্ত থাকায় তার ছোট মেয়ে শেখ রেহানা সেই চিঠির জবাবও পাঠান, যাতে তিনি তার মায়ের পক্ষ থেকে লুসিকে ধন্যবাদ দেন।
 
২০১৭ সালে তাকে নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তথ্যভিত্তিক রিপোর্ট প্রকাশ পায়। প্রকাশ হতে থাকে মুক্তিযুদ্ধে বাংলার মানুষের জন্য লড়াই করা এক সেনানীর নীরব জীবনের কথা। আরও জানা যায়, তার জীবনের একটা ইচ্ছার কথা। সেই ইচ্ছা হল, বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে এ দেশের মাটিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা।
 
আশার কথা হচ্ছে, অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজকে তিনি বাংলাদেশের নাগরিক। বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ হাতে তার হাতে নাগরিকত্ব সনদ তুলে দেন।
 
এর আগে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে বরিশালের একটি জনসভায় প্রধানমন্ত্রী তার হাতে ১৫ বছরের মাল্টিপল ভিসাসহ পাসপোর্ট তুলে দিয়েছিলেন।
 
বর্তমানে লুসি অসুস্থ। বার্ধক্যজনিত জটিলতা আর তার বাসস্থানের লাগোয়া উঠোনে পড়ে গিয়ে কোমরে ব্যথা পেয়েছেন। সরকার তার চিকিৎসার সব খরচ বহন করার দায়িত্ব নিয়েছে।
 
লুসি হেলেন ফ্রান্সিস হল্ট এক নিঃস্বার্থ মানুষের নাম। যার জীবন মানুষের সেবায় কেটে গেছে। মানবকল্যাণই যার জীবনের উদ্দেশ্য এবং আদর্শ।
 

 

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

three × five =