ফিচার্ড মুক্তিযুদ্ধ লেখালেখি

স্বাধীনতার মহান স্থপতি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বাংলাদেশ ।। বিদ্যুৎ ভৌমিক

১৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মদেনে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি

স্বাধীনতার মহান স্থপতি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বাংলাদেশ ।। বিদ্যুৎ ভৌমিক

বাংলাদেশের অভ্যূধ্যয়ে যে মহান, ত্যাগী ও সংগ্রামী  মানুষটি তার জীবনের সর্বস্ব উজাড় করে পৃথিবীর ইতিহাসে একটি নতুন দেশ উপহার দিয়েছেন ,সেই স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি, গণসংগ্রামে সর্বদা আপসহীন ও  জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের  জন্মবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করছি। গোটা জাতি বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছে তাদের আস্থার প্রতীক স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সীমাহীন দেশপ্রেম, তুলনাহীন রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, অসীম সাহস, দূরদর্শিতা আর দৃঢ় নেতৃত্বে এই শষ্য শ্যামলা ভূখণ্ড একাত্তরের (১৯৭১) মার্চে এসে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠেছিলো। ৫২ বছর পূর্বে ১৯৭১ সালের এই মার্চ মাসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি জাতি দীর্ঘ স্বাধীনতা যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বে উপনীত হয়। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) প্রদত্ত ১৮ মিনিটের মহাকাব্যিক ভাষণে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা তথা জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ঘোষণা ও সামগ্রিক দিক নির্দেশনা প্রদান করেন। ইতিহাসের দীর্ঘ পাঠ থেকে বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রাম দীর্ঘ আন্দোলন ও রক্তপাতের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত পর্বে উপনীত হয়েছিল ১৯৭১ সালে।

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভাজিত হলে এই ভূখণ্ডের বাঙালিরা নব্য স্বৈরাচারী পাকিস্তানী উপনিবেশের অন্তর্ভুক্ত হয়। যে স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্যের জন্য বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রাম ও রক্তদান, পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ফলে তা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থতায় পরিগণিত হয়। ১৯৫২ সালে সূচিত ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাঙালি তার অস্তিত্বের প্রকৃত সত্য ও জীবনের গন্তব্য সম্পর্কে সচেতন হতে শুরু করে এবং এই অস্তিত্ব সচেতন লক্ষ্যাভিমুখী জাতিসত্তা সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান দিক নির্দেশক হিসেবে আবির্ভূত হন।

বাঙালির আত্মপরিচয়ের সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই। সেই আত্মপরিচয়ের সংগ্রামকে আত্ম-আবিষ্কার ও স্বাধীন-সার্বভৌম জাতিসত্তায় উত্তরণের ক্ষেত্রে ২৩ বছরের দীর্ঘ সংগ্রামে বাঙালির আত্মত্যাগ ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে অংশগ্রহণ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৬৬ সালের জুনে বঙ্গবন্ধুর ছয় (৬) দফার ঘোষণা থেকেই মূলত বাঙালির আত্মপরিচয়ের সংগ্রাম আত্ম-আবিষ্কারের সুস্পষ্ট ধারায় প্রবাহিত হতে শুরু করেছিল। ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন, ১৯৭১-এর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এবং বাঙালি জাতির ওপর পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বর্বর আক্রমণকালে জাতির পিতার স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা তারই গৌরবোজ্জ্বল ও রক্তস্নাত অধ্যায় বাঙালি জাতিসত্তা দীর্ঘ পথচলায় অজস্র অগ্নি-পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছে। দুর্জয় মনোবল, দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও আত্মত্যাগের মহিমায় আদর্শ নিয়ে সেই সব অগ্নি-পরীক্ষায় বাঙালি জাতি উত্তীর্ণ হয়েছে।

স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ  তদানীন্তন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম শেখ লুৎফর রহমান ও মায়ের নাম সায়েরা খাতুন।তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমান ছিলেন গোপালগঞ্জ দেওয়ানি আদালতের সেরেস্তাদার। মুজিব ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তৃতীয় ছিলেন।  স্কুল জীবন থেকেই মুজিবের মধ্যে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের গুণাবলীর বিকাশ ঘটে । তিনি যখন গোপালগঞ্জ মিশনারী স্কুলের ছাত্র সে সময় একবার অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ.কে ফজলুল হক ও খাদ্যমন্ত্রী এইচ. এস সোহরাওয়ার্দীর ঐ স্কুল পরিদর্শনে আসেন ১৯৩৯ খ্রী:। শোনা যায়, ঐ অঞ্চলের অনুন্নত অবস্থার প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তরুণ মুজিব বিক্ষোভ সংগঠিত করেন এবং  মুখ্যমন্ত্রীর পথ রোধ করে দাড়িয়েছিলেন । স্কুলের প্রধান শিক্ষক খুব ভয় পেয়েছিলেন । মুখ্যমন্ত্রী এ.কে ফজলুল হক তরুন ও প্রতিবাদী বালক বঙ্গবন্ধু মুজিবের সৎসাহস দেখে খুশীই হয়েছিলেন এবং ১২০০ টাকা মঞ্ছর করেন । মুখ্যমন্ত্রী এ.কে ফজলুল হক ও খাদ্যমন্ত্রী এইচ. এস সোহরাওয়ার্দীর তখনই বুজতে পেরেছিলেন,এ  তরুণ বালকের মধ্যে দেশমাতৃকার ভবিষ্যৎ নেত্যৃত্ব লুকিয়ে ছিল। সত্যিই তাই হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর পিতামাতা লুৎফর-সায়েরা দম্পতির এ উজ্জল সন্তানই পরে এ দেশের মানুষের স্বাধীনতা ও মুক্তির ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হন। মধুমতি, বাইগার নদীতে সাঁতার কেটে কেটেছে যার দুরন্ত শৈশব। সময়ের পরিক্রমায় এই খোকাই একদিন হয়ে উঠেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদি নেতা। টুঙ্গিপাড়ার অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী বালকটি  হয়ে ওঠেন স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি, বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর দায়িত্ব নেয়ার মতো মহান গুণ হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান  শৈশব থেকেই। মুষ্টি ভিক্ষার চাল উঠিয়ে গরীব ছেলেদের বই এবং পরীক্ষার খরচ বহন করা, বস্ত্রহীন পথচারী শিশুকে নিজের নতুন জামা পরাতেন। রাজনৈতিক দীক্ষাও নেন স্কুল জীবনেই। ১৯৪৩ সালের বাংলায় দুর্ভিক্ষের সময়ের কথা বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে নিজেই তুলে ধরেছেন- ‘দিন রাত রিলিফের কাজ করে কুল পাই না। লেখাপড়া মোটেই করি না। কলকাতা যাব, পরীক্ষাও নিকটবর্তী। আব্বা একদিন আমাকে ডেকে বললেন, ‘বাবা রাজনীতি কর, আপত্তি করব না। পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করেছ, এত সুখের কথা। তবে লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবা না।’

ম্যাট্রিক পাশের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কলকাতায় গিয়ে ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন । সেখান থেকেই তিনি আই.এ ও বি.এ পাশ করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র-সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন । ভারত বিভাগের (১৯৪৭) পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন অধ্যয়নের জন্য ভর্তি হন । তবে পড়াশুনা শেষ করতে পারেন নি । কারণ যে মুজিবের শিরা উপশিরায় অন্যায়/অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের  বীজ লুকিয়ে আছে সে কি চুপ থাকতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ন্যায্য দাবি দাওয়ার প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ঔদাসীন্যের বিরুদ্ধে তাদের বিক্ষোভ প্রদর্শনে উস্কানি দেওয়ার অভিযোগে তাঁকে ১৯৪৯ সালের প্রথমদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হয়। এটা স্মরণ রাখা দরকার যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন ভাষা আন্দোলনের প্রথম কারাবন্দীদের একজন (১১ মার্চ  ১৯৪৮ সাল)।

১৯৫৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা ভাষার প্রশ্নে তাঁর প্রদত্ত ভাষণ ছিল উল্লেখযোগ্য। মাতৃভাষায় বক্তব্য রাখার অধিকার দাবি করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, “আমরা এখানে বাংলায় কথা বলতে চাই । আমরা অন্য কোনো ভাষা জানি কি জানি না তাতে কিছুই যায় আসে না। যদি মনে হয় আমরা বাংলাতে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারি তাহলে ইংরেজিতে কথা বলতে পারা সত্ত্বেও আমরা সবসময় বাংলাতেই কথা বলবো । যদি বাংলায় কথা বলতে দেওয়া না হয় তাহলে আমরা পরিষদ থেকে বেরিয়ে যাবো। কিন্তু পরিষদে বাংলায় কথা বলতে দিতে হবে । এটাই আমাদের দাবি।“ ১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্ট গণপরিষদে প্রদত্ত আরেক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পূর্ববঙ্গের নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান রাখার প্রতিবাদে যে বক্তব্য রাখেন তাও এখানে দেওয়া হল ,”স্যার, আপনি লক্ষ্য করে থাকবেন যে, তারা পূর্ববঙ্গের স্থলে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ বসাতে চায় । আমরা বহুবার দাবি জানিয়ে এসেছি যে, [পূর্ব] পাকিস্তানের পরিবর্তে আপনাদের পূর্ব [বঙ্গ] ব্যবহার করতে হবে। ‘বঙ্গ’ শব্দটির একটি ইতিহাস আছে, আছে নিজস্ব একটি ঐতিহ্য…।“

১৯৬৬ সালের ৭ জুন স্বাধীনতার মহান স্থপতি ও জাতির জনক রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান  বাঙালি জাতির বাঁচার দাবী ও মুক্তির সনদ ঐতিহাসিক ৬ দফা ঘোষনা করেন । সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর ঘোষিত ৬ দফা দাবির পক্ষে দেশব্যাপী তীব্র গণ-আন্দোলনের সূচনা হয় । ১৯৬৬ সালের ৭ জুন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবীর পক্ষে আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালে টঙ্গী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে তৎকালীন স্বৈরাচারী আইউব/মোনায়েম সরকারের লেলিয়ে দেওয়া পুলিশ ও ইপিআরের গুলিতে মনু মিয়া, শফিক, শামসুল হকসহ ১১ জন বাঙালি শহীদ হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঘোষিত ৬ দফা দাবির মুখে পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাসক ও পাকিস্তানের স্বৈরাচারী প্রসিডেন্ট আইয়ুব খান এতই বিচলিত ও স্বৈরাচারী হয়ে পড়েন যে, তিনি হুমকি দিয়ে বলেন, ৬ দফা নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে অস্ত্রের ভাষায় জবাব দেওয়া হবে । বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতার ইতিহাসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ৬ দফা একটি আলোকিত মাইলফলক হিসাবে বাঙ্গালি জাতিকে প্রেরণা যুগিয়েছিল । ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে তাঁর বিখ্যাত ছয়দফা কর্মসূচী ঘোষণা করেন এবং তিনি এই ছয় দফাকে বাঙালি জাতির মুক্তি সনদ রূপে আখ্যায়িত করেন । সকল রাজনৈতিক দলের  তৎকালিন রক্ষণশীল ডানপন্থী সদস্যরা এ কর্মসূচীকে আতঙ্কের চোখে দেখলেও এটা তরুণ সমাজ বিশেষত ছাত্র, যুবক,কৃষক এবং শ্রমজীবি মানুষের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা নূতন জাগরণের সৃষ্টি করেছিল। প্রকৃতপক্ষে ছয়-দফা কর্মসূচীর মধ্যেই কার্যত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বাধীনতার অমৃতময় বীজ নিহিত ছিল। বাঙালি জাতির বাঁচার অধিকারের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এমন  ত্যাগ, বীরত্ব, সাহসিকতার সাথে পালন করেছেন যে, যিনি ২৪ বছরের পাকিস্তানি শাসনামলের প্রায় বারো বছর তিনি জেলে কাটিয়েছেন । বারো বছর জেলে এবং দশ বছর কড়া নজরদারীতে থাকার কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে পাকিস্তানকে একটি স্বাধীন দেশের বাসভূমির পরিবর্তে বরং কারাগার বলেই মনে হতো ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তৎকালীন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল। কিন্তু পাকিস্তানের অত্যাচারী ও স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান শেষ পর্যন্ত সমগ্র পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকার করেন এবং নিরস্ত্র বাঙালির ওপর তিনি ভয়ংকর দমন অভিযান চালান ।  ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রমনার রেসকোর্সের জনসভায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে পুরো বাঙালি জাতি স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ১৮ মিনিট স্থায়ী এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বজ্রকন্ঠে ঘোষনা করেছেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। বঙ্গবন্ধুর এই তেজদিপ্ত-বজ্রকন্ঠের ঘোষণার মধ্যেই মূলত নিহিত ছিল আমাদের মহান স্বাধীনতা, আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ । ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চের কালো রাতে বিশ্বাসঘাতক পাকিস্তানী হানাদারবাহিনী সব মূল্যবোধ ও ন্যায়নীতি লঙ্ঘন করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিরস্ত্র ও নিরপরাধ বাঙালীর ওপর। সেদিন বঙ্গবন্ধুর এই তেজদিপ্ত-বজ্রকন্ঠের ঘোষণায় সারা দিয়ে‘যার যা আছে তাই নিয়ে’ বাংলাদেশের কৃষক,শ্রমিক ও ছাএ জনতা আমাদের প্রানপিয় মাতৃভূমিকে রক্ষাকরার বলিষঠ চেতনায় উদবুদধ হয়ে স্বা‌ধীনতার মশাল ও অস্ত্র হাতে নিয়ে পাকিন্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ভারতের বলিষ্ঠ ভূমিকা ও সহযোগীতায় দীর্ঘ নয় মাসের নিরন্তর মুক্তির লড়াইয়ের পর বিজয়ী হয় বাঙালি জাতি। আমরা ছিনিয়ে এনেছি অামাদের মহান স্বাধীনতা, আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ। পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়েও এ ঐতিহাসিক ভাষণ অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল । তাঁর এই ভাষণকে বিশ্বের ইতিহাসের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণের মধ্যে একটি অন্যতম ভাষণ বলে গণ্য করা হয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের বিভিষিকাময় রাতে স্বাধীন দেশের মহান স্থপতি ও জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ঘটনাটি ছিলো একাধারে নৃশংস, কাপুরুষোচিত ও বীভৎস – গোটা জাতি হয়েছিলো স্তম্ভিত । বীরত্ব, সাহস ও তেজস্বীতার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের  ছিলেন ভাস্বর । স্বাধীনতার মহান স্থপতি হিসাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংগালি জাতির জন্য সম্ভাবনার অসীম দিগন্ত উন্মোচন করিয়া গিয়াছেন। কিন্তু আজ বঙ্গবন্ধু নেই। তার সপ্ন এদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি আজ অাংশিকভাবে পূরণ হয়েছে । বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারীরা তাঁরই জেষ্ঠা কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই বর্তমান সরকার টানা তৃতীয়বারের মতো সাফল্যের সাথে দেশ পরিচালনা করছে। জেষ্ঠা কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তভূক্ত হয়েছে । গত বছর ২২-২৬ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে এলডিসি স্ট্যাটাস পর্যালোচনা করে বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তরণের সুপারিশ করা হয়। এটা বাংলাদেশের জন্য এক গৌরবময় অর্জন।

আমরা মনে করি, বর্তমান সরকারের সামনে প্রধান কাজটিই হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে দেশে আইনের শাসন প্রতিষঠা করতে হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। দূর্নীতিবাজ, ভূমিদষ্যু ও অপরাধীরা যতই শক্তিশালী হউক-তাদের কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গনতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশই আগামীতে সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশকে এগিয়ে চলার পথ মসৃন করবে। দেশে স্বাধীনতা বিরোধী উগ্র মৌলবাদী শক্তি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, উগ্র মৌলবাদী শক্তি  বিভিন্ন অজুহাতে বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু বৌদ্ধদের উপর হামলা চালাচ্ছে, হুমকি দিচ্ছে, মন্দির ভাংচুর করছে ও দেশত্যাগের হুমকি দিচ্ছ। মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে এসব উগ্র মৌলবাদী শক্তিকে কঠোর হস্তে দমন করতে হবে।  বাংলাদেশের জন্ম একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিশেবে। আমরা সবাই বাংলাদেশী, আমাদের ধর্ম যাই হোক না কেন।  মাননীয়া প্রধানমন্ত্রীকে দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের সংস্কুতিটা বন্ধ করতে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা, সুগভীর দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের অন্তর্নিহিত গনতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাই হতে পারে আগামীতে বাংলাদেশ ও বাঙ্গালি জাতির অগ্রগামিতা, উন্নতি ও এগিয়ে চলার মহৎ প্রেরণা।

২০০৪ সালে বিবিসি’র বাংলা রেডিও সার্ভিসের পক্ষ থেকে সারা বিশ্বে যে জরিপ চালানো হয়, তাতে বঙ্গবন্ধু মুজিব সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে বিবেচিত হন। জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে কিউবার রাষ্ট্রপতি ফিদেল ক্যাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গন করে বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম বার্ষিকী  উদযাপনের  দিনে আমরা পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি এই মহান নেতাকে। বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি দেশমাতৃকার জন্য তাঁর কাজ,  তাঁর আত্বত্যাগ, তাঁর সৎসাহস ও সুমহান আদর্শকে ।

আজ কানে বারংরার যেন বেঝে উঠছে-
“যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা যমুনা গৌরী বহমান,
ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান “


তথ্যসূত্র: বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিভিন্ন লেখা থেকে নেওয়া হয়েছে।


বিদ্যুৎ ভৌমিক: সাবেক অধ্যাপক, লেখক ও সিবিএনএ’র উপদেষ্টা। মন্ট্রিয়ল, ক্যানাডা

 



 

সংবাদটি শেয়ার করুন