ফিচার্ড সাহিত্য ও কবিতা

টোকাই |||  সুশীল কুমার পোদ্দার

টোকাই |||  সুশীল কুমার পোদ্দার
অবশেষে  ব্যামাচরণ চাকুরী পেল। দীর্ঘ বেকারত্বের অসহনীয় যন্ত্রণার আজ যেন অবসান ঘটল। কিন্তু চাকুরীটা কিভাবে  হলো, কেন হলো সে কিছুই বুঝতে পারল না। যেখানে এ বঙ্গদেশে টাকা ও মামা ছাড়া কোন চাকুরী হয় না, সেখানে আজ তাকে  ওরা কেন চাকুরী দিল – কিছুতেই সে কুল কিনারা করতে পারলো না।
আজ সকালে মাথায় করে বাড়ীর এক মানকচু বাজারে নিয়ে যাবার পথে কমিশনারের  জূয়াখোর ছেলে সামসুর সাথে দেখা হতেই সে ভয়ে পালাতে চাইলো। কদিন আগেই সে তার দলবল নিয়ে হুমকি দিয়ে গেছে বাড়ীটা ওদের হাতে তুলে দিয়ে ভারতে চলে যেতে। বাবা ও দাদারা ভয়ে রাজী হয়েছে, একমাত্র সে ছাড়া। তাই সে প্রতিমুহূর্তে আতঙ্কে থাকে। কিন্তু আজ সামসু ওকে দেখে নমস্কার দিল। ভদ্র ভাবে বলল দা-দা কেমন আছ? ব্যামাচরণ ভয়ে কোন উত্তর দিতে পারল না। মাথার কচুটা ফেলে দিয়ে সে দৌড়ে পালাতে উদ্যত হলো। সামসু ওকে আদর করে বসাল চা স্টলে । বহুদিন পর কাঠি বিস্কুট চা তে ভিজিয়ে খেতে যেয়ে তার চোখ অশ্রুতে ভরে উঠল। সামসুর এই মহানুভবতায় সে  ভীষণ লজ্জিত হলো। সে সামসুকে কতোই না মন্দ ভেবেছে ! সে এক মুহূর্তে ভুলে গেল ওর বাবা যুদ্ধের সময় ওর মুক্তিযোদ্ধা কাকাকে ধরিয়ে দিয়েছিল, যুদ্ধের পর অনেক হিন্দু সম্পত্তি দখল করে  কতজনকে সে দেশ ছাড়া করেছে!
ব্যামাচরণ চা বিস্কুট শেষ করতেই তার মনে দুশ্চিন্তার উদ্রেক হলো। সে ফ্যালফ্যাল করে সামসুর দিকে তাকিয়ে রইলো। সামসু ওর হাতে একশত টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিয়ে মোটর বাইকে বসিয়ে বাড়ীতে পৌঁছে দিল । ব্যামাচরণ কে ভয় দেখানোর জন্য সামসু বারা বার ক্ষমা চাইলো। বার বার বলল, হাজার হইলেও তোরা আমাদের প্রতিবেশী। সামসু বাইচ্যা থাকতে তোদের কোন ভয় নাই। ঘাড়ে হাত রেখে  বলল ব্যামা, যদিও তুই আমার চেয়ে বয়সে একটু বড়, তবু তুই তো আমার স্কুলের বন্ধু।  আমি আমার লিডারের সাথে কথা বলেছি  তোর জন্য। তোকে আজি বিকেলে নিয়া যাবো।
ব্যামা উদ্বেগে দুপুরে খেতে বসে বার বার বিষম খেল। সুটকেস খুলে দিদির দেওয়া একটা  রঙ্গিন সার্ট পড়ে বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকল। অবশেষে অপেক্ষার প্রহর কেটে ফটফট শব্দ করতে করতে সামসু হাজির হলো। সে বয়সের ব্যবধান ভুলে যেয়ে সামসুকে পরম বন্ধু ভেবে জড়িয়ে ধরল।
ওরা এক বিরাট চকচকে অফিসে হাজির হলো। অফিসের দেওয়ালে নেতা-নেত্রির ছবি,  ছবি দেখে সে আবেগে আপ্লূত হলো। চেয়ারে বসতে সে  ভীষণ ইতস্তত বোধ করতে লাগলো। লিডার মুখ খুলতেই ভুরভুর করে মদের একটা কটু-গন্ধে ঘরটা ভরে উঠল । লিডারকে দেখে ভয়ে তার শরীরটা কেন যেন অবশ অবশ বোধ হল। লিডার তাচ্ছিল্য নিয়ে বলল – এই তোর নাম কি?  ব্যামাচরণ চি চি করে ওর নাম বলতে চেষ্টা করল। সামসু ওর হয়ে  বলে দিল – বামা। লিডার ওর নাম শুনে চর্বিত দেহ দুলিয়ে দুলিয়ে  হাসতে লাগল। অতীব প্রসন্ন চিত্তে বলে উঠল – তোর নামটা বড় পছন্দ হয়েছে রে ব্যামা ক্ষ্যাপা।  আমি হিন্দুদের বড় ভালবাসি। ওরা বড় বেশি প্রভুভক্ত। যা তোর চাকুরী হয়ে গেছে। সামসু সব বুঝাইয়া দেবে।
সামসু ওকে নিয়ে আরেকটা ঘরে বসল। সাড়া ঘর জুড়ে লিডারের ছবি। বড় বড় নেতার সাথে বিদেশ গমনের ছবি। যাদের সে ভালো মানুষ ভেবেছে তাদের সাথেও ছবি। সামসু ওকে ছবিগুলে দেখিয়ে হৃষ্ট চিত্তে  বলে উঠলো – তোর ভাগ্য ভালো রে বামা,  লিডার তোর সাথে, তোর সাথে কথা বলছে। শুন মন দিয়ে কাজ করবি। প্রাথমিক ভাবে তিন মাসের চাকুরী, বাড়তেও পারে। তবে কপাল ভালো থাকলে এই তিন মাসেই তুই কোটি পতি হয়ে যাবি।  ব্যামা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। ভয়ে তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, সামসু ভাই, তোমার পায়ে পড়ি – আমি মানুষ খুন করিতে পারিব না, আমায় ছাড়িয়া দাও। সামসু দমক দিয়া হেসে উঠল। ব্যামাকে আশ্বস্ত করে বলল, আরে বোকা,  বড় সোজা কাজ। এই রাখ সেল-ফোন, আর এই দূরবীন। ব্যামা কিছুই বুঝতে পারল না। সামসু কাগজ কলম নিয়ে  বসল। ভ্রু কুঞ্চিত করে কাগজে আকিঝুকি করতে করতে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা বলে ফেলল। তোর এ চাকুরীটা কমিশনের চাকুরী। তুই যা পাবি, তোর বাসায় রেখে  দিবি। পরে সময় সুযোগ বুঝে ভাগ করে নেব। তোর ৩০%, আমার ২০% আর লিডারের ৫০%। লিডারকে আবার ওখান থেকে দিতে হবে গালকাটা গুড্ডুকে। গালকাটা গুড্ডু আমাদের লিডারকে জেলখানা থেকে জরুরী খবর পাঠাইছে – সমাজের অপরাধীরা ঘরে টাকা রাখতে ভয় পাচ্ছে, পাছে ধরা পড়ে,  ব্যবসার এখনি সময়। ব্যামা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বলে-  আগে বল –  কিসের চাকুরী? সামসু গম্ভীর হয়ে বলে – টোকাইয়ের চাকুরী। তোকে বিভিন্ন জায়গায় assignment দেওয়া হবে। আমাদের লোক তোকে গাইড করবে। তুই সারাদিন দুরবিন দিয়া বিল্ডিঙয়ের চাপা গলি, নদীর পার, পুকুর পার, বড় বড় ড্রেন, ডোবার দিকে নজর রাখবি।  কোন বস্তা ভেসে যেতে দেখলেই জড়াইয়া ধরিবি। তবে একটু খুইলা দেখবি, লাশ থাকলে রাইখ্যা আসবি, শুধু টাকা হলেই উঠাইয়া নিয়া আসবি। এখন হইলো ভরা মৌসুম। রাত্রে মন্ত্রী মিনিস্টারদের বাড়ীর ডাস্টবিনের দিকে নজর রাখতে হবে। দেখ বন্ধু বলেই এতো বড় একখানা চাকুরী দিলাম। আমরা সমস্ত বড়বড় শহরে এজেন্ট নিয়োগ দিচ্ছি। তোর বন্ধু বান্ধব থাকলে বলিস।
ব্যামা হাসবে, না কাঁদবে,  বুঝতে পারে না। কালকেই ওকে ঢাকা যেতে হবে। সামনে পূজা। মা-বাবাকে কোন দিন কিছু দিতে পারেনি। একটা ক্ষীণ আশা মনের এক কোনে বিদ্যুতের রেখার মতো ভেসে উঠে।  একটা স্নিগ্ধ বাতাস, একটা অব্যক্ত ভাললাগায় ভর করে  ও ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলে বাড়ীর পথে ..।


টোকাই |||  সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী ।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,  ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।
সংবাদটি শেয়ার করুন