ডোনাল্ড ট্রাম্প : উলঙ্গ সম্রাট ||||ড. মোস্তফা সারওয়ার
ডোনাল্ড ট্রাম্পের নার্সিসিস্টিক রুগ্ন ও আকস্মিত উত্তেজনা, তার অনুগত দুই ধান্দাবাজ প্রতারক এবং যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস ও রিপাবলিকান দলের মেরুদ্ণ্ডহীন দ্বিপদ-জন্তুদের দেখলে মনে পড়ে আজ থেকে প্রায় দু’শত বছর আগের ডেনিশ লেখক হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এন্ডারসনের শিশুতোষ পুস্তক ‘Emperor’s New Clothes’। যদিও তিনি লিখেছিলেন শিশুদের জন্য, শতবর্ষ ধরে ব্যবহার হচ্ছে রাজনীতিসহ বিবিধ বিষয়ে। বিভিন্ন সঙ্গীত নাট্য হয়েছে এই কাহিনীর ভিত্তিতে।
গল্পটির সারাংশ হচ্ছেঃ এক সময় এক সম্রাট ছিল নিদারুণ অহংকারী এবং নার্সিসিস্টিক – নিজেকে এবং নিজের রূপ নিয়েই বিভোর থাকতো। এক দিন দুই প্রতারক এল আজব প্রস্তাব নিয়ে। সম্রাটের জন্য এমন পোশাক বানাবে যা পৃথিবীর অন্য কারো ভাগ্যে জুটবে না। পোশাকটি হবে যাদুকরী। বোকারা এই পোশাক দেখতে পাবে না। একমাত্র বুদ্ধিমানের চোখে এর চাকচিক্য দৃষ্টি মধুর হবে। বিদূষক সভাসদরা সদা সর্বদা সম্রাটের গুণগান করতো। সম্রাটেরও পছন্দ সভাসদদের তোষামদ। সম্রাট রাজী হয়ে গেল। যেমন কথা তেমনি কাজ। দুই প্রতারকের পছন্দসই তাঁত, সুই, সুতা ইত্যাদি যোগাড় হল। সভাসদরা এল কাজের অগ্রগতি দেখার জন্য, সম্রাটও এল। তারা কাজের কোন অগ্রগতি দেখতে পেল না। শুধু তাঁত আছে, কিন্তু পোশাকের চিহ্ন নেই। কেউ কিছু বলল না, পাছে বোকা বনে যায়। সম্রাটও চুপ। ভাবলো যদি সে বলে, পোশাক দেখছে না তাহলে সবার কাছে সে বোকা বনে যাবে। বিদ্রোহ হবে। সাম্রাজ্যচূত হবে। প্রতারকরা একদিন সম্রাটকে উলঙ্গ করলো। নতুন পোশাক পরাবার ভঙ্গিমা করলো। তারপর সম্রাট এক জাঁকজমক প্যারেডের সামনে স্থান নিল। প্রজারা হতবাক। দেখল উলঙ্গ সম্রাট। কিন্তু ভয়ে কেউ হাসল না – সবাই চুপ। একটি শিশু সম্রাটকে উলঙ্গ দেখে হেসে লোটোপুটি। চিৎকার করে বলল ‘ছিঃ ছিঃ সম্রাটের কোন পোশাক নেই, উলঙ্গ।’
এবার আসা যাক ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্য্যাপারে। ৩ নভেম্বরের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্প হেরেছে বেশ ভালভাবেই- সাত মিলিয়ন ভোটের বেশি ব্যবধানে। যে ৫৩৮ জন নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সর্বশেষ সিদ্ধান্ত নেবে তার ৩০৬ জন বাইডেনের – ২৩২ জন ট্রাম্পের। অতএব বাইডেনের বিজয় অতি পরিষ্কার। নার্সিসিস্টিক ট্রাম্প কিছুতেই হার মানবে না। এই সুযোগ নিল দুই প্রতারক।
নার্সিসিস্টকরা এক ধরনের মানসিক ব্যাধিতে ভোগে; নিজ গুরুত্বের কয়েকগুন বেশি অনুভব, মাত্রাতিরিক্ত প্রশংসার কাঙ্গাল, ভক্তি ও চাটুকারিতা লাভের অদম্য ইচ্ছা এবং দয়ামায়াহীন নিষ্ঠুর চরিত্র। অনেকটা ইতিহাসের ঘৃণিত নমরুদ ও ফেরাউনের মত – নিজেকে খোদা ভাবে। ট্রাম্পের ভাতিজী ড. মেরি ট্রাম্প তার পুস্তকে এই ইঙ্গিত দিয়েছেন, তার কাকাবাবু ডনাল্ড ট্রাম্প এই সমস্ত রোগে সম্ভবত আক্রান্ত। ড. মেরি ট্রাম্প মনোবিদ্যার চিকিৎসক। ট্রাম্পের এই রোগের কারণ হিসাবে দেখিয়েছেন, ছেলে বেলা থেকেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের উপর তার নিষ্ঠুর পিতা ফ্রেড ট্রাম্পের অত্যাচার।
ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পেয়ে বসল তার মানসিক ব্যাধি ও দুই প্রতারক। একজন হল প্রাক্তন মেয়র ও আইনজীবী গত এক যুগে যার ট্রাম্প ছাড়া আর কোন মক্কেল নাই। দালালী আর তদবিরে করেছে লাইসেন্স পারমিটের ব্যাবসা।
এ বছর ৩ নভেম্ভরের নির্বাচন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। এই মতামত হল ভোট গ্রহণে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের, কাউন্টি এবং অঙ্গরাজ্য পর্য্যায়ের ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান উভয় দলের নেতৃবৃন্দের।
ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনে গরু হারা হেরেছে। ছলে বলে কলা কৌশলে যেমন করেই হোক গদি তার রাখতেই হবে। প্রতারক আইনজীবী ৬০টির মত ভূয়া মিথ্যা মামলা দায়ের করলো। ট্রাম্প নির্বাচন পাল্টে দেবে এই প্রচার চালিয়ে ভক্ত অনুরক্তদের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে ২০০ মিলিয়ন ডলার তুলে নিয়েছে। প্রতারক আইনজীবীর দায়েরকৃত মামলাগুলো একে একে ভন্ডুল হয়ে গেল। প্রতারক আইনজীবী প্রতিশ্রুতি দিল ট্রাম্পকে -সে মামলা করে বিজয় এনে দিবে। কিন্তু বাধ সাধলেন বিচারকরা। তিরস্কারের ভাষা দিয়ে মামলাগুলো প্রত্যাখ্যান করলেন বিচারকরা যাদের – অনেকেই ট্রাম্পের নিজের দল রিপাবলিকান পার্টির সমর্থক এবং ট্রাম্প দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত। পেনসিলভেনিয়া, মিশিগান, উইসকনসিন, জর্জিয়া, মিনেসোটা, নেভাদা এবং আরিজোনার বিচারকদের লোভ ও ভীতি প্রদর্শন করা হোল। তারা একাট্রা হয়ে ভুয়া মামলাগুলো প্রত্যখ্যান করলেন।
এমনকি কেন্দ্রীয় বিচারকরা মামলাগুলোর অন্তঃসারশূন্যতা বর্ণনা করে কঠিন ভাষায় নাকচ করেছেন। বরিশালের ফৌজদারি কোর্টে ছিঁচকে মামলা হতো। যেমন, মুরগী অথবা ছাগল চুরি। এইসব মামলায় কাউয়ার চরের ভূয়া স্বাক্ষী ধরে নিয়ে আসত। যুক্তরাষ্ট্রের এই মক্কেলহীন আইনজীবী ধরে নিয়ে এল ভুয়া স্বাক্ষীদের – ট্রাম্পের পক্ষে মিথ্যা এবং বানানো স্বাক্ষ্য দেবার জন্য। পুরো ব্য়্যাপারটা দাঁড়াল ভীষণ ভাঁড়ামি এবং কৌতুকময়। একদিন মিশিগানের মামলার সময় ঐ প্রতারক আইনজীবী এমনই ঘামাতে থাকলেন যে তার চুল রঙ করার ঘন বাদামী রঙ গলে গলে পড়তে লাগল। মনে হোল ওর শরীরের মধ্যে বসতকারী মিথ্যার পোকাগুলো পর্যন্ত বিদ্রোহ করেছে। ঘাম হয়ে সবগুলো একত্রে বেরিয়ে আসার চেষ্টায় রত। ভুয়া স্বাক্ষী এক সোনালী চুলের সাদা মহিলা মিথ্যা বলতে লাগল বিচারকের সামনে। পরের রাতে টেলিভিশনে কমেডিয়ানদের পোয়া বারো। প্রতারক আইনজীবী ও ভুয়া স্বাক্ষীকে অনুসরণ করে কমেডি শো করা হল। চারিদিকে অট্টহাসির জোয়ার এল। আইন পরিষদের সামনে প্রতিবেদনের সময় আইনজীবীর অমূলক মিথ্যা গলাবাজিতে আইনজীবীর নিজ দেহ যেন কৌতুকে ফেটে পড়লো। দু দুবার ধ্বণিত হোল আইনজীবীর পায়ুপথে বায়ু নির্গমনের বিকট শব্দ।
এর পর ট্রাম্প লেলিয়ে দিল টেক্সাসের আর এক প্রতারককে (গুজব অনুযায়ী)। এই লোক ঠেসে দিল আর এক মামলা। এবারে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সুপ্রিম কোর্টে। তার অলীক আবদার হল পেনসিলভেনিয়া, মিশিগান, উইসকনসিন ও জর্জিয়ার প্রায় দু কোটি নাগরিকের ভোট বাতিল করতে হবে। উল্লেখ্য, ও গুলোতে বিজয় হয়েছে বাইডেনের। মামা বাড়ীর আবদার বৈকি! সুপ্রিম কোর্ট সর্বসম্মতিক্রমে এই মামলাকে গ্রহণ করলো না – যেহেতু এটা এমনই এক মামলা যার কোন ভিত্তি নাই। সুপ্রিম কোর্টের ৯ জন বিচারকের মধ্যে ছিলেন ট্রাম্প এর নিয়োজিত গরসাস, কাভানাক এবং ব্যারেট। এরা সবাই রক্ষণশীল রিপাবলিকান দল পন্থী। ট্রাম্প আশা করেছিল তার দ্বারা নিয়োগ প্রাপ্ত তিন জন এবং আরও তিন রক্ষণশীল সর্বমোট ৬ জন তার পক্ষে অন্যায়ভাবে রায় প্রদান করবে। কয়েকমাস ধরে প্রকাশ্যে সে বলে আসছিল এটাই। কিন্তু তার আশায় গুড়ে বালি। নয়জন বিচারক তার মামলা নাকচে সই করলেন।
মানসিকভাবে রুগ্ন ট্রাম্প বুঝতে পারল না – বেআইনিভাবে জনগণের দেওয়া ভোট পাল্টাতে পারবে না। তবু তার অসৎ চেষ্টার শেষ নেই। সে এটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বারকে চাপ দিল। সে যেন এফবিআই ও অন্যান্য এজেন্সির সাহায্যে জনগণের ভোটকে নস্যাৎ করে ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট বানিয়ে দেয় ২য় টার্মে। উইলিয়াম বার ট্রাম্পের গৃহপালিত ভৃত্য হিসাবে পরিচিত। তাকে পর্যন্ত রাজী করানো গেল না। এতো বড় অন্যায় করলে তারও একদিন বিচার হতে পারে। তাই তিনি বললেন, নির্বাচনে এমন কোন ভুয়া ভোটের প্রমাণ পাওয়া যায়নি যার ভিত্তিতে ফলাফল (অর্থাৎ বাইডেন বিজয়ী) উল্টে দেওয়া যাবে না। ১৫ ডিসেম্বর তিনি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ২৩ ডিসেম্বর ছিল তার চাকরির শেষ দিন।
এতেও দমেননি উলঙ্গ সম্রাটের রূপক প্রতিকল্প ডোনাল্ড ট্রাম্প। একে একে খুলে যাচ্ছে তার জঘন্য মিথ্যাচারীতা ও প্রতারণার কাপড়গুলো। অচিরেই দেখা গেল তার সত্যিকার উলঙ্গ মূর্তি যার মধ্যে ঠেসে আছে মিথ্যাবাদিতা, প্রতারণা, চুরি, ছ্যাঁচড়ামি, নারী নির্যাতন আর বলাৎকার। ভুয়া প্রচারের রঙ্গিন পোশাকগুলো একে একে খসে পড়লো। সবাই দেখতে পেল এক কুৎসিত উলঙ্গ সম্রাট। তার উলঙ্গ দেহ নিয়ে এন্ডারসনের গল্পের সম্রাটের মতোই সে এখনো হাঁটছে একদল নব্য ফ্যাসিস্টদের প্যারেডের সামনে। নব্য ফ্যাসিস্ট জাতিবিদ্বেষী শ্বেতাঙ্গরা এতোই অকর্মা ও বোকা ওরা দেখতে পেল না সম্রাটের অপরাধ ঢাকার কোন কাপড় নেই – সে উলঙ্গ।
এই বধ্য পাগলামির এখন ও শেষ নেই। জানুয়ারির ৬ তারিখে কংগ্রেসে তার কিছু চামচা দিয়ে সে নির্বাচনের ফলাফল অন্যায়ভাবে উল্টাতে চেষ্টা করবে। ঐদিন কংগ্রেসে সরকারিভাবে নির্বাচন প্রতিনিধিদের ভোট গণনা করা হবে। ১৫ ডিসেম্বর সিনেটের নেতা রিপাবলিকান মিচ মেককনাল বাইডেনকে প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট হিসাবে অভিনন্দন জানিয়েছে। ট্রাম্পের শেষ কামড়ের সার্থকতার সম্ভাবনা একেবারেই শূন্যে।
লেখক: এমিরিটাস অধ্যাপক এবং সাবেক উপ-উপাচার্য-ইউনিভার্সিটি অব নিউ অরলিয়েন্স, ডীন এবং সাবেক উপাচার্য-ডেলগাডো কমিউনিটি কলেজ, কমিশনার-রিজিওনাল ট্রানজিট অথরিটি, বিজ্ঞানী, কবি)
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন