দিনের পাঁচালী (করোনাকালীন সাহিত্য)
ছুটির দিন, সকাল হতে না হতেই ডাকাডাকি – চল হাঁটতে যাই, ঘন্টা দশেক ঘুমিয়েছো আর কত, চল বাগানে কাজ করি ইত্যাদি । আমি আর আওয়াজ দিলাম না বলে, একাই বেড়িয়ে গেল । সামনে বরফ পরবে বেকার বাগানে কাজ করে লাভটা কি। মনে মনে ভাবছি কাজটা ঠিক হল না, গেলে ভালই হত। কতবার ভাবি এবার থেকে খুব ভাল হয়ে যাব, কারো মনোকষ্টের কারন হবো না কিন্তু মন কি কথা শোনে? তবে আমাদের বাচ্চাগুলো এখন বেশ কথা শোনে অনেক শান্ত হয়ে গেছে। করলা, সবজী, মাছ যা আগে কোনদিন খেত না এখন বেশ খেয়ে নেয় । একসাথে খাবার টেবিলে বসে খাওয়ার আগে বেশ কঠিন ছিল, এখন তা নয়। আর একটা জিনিস বেশ সহজ হয়েছে, ফোনে ফ্যমিলি ডাক্তরের সাথে কথা বলে বেশ ভাল চিকিৎসা পাওয়া যায় সহজেই। অসুধের প্রেসক্রিপশন ফ্যাক্সে চলে যায় ফারমেসীতে, তারা বাড়ীতে এসে অসুধ দিয়ে যায়। কি দারুন, আগে ডাক্তার দেখানোর জন্য কাজ থেকে ছুটি নিতে হত, দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হত, এখন বেশ সময়টা বাঁচে।
আজ বেশ ঝকঝকে রদ্দুরময় দিন, আমাদের পাশের নেইবার তারা স্বামী স্ত্রী দুজন বাইকিং করতে বেড়িয়ে গেল। আমি শুয়ে শুয়ে ভাবছি এবার ছন্দাদির জন্মদিনটা শুকনো মুখে ভারচুয়াল আড্ডা দিয়েই সিলিব্রেট করতে হল। সে যাই হোক, শুনেছি কানাডা ডে ও এবার ভারচুয়ালি সেলিব্রট হবে, হয়তো দুর্গা পুজোও এবার ভারচুয়ালি হবে। তাতে কোন আসুবিধা নেই তবে আগে সোমা, সুনন্দা বা পপি যে কারো জন্মদিন হলেই আমরা জেরার্ড এর উদিপী কিংবা মতিমহলে আড্ডা দিতে যেতাম, তারপর সবাই মিলে হৈ চৈ করে মসলা চা, গরম গরম পুরী- সিংগারা কিংবা নিরামিষ থালি বা আমিস থালি খেতাম। আমি ওদের ড্রাইভার – গাড়ি চালিয়ে ওদের নিয়ে যেতাম তাই আমাকে খাওয়ার পয়সা দিতে হত না। অন্যের পয়সায় ফ্রী রেস্টুরেন্ট এ খাওয়ার মজাই আলাদা। আর জেরার্ড গেলেই কেমন যেন স্বদেশী বাজারের মত ঘ্রাণ পাওয়া যায় তাই বেশ ভাল লাগে।
সোমবারে কাজে গেলে সবার প্রথম কথাই – হাউ ওয়াজ ইয়োর উইকয়েন্ড? প্যাটি বলল, আই হ্যাড বেষ্ট ওয়েডিং পার্টি । বললাম – হাউ কাম ? বলল virtual wedding মানে কোন driving, parking, drinking কিংবা gift এর ঝামেলা নেই। আসলে ব্যাপারটা মন্দ না। এর আগে আমাদের কমিউনিটির প্রতিটি বিয়েতেই দেখতাম অনেক গুলো করে অনুষ্ঠান হত। কে কটায় নিমন্তন্ন পেল, কে সকালে কে বিকেলে এসব হিসেব করে মন খারাপ করতো। এখন আর কারো কোন আফসোস থাকবে না – ঈশ আমাকে শুধু বিয়েতে বলল, রিসেপসনে বলল না ইত্যাদি। আমারও ছেলের বিয়ে দিতে হবে তাই ভাবছি শুধু যেটুকু নিয়ম কাজ তা হলেই হল বেকার পয়সা অপচয় থেকে বাঁচা গেল। আজকাল পুরোনো কথা বেশ মনে পরে।
পাড়ার এক ছোকড়া একখানা প্রেমপত্র দিয়েছিল – পড়ে দেখি তার ৮ লাইন চিঠির প্রায় সবকটি লাইনই অন্যের লেখা থেকে ধার করা – রবি ঠাকুর, নজরুল ইত্যাদি । বললাম বাপু দুলাইন বাংলা লিখতে পারো না আবার নকল করা প্রেমের চিঠি । আমার অংকের টিউটর র একদিন আমার অংক বইয়ের মধ্যে একখানা চিঠি রেখে গিয়েছিল – মাকে দেখাতেই পরদিন থেকে বেচারার টিউশানিটা চলে গেল । কলেজের এক সহপাঠী আমার একখানা ছবি একে আমায় দিয়েছিল, রেগে সে ছবি ছিড়ে ওর দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিলাম বলেছিলাম নৌকা বানিয়ে জলে ভাসিয়ে দাও। এখন ভাবি এসব অন্যায় কেন করেছিলাম? কি দরকার ছিল ওর শিল্পকর্ম টা নষ্ট করার কিংবা কারো রুটিরুজি নষ্ট করার। সময়ের সাথে সাথে জীবনবোধ, ভাবনা গুলো কত বদলে যায়। এক জীবনের জন্য কত আয়োজন আমাদের ।
লিভিংরুমে টিভিতে আমার বর মনদিয়ে দেখছে – কুচ কুচ হোতা হ্যায় ; আর আমি Routing and Switching বেশ একটা কঠিন online test শেষ করে দরজায় উকি দিয়ে তাকে বললাম A পেয়েছি, সাথে সাথে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বলল “ চারদিকে মৃত্যুপুরী আর তুমি আছো তোমার A নিয়ে- তুমি কোন মানুষের মধ্যেই পরো না “। তাকে আর কিছু বললাম না। আমার বাবার মৃত্যুতিথি গেল কদিন আগে, মন খুব চাইছিল মন্দিরে ঠাকুরের সামনে গিয়ে নির্জনে প্রার্থনা করি-অগত্যা তারও অনুমতি মিলল না। সে বলল তুমি এ কঠিন সময়ে নিয়ম ভেংগে unethical কাজ কিছুতেই করতে পারো না, চুপ করে ঘরে বসে ঠাকুর কে স্মরণ কর। তাইতো ঈশ্বরই একমাত্র আশ্রয়। উপরে যিনি আছেন- মূহুর্তে সব বদলে দিতে পারেন। ভাবছি, মরার পর ভগবান যদি বলে পরের জনমে কি হয়ে জন্মাতে চাও ? আমি বলবো পাখি হতে চাই । জীবনানন্দের মত হয়তো হাঁস হতে চাইবো না, ময়ুর হলে মন্দ না তবে আমার ভ্রমনের খুব শখ তাই বলবো কোন উন্নত সাইবেরিয়ান পাখিদের মত কিছু একটা বানাতে যাতে অনায়াসে পাসপোর্ট ভিসা ছাড়াই ডানায় ভর করে একদেশ থেকে অন্যদেশে যেতে পারি। কি জানি ডাইনোসরের মত আমাদের মত মানুষের কংকাল হয়তো অচিরেই মিউজিয়ামে পরে থাকবে, পৃথিবীতে হয়তো নতুন কোন রকমের মুনুষ্য প্রজাতি টিকে থাকবে। ছেলেরা দেখছে sports channel- বড় ছেলেটা দুরে, বাকী দুজনের মুখের দিকে তাকাই, মাঝে মধ্যে অভিককে জিজ্ঞাসা করি আমাদের যদি হাসপাতালে যেতে হয় – তোরা দুভাই মিলেমিশে ভালভাবে থাকতে পারবি তো? লেখাপড়া কিন্তু বন্ধ করিস না কিন্তু। ও আমারে জড়িয়ে ধরে আর আমি বলি – না Social distance minimum 6 feet. ওরা বলে মা তুমি না …
নিমন্ত্রণ, গানের জলসা, আড্ডা বিহীন ধুসর weekend আরও কতকাল চলবে কে জানে। ঈশ দিপীকার বাড়ী খেয়েছিলাম কাঁচা আম দিয়ে টংরা মাছের ঝোল – অর্চনাদির সরষে ইলিশ, সোমার ছোট মাছের চচ্চরি, শিউলী দির রুইমাছের কালিয়া, পপির হাতের পালং শাক, সুরমিলার গুরের পায়েশ, শিলাদির বানানো রসোগোল্লার স্বাদ জিবে লেগে আছে- কদিনে এসব যেন ইতিহাস হয়ে গেছে। ছন্দা আর কবিতা দিদি বলেছিল তারা পিঠা উৎসবে যে প্রাইজের টাকা পেয়েছিল তা দিয়ে একদিন বিষ্ণুপ্রিয়ারা সবাইমিলে বসে সেলিব্রেট করবে এর মাঝে পৃথিবীতে এত মৃত্যু মিছিল । জানিনা সে আশা পুর্ন আর এ জীবনে হবে কিনা।
আমার সাথে যে মেয়েটা কাজ করে- শেলীকে দেখতাম সবকিছু কেনে ক্যলোরী দেখে আর weight watcher website আনুযায়ী খায় ।ওর নিজের Excel Sheet এ লিখে রাখে কি কি খাবে। আমার ভাত তরকারী খাওয়া দেখে বলে – Shubhra you are eating too much. পাগোল- আমি কি আর ওর কথা শুনি। শুনেছি মরার পর অতৃপ্ত আত্মা চারদিকে ঘোরাফেরা করে। আগে হাঁটতে হাঁটতে অফিসের পাশের Sobies থেকে আইসক্রিম, ফ্রোজেন ইয়োগারড কিনতাম। দুপুরে lunch এর পর একটু ডেজারড খেতে বেশ লাগে। আমার কলিগ শেলীকে খেতে বললে বলে- সে promise করেছে একমাস কোন desert খাবে না। অফিসে Lunch পর একটু করে হাঁটতে যেতাম এখন তাও এখন বন্ধ। জানিনা কতদিন এভাবে চলবে। মরার আগে হয়তো কোন ইচ্ছে পুরোনের সুযোগ মিলবে না।
বরের ইদানীং রান্নাবান্নায় খুব মনোযোগ, দুদিন আগে সীম, বেগুন, আলু দিয়ে রুই মাছের ঝোল করেছিল। খেতে গিয়ে কেমন যেন অন্য রকম একটা লাগলো, গলা দিয়ে ঠিক নামতে চাইছিল না; তারপরও বললাম খুব ভাল হয়েছে। কি হয় কি জানি, কদিন আর আছি এ অবাক পৃথিবীতে; বেকার ঝগরাঝাটি করে সময় নস্ট করে কি লাভ। প্রতিদিন মনকে প্রশ্ন করি কি খেতে ইচ্ছা করে যেন ফাঁসির আসামীর মত। মন থেকে উত্তর পাই নানা কিছু যেমন : মুক্তাগাছার মন্ডা, রাজশাহীর ল্যংরা/ ফজলী আম, মটরের ডাল বেটে বড়া করে আলু দিয়ে ঝোল ইত্যাদি । এখন আর কোন ডায়েটিং নেই। দুধ চিনি দিয়ে ঘন করে চা বানিয়ে তাতে পরোটা ডুবিয়ে ডুবিয়ে ব্রেকফাস্ট করি, বেশ লাগে।
অভিকের বাবার কাজ বাড়ী থেকে, দরজা বন্ধ করে কনফারেন্স কলে, ছেলেরা উকি দিলেই বলে কনফিডেনশিয়াল/ প্রাইভেসী ইত্যাদি। IT virtualization এর উপর গোটা বিশ্ব চলছে এখন। zoom, Microsoft team , lockdown browser এসব দিয়ে আমার লেখাপড়া পরীক্ষা দিব্যি চলছে। কত কষ্ট করে subnetting, IPv6 মাথায় ঢুকাচ্ছি পরীক্ষা পাশের জন্য কিন্তু বেঁচে না থাকলে এর কি বা দাম আছে?
আমার ছেলেদের বা কি দোষ ঘরে বসে বসে কি আর করা। অভিক কতক্ষন বাদে বাদে ক্রেডিট কার্ড চায় অনলাইন গেইম কেনার জন্য, বারন করি না- ভাবি যার যা ইচ্ছা করুক । পয়সা দিয়ে কি আর হবে যদি বেঁচেই না থাকি। ওরা বাটার চিকেন, নান আর কি সব খাবার অর্ডার করে আর ওদের বাবা রেগে যায়- এ সময়ে বাইরের খাবার বন্ধ। জানিনা মানুষ কি দোষ করলো, পশু পাখির তো এসব রোগ শোক হচ্ছে না, ওরা তো দিব্যি আছে। জানিনা মরার পরে কি বাবা মায়ের সাথে দেখা হবে? মৃত্যুর ওপারে কি ওরা আছে? আজকাল প্রায়ই মাকে স্বপ্ন দেখি।
ছেলেরা তো বোঝে না কোনটা সোনার গহনা আর কোনটা নকল গহনা, আর এতে ওদের কোন আগ্রহ বা শোনার সময় নাই। বিয়ের সময় মা কত কষ্ট করে এই গয়না দিয়েছিল যা লকারে রেখেছি ছেলে বৌদের দেব বলে কিন্তু ওদের বিয়ে দিয়ে যেতে পারবো কিনা কে জানে। ভয়ে টিভির সামনেই যাই না, এসব খবর আর নিতে পারছি না তবে আমার বরের কাছে দুনিয়ার রাজ্যের খবর ।
এখনো কাজে যাচ্ছি, আমর বস Director, Finance লেডি সকালে কাজে এসেই গরম জলের ক্যটেল চালিয়ে দিয়ে বলে, শুভ্রা মেক সিওর হোল ডে ড্রিংক হট ওয়াটার, লিমন ।খুব হিউম্যনিটি তার মাঝে ভীষন আন্তরিক তবে কাজে করমে সে বেশ কড়া কিন্তু মানুষ হিসেবে অতুলনীয়। আমাদের CEO দিনে একবার অফিস প্রদক্ষিন করে সবার খোঁজ নেয়, জিজ্ঞাসা করে Are you in good health? How is your family ইত্যাদি। ঠাকুরের অশেষ কৃপায় আপাতত ঠিক আছি, কি হবে তা কে জানে? সুবিধার মধ্যে অফিস যেতে এখন রাস্তায় কোন ট্রাফিক জাম নেই ।
বড় ছেলে অনিক তার প্রচন্ড কাজের চাপ তারপরও সুদুর থেকে ফোন করে খোঁজ খবর নেয়। আমি খালি বলি তুই জানিস তো বাবা আমার কোথায় কি আছে, যদি আর দেখা না হয়। অনেক কৃপনতা করে কিছু টাকা জামিয়ে মিউচুয়াল ফান্ডে রেখেছিলাম – প্রতিদিন দেখি তার value কমছে।Hoope পেনশনে যে সমান্য টাকা জমা আছে তা তোলার ব্যবস্থা করছি, ৬৫ বছর অব্দি বাঁচতে পারবো কিনা তা কে জানে? উইল এর কপি ছেলেদের বুঝেয়ে দেবার কথা বললে ওরা হাসে বলে আমি পাগল। আমি জানি এদেশে নানান জটিলতা আছে নাকি, তাই আগে থেকেই মেক সিওর করা যাতে সামান্য যা কিছু আছে এসব নিয়ে ছেলেদের যেন কোন সমস্যা না হয় ।
রাতের বেলা মাঝে মধ্যেই messenger এ ফোন বেজে ওঠে, দুর দুরন্তের বিভিন্ন দেশের প্রান্ত থেকে সকলেই খোঁজ খবর নেয়, যারা হয়তো খুব একটা ফোন করেনি কখনো। সীমু ভালো আছিস তো? কাছের বন্ধুরা যেমন, সোমা, পপি, চন্দ্রিমা বৌদি, শ্রাবনী দি, ছন্দা দি, কবিতা দি, শিলা দি সবাই ফোন করে কুশল জানতে চায় । অজয় চক্রবর্তী বললেন – আজ মানুষ গৃহবন্দী আর পশুপাখিরা মুক্ত। আসলেই সব পারি বলে আমাদের কেমন যেন খুব অহংকার হয়েছিল তাই হয়তো এই পরিনতি- মৃত্যুকে আলিঙ্গনের অপেক্ষায় দিন গুনতে হচ্ছে। যত অন্ধকারই আসুক না কেন আমাদের ভালোবাসার শৃংখল থেকে আমারা যেন বিচ্যুত না হই । মৃত্যু এখন সংখ্যা গননার ধারাপাত, কার দরজায় কখন যে কড়া নাড়ে সে ভয়ে আমরা এখন আতংকিত। আমরা কেউ জানিনা এ অনিশ্চিতের অবসান কবে হবে। মন্দ না এখন শুধু দিনের ভাবনাতেই জীবন সীমিত কারন পরদিন সকাল আমার জন্য কি হবে তা কে জানে? পাখি কখন খাচা ছেড়ে পালাবে কে জানে ? চিরদিন পুষলাম এক অচিন পাখি – সত্যিই তো নিজেকেই চিনলাম না। এক বন্ধু লিখেছে, বালাই ষাট । সকলেই শতবর্ষী হোক । হয়তো এমন বিপর্যয় আরো আসবে পৃথিবীতে কালো প্রদীপ জালিয়ে। তবুও মানুষ জয় করবে , আবার ব্যাথা ডুবে যাবে জীবনের গানে। এরই মাঝে আমরা খুঁজে যাবো জীবনের মানে। পারস্পরিক ক্ষমাই শুধু পড়ে আছে অচল সাকো হয়ে, আমাদের মাঝে। তাই বিদায় নেবার সুযোগ যদি না পাই, ক্ষমা করে দিও নিজ গুনে যদি অজান্তেই কাউকে কখনো আঘাত বা কষ্ট দিয়ে থাকি ।বুদ্ধ বলেছিলেন “মানুষ মরে গেলে তবুও মানব রয়ে যায়”। হয়তো বা সব শেষ হয়ে যাবে, তবুও আমাদের ভালবাসাটুকু শুধু রয়ে যাবে। সকলের জন্য অন্তহীন ভালবাসা।
-শুভ্রা শিউলী সাহা, লেখক