পথের মানুষ ।। নৈশব্দের পংক্তিমালা ।। ধারাবাহিক ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
I am hungry, please help me, please help me. Wheel chair এ শশ্রুমন্ডিত এক বৃদ্ধ। তীব্র কনকনে শীত আর তুষারে ওর জ্যাকেটটা ভিজে একাকার। হাতে একটা টিম হরটনের শূন্য কাপ। আমি অদূরে বাসের জন্য লম্বা লাইনে দাড়িয়ে। টরেন্টোর ব্যস্ত জনপদ ধরে ছুটে চলেছে অফিস ফেরতা এক বিশাল জনস্রোত, কেউ ট্রেন ধরবে, কেউবা বাস। বৃদ্ধের আকুতি কারোকে বিচলিত করেনা। আমি অনিমেষ চোখে তাকিয়ে থাকি। মনে মনে ভাবি, ও কোথা থেকে এসেছে, কোথায় ওর পরিবার? কেন ও ঘর ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে রাস্তায় ! আশাহীন ভরসাহীন ওর চেহারার দিকে তাকিয়ে আমি আস্তে আস্তে নিঃসঙ্গ হয়ে যাই, এক রাশ দুঃখবোধ কোথা থেকে উঠে আসে বুদবুদের মতো। মনে হয় – এই যে আমি বাসের প্রত্যাশায় দাড়িয়ে আছি ঘরে ফিরবো বলে, ঘরে আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে আমার সন্তান, আমার প্রিয়তমা স্ত্রী। যদি কোন দিন এ অপেক্ষায় আসে ক্ষণিক বিরতি, যদি কোনদিন ঘরে ফেরার আগ্রহ ফেলি হারিয়ে ! আমি মুহূর্তে অস্তিত্ব-বিহীন হয়ে পরি, মিশে যাই ওর সাথে। শূন্য কাপ হাতে দাঁড়িয়ে থাকি উদ্দেশ্যহীন ভাবে।
ওর জন্য কেন যেন আমার মন কাঁদে। অফিস থেকে ফেরার পথে আমার চোখ ওকে খুঁজে বেড়ায়। একদিন এক ব্যস্ততম দিনে দৌড়ে বাস ধরতে যেয়ে আমি আমার অফিসের badge টা হারিয়ে ফেলেছিলেম। ও পরের দিন অপেক্ষায় ছিলো আমায় badge টি ফিরিয়ে দেবার জন্যে। সেদিন আমি কৃতজ্ঞতার চিহ্ন হিসেবে একটা লুনি ওর কাপে রেখেছিলেম। ও মুখে এক গভীর আনন্দের চিহ্ন একে আমায় বলেছিল god bless you. সেদিন আমি আমায় নতুন করে আবিষ্কার করি। একটা ডলার দান করে আমি এক অপার সুখানন্দে ভেসে যাই। কিন্তু সে আনন্দ বেশী ক্ষণ স্থায়ী হয় না। দুরন্ত বাসে অনাবিল প্রকৃতির মাঝে চেয়ে থাকতে থাকতে মনে প্রশ্ন আসে আমি এতো কৃপণ কেন? আমার তো দশটি টাকা দেবার ক্ষমতা আছে! অথচ হাতে একটা লুনির বেশী উঠলো না ! মনটা এক মুহূর্তে খারাপ হয়ে যায়। বুঝতে পারি এ আমার মনের দৈন্যতা, এ তো একদিনে দূর হবার নয়। কানাডায় এসে নেপালের ভুমিকম্প কবলিত ছিন্নমূল মানুষের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছি, দেশের বন্যা কবলিত দুর্দশাগ্রস্ত মানবতার প্রতি, হাইতি, সিরিয়ার বিপন্ন মানুষের পাশে দাড়াতে চেষ্টা করেছি। অফিসের টি শার্ট পড়ে united way এর জন্য অনেক বার সাহায্য তুলেছি কিন্তু মনের দৈন্যতা এতটুকু ঘোচেনি। মনের মধ্যে সবসময় সংশয় টাকাগুলো সঠিক জায়গায় পৌছবে কিনা। এইযে পথের ধারে বড় বড় drop box. খেলনা, পোশাক ফেলে দিয়ে আসি, তা কি আসলেই অভাবী মানুষের উপকারে আসে? না কি ওরা ব্যবসা করে! united way এর ceo এর বেতন যদি ছয় অংকের হয় তবে কি দরকার দান করে? এমনি হাজারো প্রশ্ন আমায় দানের মহিমায় কখনো উজ্জীবিত করেনি। যৎসামান্য যা দান করেছি তা থেকে যেন tax সুবিধা পাই, বৎসরান্তে tax file করতে যেয়ে সেসব কথা পোই পোই করে মনে রেখেছি।
এমনি করে ছিদ্রান্বেষণ করতে যেয়ে নিজকে অনেকটা ছিদ্র করে ফেলেছি। অভাবগ্রস্ত মানুষের মুখে আমার এ যৎসামান্য দান যে কি অভাবনীয় সুখ ছড়িয়ে দিতে এতো দিন কেন ভাবিনি! কেন মনে হয়নি জাগতিক সুখ ও ভোগের উষ্ণতা ছেড়ে রাস্তার ধারে মলিন লেপ গায় দিয়ে এ কনকনে শীতের মাঝে যে শুয়ে আছে তারও ছিল কোন এক অতীত। অপ্রতিরোধ্য নেশার দংশনে অথবা কোন অসহনীয় দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণায় হয়তো ও ঘরকে পর করে পথকে করেছে আপন। আমার একটি টাকা, একটা সিকি আধুলিতে যদি ওর একটু উপকার হয় হোক না। ও যদি আমার পয়সায় নেশা করে করুক না। এ ক্ষুদ্র দানে আ্রমার judgmental হবার কোন অধিকার নেই।
আজ আমি পকেটে খুচরো পয়সা জমিয়ে রাখি। রাস্তা দিয়ে ওদের অবজ্ঞা করে স্যুট টাই পরা অভিজাত মানুষগুলোকে দেখিয়ে দেখিয়ে আমি ওদের শূন্য কাপে, উল্টানো টুপির ভেতর রেখে দেই দশ পয়সা পাঁচ পয়সা। ঐ শশ্রুমন্ডিত বৃদ্ধের জন্য দশটি ডলার আলাদা করে রেখেছি। এখনো দিতে পারিনি। মনে মনে ভাবি আস্তে আস্তে অভ্যাসটা গড়ে উঠুক। হয়তো একদিন নিরুদ্বিগ্নে টাকাটা বেড় করে দিয়ে দূর থেকে দেখে নেব ওর মুখের হাসি। বাতাসে ভেসে বেড়াবে ওর অকৃত্রিম আশিস – God bless you.
পথের মানুষ ।। নৈশব্দের পংক্তিমালা ।। ধারাবাহিক ।। সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী । ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স, মাস্টার্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান