পয়লা বৈশাখের নেপথ্য কাহিনি ।। সিদ্ধার্থ সিংহ
পয়লা বৈশাখ নিয়ে এখন যতই মাতামাতি হোক, পুজো দেওয়ার জন্য ভোররাত থেকে যতই ভিড় উপচে পড়ুক কালীঘাট-দক্ষিণেশ্বরে, মহাধুমধাম করে যতই হোক হালখাতা, বাড়িতে-বাড়িতে যতই রান্না হোক ভালমন্দ, বড় বড় ফুটবল ক্লাবগুলো যতই মেতে উঠুক বার পুজোয়, সাজ সাজ রব পড়ুক বইপাড়ায়, সোনার দোকানিরা যতই মজুরিতে ছাড় দিক ৫০%-৬০%, গ্রহরত্নের ওপর ১০%-২০%, সকাল থেকে যতই মেতে উঠুক বাঙালিরা— এই পয়লা বৈশাখের রমরমা কিন্তু খুব বেশি দিনের নয়।
হিসেব অনুযায়ী বাংলা অব্দ হাজার দেড়ের বছরের পুরনো হলেও এটা কিন্তু উৎসবের রূপ নিয়েছে এ দেশে ইংরেজ আসার পর থেকে। পলাশি যুদ্ধের পরে ইংরেজদের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র হয়ে ওঠে কলকাতা। তখন জীবিকার সন্ধানে গ্রামগঞ্জ থেকে দলে দলে লোকেরা আসতে থাকেন এই শহরে। গড়ে উঠতে থাকে দোকান-পাট, ব্যবসা-বাণিজ্য। বাঙালিরাও উঠেপড়ে লাগলেন। তাঁরাও হয়ে উঠলেন পাক্কা ব্যবসায়ী। কেউ কেউ আরও এক ধাপ এগিয়ে, ইংরেজদের বদান্যতায় হয়ে উঠলেন জমিদার।
এই সময় বাঙালিবাবুরা তাঁদের ‘প্রভু’ ইংরেজদের ইংরেজি বছরের শেষ দিন, ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যরাত থেকে হই-হল্লোড় করে ‘নিউ ইয়ার’ পালন করতে দেখে, উৎসাহিত হন। এবং তাঁদের অনুকরণ করেই বাংলা বছরের প্রথম দিনটিতে নাচ-গানের মজলিস বসাতে শুরু করেন।
ওই সব আসরে আসতেন বাগবাজার, শোভাবাজার, পাথুরিয়াঘাট, জোড়াসাঁকো, চোরবাগান থেকে ফুলবাবুরা। চুনট করা ধুতি, আদ্দির পাঞ্জাবি আর সারা গায়ে আতর মেখে। ঘোরায় টানা টমটমে চরে।
রাজসিক খাওয়াদাওয়ার সঙ্গে চলত কালোয়াতি গান, কোথাও কোথাও হত বাঈজির নাচ। সেই সব বাঈজিদের আনা হত শুধু বাংলা নয়, বাংলার বাইরে থেকেও। কে কোন নামজাদা খানদানি বাঈজিকে আনতে পারেন, সেই নিয়েও চলত রেষারেষি।
কেউ কেউ বলেন, সে যুগের বিখ্যাত সংবাদপত্র ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর সম্পাদক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তই নাকি ছিলেন এই নববর্ষের মোচ্ছবের মূল হোতা। তিনি নাকি বাংলা নতুন বৎসর উপলক্ষ্যে সংবাদ প্রভাকরের আলাদা একটা বিশেষ সংখ্যাও প্রকাশ করতেন।
যদিও বাংলা সন বা অব্দ, যাকে বলে— বঙ্গাব্দ, সেটা যে কে প্রথম চালু করেছিলেন এবং কবে থেকে তা বলবৎ হয়েছিল, তা নিয়ে বিস্তর মতভেদ আছে।
সাধারণত কোনও রাজা বা সম্রাটের রাজ্যাভিষেকের দিন, কিংবা তাঁর কোনও বড়সড় জয়ের কীর্তি, অথবা কোনও ধর্মীয় নেতার জন্মগ্রহণ, নয়তো তেমন উল্লেখযোগ্য কোনও ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে অব্দের প্রচলন হয়। যেমন যিশুখ্রিস্টের জন্মকে কেন্দ্র করে গণনা করা হয় খ্রিস্টাব্দ, বা হজরত মহম্মদের মক্কা থেকে মদিনা যাত্রার সময় অর্থাৎ ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুলাই থেকে গণনা করা হয়— হিজরি অব্দ।
এই ভাবেই এক সময় এই দেশে রমরম করে চালু হয়েছিল বুদ্ধ নির্বাণ— বুদ্ধাব্দ, মহাবির নির্বাণ— মহাবীরাব্দ, ভাস্করাব্দ, শকাব্দ, শঙ্করাব্দ, চৈতন্যাব্দ, কলাব্দ, বার্হস্পত্যবর্ষ, বিক্রম সংবৎ-এর মতো বহু অব্দ। যদিও চালু হলেও তেমন ভাবে ব্যবহার না হওয়ায় কালের নিয়মে তা ধীরে ধীরে ব্রাত্য হয়ে গেছে। এগুলোর মধ্যে একমাত্র টিকে আছে— শকাব্দ। ভারতের জাতীয় বর্ষপঞ্জি বলেই হয়তো!
কারও কারও মতে, সপ্তম শতাব্দীর বাংলার প্রথম দিকের রাজা শশাঙ্কই নাকি প্রচলন করেছিলেন বঙ্গাব্দের। যদিও এর স্বপক্ষে তেমন কোনও জোরালো ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায় না। আর তিনি যদি প্রচলন করেও থাকেন, তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু সেই বর্ষ গণনাও অস্তমিত হয়ে গিয়েছিল।
ইতিহাস ঘেঁটে যে তথ্য পাওয়া যায়, সেটা হল— সম্রাট আকবর তাঁর জ্যোতির্বিদ ফতুল্লাহ সিরাজিকে একদিন আদেশ দিয়েছিলেন, ইসলামিক চন্দ্র ক্যালেন্ডার আর হিন্দু সৌর ক্যালেন্ডার— এ দুটিকে মিলিয়ে মিশিয়ে নতুন একটি ক্যালেন্ডার তৈরি করার জন্য। কারণ, তখন হিন্দু আর মুসলিম ক্যালেন্ডারের মধ্যে বারো দিনের একটা ফারাক ছিল। সে জন্য বাঙালিদের কাছ থেকে কর সংগ্রহ করতে নানা সমস্যা হত। এর ফলে, ওই দুটো ক্যালেন্ডারকে মিশিয়ে ফতুল্লাহ সিরাজি যে নতুন বাংলা ক্যালেন্ডার তৈরি করলেন, তার নাম রাখা হল— ফসল-ঈ-শান। অর্থাৎ, ভাল ফসলের বৎসর। প্রথমে ওই নামে সনটিকে অভিহিত করা হলেও পরে তা আস্তে আস্তে ‘বঙ্গাব্দ’ নামেই পরিচিত হয়। সুতরাং ধরেই নেওয়া যায়, যে যা-ই বলুক না কেন, আসলে সম্রাট আকবরের সময় থেকেই বাংলা সনের প্রবর্তন হয়েছিল।
তবে এই বাংলা নববর্ষের সব থেকে বড় প্রাপ্তি হল— বাংলা বর্ষপঞ্জি। মানে পঞ্জিকা। অন্যান্য প্রচলিত অব্দগুলোর মতো বঙ্গাব্দেও বারোটি মাস আছে। কিন্তু দিনের সংখ্যাগুলো ইংরেজি ক্যালেন্ডারের মতো নির্দিষ্ট নয়। কারণ, তিথি নক্ষত্রের সময় অনুসারে বাংলার বিভিন্ন মাসের দিনের সংখ্যা বদলে বদলে যায়। কোনও মাসের দিনের সংখ্যা কখনও ২৯, কখনও ৩০, কখনও আবার ৩১। কখনও কখনও সেটা বেড়ে ৩২-ও হয়ে যায়।
আসলে বিভিন্ন মতের এই পঞ্জিকাগুলোর রূপকার ছিলেন প্রাচীন ভারতবর্ষের জ্যোতিষীরা। তাঁরা মূলত চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান, দিন-রাতের চুলচেরা হিসেব কষে বিভিন্ন রকমের তথ্যের ওপর নির্ভর করে নানা রকম সিদ্ধান্ত লিখে রাখতেন। আর তার ওপরেই ভিত্তি করে তৈরি হত পঞ্জিকা।
কবে থেকে বাংলায় পঞ্জিকা শুরু হয়েছিল বহু চেষ্টা করেও তার হদিশ পাওয়া যায়নি। তবে এটুকু জানা যায়, অনেক অনেক বছর আগে হাতে লেখা পঞ্জিকার চল ছিল। কোনও কোনও গবেষকের মতে, সব থেকে প্রাচীন বেদাঙ্গ জ্যোতিষ পঞ্জিকা নাকি সংকলিত হয়েছিল ১৮৫০ খ্রিস্টপূর্বে। পরে হাতে লেখা পঞ্জিকা শুরু হলেও সেটা ব্যবহার করার অধিকার এবং সামর্থ— কোনওটাই সাধারণ লোকের ছিল না। ধরা-ছোঁয়া তো দূরের কথা, চোখের দেখা, দেখারও অধিকার ছিল না নিম্নবর্ণের। একমাত্র রাজা, মহারাজা, জমিদার বা ওই রকম অভিজাত শ্রেণি কিংবা ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতেরাই কেবল ব্যবহার করতে পারতেন সেই পঞ্জিকা।
এই পঞ্জিকা অনুসারেই সমস্ত ব্যবসায়ীরা বাংলা বছরের প্রথম দিনটিকে শুভদিন মনে করে আগের বছরের যাবতীয় হিসেব-নিকেশ বছরের শেষ দিনটিতেই চুকিয়ে দিতেন। এবং বছরের প্রথম দিন থেকে নতুন করে লেখা শুরু করতেন খাতা। যাকে বলা হয়— হালখাতা। রাত থাকতে দীর্ঘ লাইন দিয়ে কালীঘাট-দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে সেই খাতা নিয়ে ভক্তিভরে পুজো দিতেন।
এখন অবশ্য চিরাচরিত ঐতিয্যবাহী লাল শালু কাপড়ে মোড়া খাতা আর কতটা নজরে পড়ে না। তার জায়গায় অনেকে ল্যাপটপ নিয়েও পুজো সাড়েন। নিমন্ত্রিতরা এলেই তাঁদের হাতে তুলে দেন ডাবের জল, লস্যি কিংবা ঠান্ডা পানীয়। আর তুলে দেন মিষ্টির প্যাকেট এবং সেই সঙ্গে অবশ্যই সব চেয়ে লোভনীয়, পঞ্জিকার মিনিয়েচার— বাংলা ক্যালেন্ডার।