প্রবাসের সংবাদ

প্রবাসীদের ‘নয়ন ভাই’

প্রবাসীদের ‘নয়ন ভাই’

আল-আমিন নয়ন। যিনি প্রবাসীদের কাছে ‘নয়ন ভাই’ নামেই পরিচিত। প্রবাসীদের কল্যাণে, বিপদে-আপদে তাদের আস্থার নাম ‘নয়ন ভাই’। রাত নেই, দিন নেই, ঢাকার হযরত শাহ্‌জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেই ক্ষতিগ্রস্ত ও নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফেরা নারী ও পুরুষরা পাশে পান নয়নকে। বিদেশে বিপদে পড়া বেশির ভাগ প্রবাসীর বিশেষ করে নারী প্রবাসীদের সঙ্গে নয়নের আগেই কথা হয় ফোনে। তাই বিমানবন্দরে নেমে নয়নের দেখা পেয়ে তাদের কাছে আর অপরিচিত মনে হয় না। নয়নও আপা, বুবু, খালা যাকে যা ডাকলে মানানসই হয়, সেভাবে সম্বোধন করেন। বৈশ্বিক মহামারি করোনায় এই সংকটকালে দেশে ফেরা প্রবাসীদের খাবার, চিকিৎসা, পরিবহন সহায়তা, পরিবারের কাছে পৌঁছে দেয়াসহ যেকোনো সমস্যায় কাজ করছেন তিনি।

অবস্থা এখন এমন- বিমানবন্দরে মানসিক অসুস্থ বা ঠিকানাহীন কোনো কর্মী দেখলেই প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক বা বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ফোন দেয় নয়নকে। আর এ কারণেই ইউএনডিপি তাকে এ বছর ‘পরিবর্তনের রূপকার’- হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক তাকে মানবিক মানুষ হিসেবে ধন্যবাদপত্র দিয়েছে।
নয়ন বলেন, প্রবাসীরা হলেন মোমবাতির মতো। মোমবাতি যতক্ষণ আলো দেয়, ততক্ষণ তার আলোয় সকলে আলোকিত হয়। কিন্তু নিভে গেলেই শেষ। তেমনই প্রবাসীরাও ক্ষতিগ্রস্ত ও নির্যাতনের শিকার হয়ে ফিরলে আপনজনও আর তাদের চিনতে চান না। তাই বিবেকের তাড়নায় মানবিক বিবেচনায় তিনি তাদের পাশে দাঁড়ান।
নয়ন এখন কাজ করছেন ব্র্যাক’র মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের ইনফরমেশন সার্ভিস সেন্টারে ম্যানেজার পদে। এ পর্যন্ত তিনি ব্র্যাক’র হয়ে বিমানবন্দরে ১৭ হাজারের অধিক ক্ষতিগ্রস্ত কর্মীকে জরুরি সহায়তা দিয়েছেন। বিদেশফেরত অসুস্থ ৩০ কর্মীকে বিমানবন্দর থেকে হাসপাতালে নিয়েছেন। দিয়েছেন চিকিৎসা সহায়তা। মানসিক অসুস্থ হয়ে দেশে ফেরা ঠিকানাহীন ৬০ নারীকে নিরাপদে ফিরিয়ে দিয়েছেন পরিবারে। প্রবাসে মৃত ৩৩ কর্মীর পরিবারকে লাশ দেশে আনতে সহায়তা করছেন। বিদেশে বিপদগ্রস্ত বা প্রতারণা ও নির্যাতনের শিকার ৪০০ নারী-পুরুষকে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড ও বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে নিরাপদে দেশে ফেরত এনে তুলে দিয়েছেন স্বজনদের কাছে। শুধু এসব করেই বসে থাকেননি তিনি। স্বপ্ন দেখিয়েছেন ঘুরে দাঁড়ানোর, দিয়েছেন ক্ষমতায়নের প্রেরণা। যুক্ত করে দিয়েছেন ব্র্যাক’র রিইন্টিগ্রেশন সার্ভিস সেন্টারসহ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। তারই তথ্যে ব্র্যাক’র রিইন্টিগ্রেশন সার্ভিস সেন্টার থেকে ৭৩৩ জন পেয়েছেন কাউন্সেলিং ও ৫৫৫ জন পেয়েছেন রিইন্টিগ্রেশন সহায়তা।
এদিকে নির্যাতনের শিকার নারীদের নির্যাতনের ধরন অনুযায়ী কার জন্য কী ব্যবস্থা নিতে হবে, তা অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেন। অনেক সময় ব্যবস্থা নিয়ে তারপর কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেন। নয়ন জানান, এমনও হয়, দিনে প্রায় একশ’ থেকে দেড়শ’ ফোন রিসিভ করি। ফোনে এত কথা বলা, সরাসরি সমস্যার কথা জানা এসবে বিরক্ত লাগে কিনা জানতে চাইলে বলেন, তারা (ভুক্তভোগী) অসহায় বলেই তো আমার সঙ্গে কথা বলেন।
নয়নের বাড়ি রাজশাহী। বাবা কৃষক। মা গৃহিণী। তিনি নিজেও মালয়েশিয়ায় গিয়ে চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। ২০০৭ সালে এক প্রতিবেশী তাকে মালয়েশিয়াতে সনি ইলেকট্রনিকস কোম্পানিতে চাকরি পাওয়ার আশা দেখায়। মালয়েশিয়া যাওয়ার হাতছানি তাকেও ডাকে। নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি তিনি। নয়নের আগ্রহে শেষ পর্যন্ত পরিবার জমি বিক্রি করে মালয়েশিয়া যাওয়ার খরচ যোগাড় করে। দালাল নয়নকে জানিয়েছিলেন, সনি ইলেকট্রনিকস কোম্পানিতে চাকরি হবে। বেতন ৩৫-৪০ হাজার টাকা। পাসপোর্ট ও সরকারি ছাড়পত্র নিয়েই তিনি মালয়েশিয়ায় যান। কিন্তু যাওয়ার পরই বুঝতে পারেন, তিনিসহ অন্যদের আসলে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। তামিল এক মালিকের অধীনে নয়নদের পাহাড়ের জঙ্গল কাটতে হতো। সাপ, পিঁপড়া, ব্যাঙ, কেঁচো জোঁক সবই সহ্য করতে হতো। কাজ করতে না চাইলে নেমে আসতো চরম নির্যাতন। বেধড়ক পিটুনি ছাড়াও নানা কায়দায় নির্যাতন করা হতো। পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্ণা থেকে খাওয়ার পানি আনতে হতো। একসময় আর সহ্য করতে না পেরে ৬জন আত্মহত্যা করার হুমকি দেন। তারপর তাদের ফেরত দেয়া হয় পূর্বের এজেন্টের কাছে। সেখানে একটি গোডাউনে ৩০০-৪০০ জনকে বন্দি করে রাখা হয়। জানালা ভেঙে নয়নসহ ১১০ জন পালান দূতাবাসে। দূতাবাসের কাছে সহায়তা পাওয়ার জন্য গিয়েও তাদের লাভ হয়নি। প্রায় সাত মাস বেতন ছাড়া, আশ্রয় ছাড়া মানবেতর জীবন কাটাতে হয়। কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে জীবন বাঁচানোর তাগিদে দূতাবাসের সামনে অনশনসহ বিভিন্ন আন্দোলনে নামেন নয়নরা। এ সময় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এই আন্দোলনের খবর বেশ গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়। অবশেষে সেখানে মালয়েশিয়ার এক মানবাধিকার সংস্থা তানাগানিতা ও বাংলাদেশি মানবাধিকারকর্মী হারুণ অর রশিদ নয়দের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। পরে তাদের বাংলাদেশে পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হলে ৮০ জন শুধু প্রাণ নিয়ে বাংলাদেশে ফেরত আসতে সক্ষম হন।
নয়ন বলেন, তিনি যখন খালি হাতে মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফেরত আসেন, তখন রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গেলে লোকে টিটকারি দিতো, উপহাস করতো। বলতো, এখন আর কী করবে? ঢাকায় গিয়ে ভিক্ষার থালা নিয়ে বসো। দেশে আসার পর ক্ষতিপূরণের দাবিতে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোতে লিখিত অভিযোগ করলে তা তদন্ত শেষে রিক্রুটিং এজেন্সি মেসার্স গোল্ডেন এ্যারো লি. মালয়েশিয়া যাওয়া বাবদ ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা ফেরত দেন নয়নসহ ৮০ কর্মীকে। এরপর শুরু হলো নয়নের পথচলা, সিদ্ধান্ত নিলেন তার মতো পরিস্থিতির শিকার মানুষের পাশে দাঁড়াবেন তিনি।
নয়ন বলেন, ‘বিদেশে কাজে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফেরত আসার যে কষ্ট, তা আমার চেয়ে আর কে ভালো বুঝবে! নিজে ভিকটিম তো, তাই অন্যদের কষ্টটা বুঝতে পারি। বিমানবন্দরে ফেরত আসা শ্রমিকেরা যখন নির্যাতনের কাহিনী বলতে থাকেন, আমি তখন আমার নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া দিনগুলো চোখের সামনে দেখতে পাই। বুঝতে পারি, কোন ধরনের পরিস্থিতি হলে বিদেশে কেউ আত্মহত্যা করতে চান বা দেশে ফেরত আসতে চান। আমি নিজেও দেশে ফেরার জন্য মরিয়া হয়ে অনশন করি, আত্মহত্যার হুমকি দিয়েছিলাম। খাওয়ার টাকা না থাকায় অন্যের কাছে হাত পাততেও হয়েছিল আমাকে। সেখান থেকেই পথচলা। অভিবাসীদের অধিকার রক্ষায় সাহসী লড়াই চালিয়ে যাবেন বলে প্রত্যয় ব্যক্ত করেন নয়ন। বলেন, সবার জন্য সুষ্ঠু ও সুন্দর কর্মক্ষেত্র তৈরি করার জন্য শুধু সরকার না, আমাদের প্রত্যেকেরই ভূমিকা রয়েছে। আমি চাই মানুষ নিরাপদে ও দক্ষ হয়ে বিদেশ যাক, কম খরচে বিদেশ যাক, গিয়ে ভালো থাকুক, বিশেষ করে নারীরা যেন কোন বিপদে না পড়ুক আর কেউ যেন মানবপাচারের শিকার না হয়। একটা সুন্দর দেশ চাই, একটা সুন্দর পৃথিবী। ভালোবাস ও মায়াই এই পৃথিবীকে আরও অনেক সুন্দর করতে পারে।


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

সংবাদটি শেয়ার করুন