মন্ট্রিয়লে বই মেলা যেনো একখন্ড বাংলাদেশ
এবছরের সেরা স্টল সিবিএনএ২৪ডটকম
এবছর মন্ট্রিয়লের বই মেলা যেনো একখন্ড বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিলো। ফেব্রয়ারির এমন সময়ে সাধারনত প্রচন্ড তুষারপাত আর শৈত্য প্রবাহের তান্ডবে কানাডার কোন অনুষ্ঠানে শেকড়ের বন্ধন বাঙালিপনার আবহ শাড়ি, সালোয়ার কামিজ, পাঞ্জাবি পড়ে যাওয়া সহজ কথা নয়। মাইনাস ২০/৩০ ডিগ্রীর মাঝে একুশের অনুষ্ঠান করা একমাত্র বাঙালি বাংলাদেশীরাই পারে অন্য কেউ করতে পারবে কি না সন্দেহ। তবে এবছর আয়োজকদের ভাগ্য সুপ্রশন্ন বলতে হবে। সেদিন বাইরে আবহাওয়া এ সময়ের জন্য চমৎকারই ছিলো , শৈত্য প্রবাহের তান্ডব নেই, নেই তুষারপাতের বিরামহীন পতন শুধু ছিলো বাংলা ভাষাভাষি মানুষের ঢল! অনেকের জন্য অনুষ্ঠানস্থল কিছুটা দূরে হলেও গন্তব্য শুধু এক জায়গায় সেটা হলো প্রবাসীদের প্রাণের মেলা বই মেলা। বই মেলা মানেই অন্য কিছু, ফেলে আসা দিনগুলো স্মৃতিতে ফিরে যাওয়া চোখের পলকে সেই একুশের রাতজাগা পোষ্টার-ব্যানার বানানো, গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ফুল সংগ্রহ করে ফুলের তোড়া বানিয়ে খালি পা-য়ে প্রভাত ফেরি, লেটার প্রেস থেকে প্রকাশিত সংকলন আর কবিতার পামলেট! আর সময় হলেই বিকালের ডুবে যাওয়া সূর্যের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে দলবেঁধে বইমেলাতে যাওয়া বই’র পাশাপাশি কতকিছু দেখা আর কবিতা শোনা!
দেশে ফাগুনের আগুনঝরা ফেব্রুয়ারি হলেও মন্ট্রিয়লে শেতশুভ্রঝরা তুষার পাতের শহর মন্ট্রিয়ল প্রবাসীদের জন্য বিগত আট বছর ধরে এমন একটি দিন আসে আর সেটা হলো একুশের বই মেলা! হোকনা ছোট্ট পরিসরে তারপরেও বইমেলা বলে কথা! প্রবাসীদের সেই প্রাণের মেলা- বই মেলা অনুষ্ঠিত হলো ২২ ফেব্রুয়ারি শনিবারে।
কানাডা-বাংলাদেশ সলিডারিটি সিবিএস আয়োজনে মহান একুশে ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং ৮ম বই মেলা অনুষ্ঠিত হলো মন্ট্রিয়লের ৮২০০ বুলভার্ড সেন্ট-লরেন্টের লুসিয়েন পাজে হাই স্কুলের লবি ও অডিটোরিয়ামে । কানাডা-বাংলাদেশ সলিডারিটি’র সভাপতি জিয়াউল হক জিয়া এবং অষ্টম কানাডা একুশে বইমেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সমন্বয়ক, সাংবাদিক-উপস্থাপিকা এবং আবৃত্তিকার শামসাদ রানার পরিচালনায় দিনব্যপী রকমারি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন কানাডাস্থ বাংলাদেশের হাই কমিশনার মিজানুর রহমান এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত নাট্য ব্যক্তিত্ব, শিল্পী লেখক ও সাংবাদিক ফাল্গুনী হামিদ এবং বাংলাদেশের কিংবদন্তী রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী কাদেরী কিবরিয়া।
সকাল থেকেই অনুষ্ঠাস্থলে বিভিন্ন সংগঠন, কবি-লেখক-সাহিত্যিক- আবৃত্তিকার, সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার ও প্রকাশকদেরকে এবং বিপুল সংখ্যক কর্মীরা নিজ নিজ স্টল এবং অস্থায়ী শহীদ মিনার আর অনুষ্ঠান মালার রিয়ার্সেল নিয়ে শিল্পীরা ব্যাস্ত থাকতে দেখা যায়। মহান একুশে এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ভাষা আন্দোলনের সকল শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে অস্থায়ী শহীদ মিনারে পুস্পস্তবক অর্পন করা হয় তখন স্থানীয় শিল্পীদের কন্ঠে ‘ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী/ আমি কি ভুলিতে পারি।/ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু গড়ায়ে ফেব্রুয়ারী/আমি কি ভুলিতে পারি…’ কালজয়ী অমর সংগীতটি পরিবেশীত হলে একুশের আবহের সৃষ্টি হয়্ ।
একুশের বই মেলাতে প্রচুর স্টলের মধ্যে এবছরের আকর্ষন ছিলো কানাডা বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি-সিবিএনএ২৪ডটকমের স্টল। বিশাল স্টল জুড়ে ছিলো সিবিএনএ-এর চতর্থ বর্ষপূতি উপলক্ষে বিশাল কলবরে প্রকাশিত সারি সারি বই’র স্তূপ, টেবিলে কানাডা বাংলাদেশের পতাকার পাশাপাশি ছিলো সিবিএনএ-এর লোগো সম্বলিত বিভিন্ন রকমের স্টিকার, কলম, পোষ্টার, এবং মহান একুশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে রকমারি টি শার্ট, ছিলো সদেরা সুজন সম্পাদিত ১৯৭১ এর স্মৃতিচারণমূলক বেশ কয়েকটি গ্রন্থ। ছিলো বিভিন্ন লেখকের বই’র সমাহার। এক ঝাক নতুন প্রজন্মের কর্মিরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আর সিবিএনএ-এর লোগো সম্বলিত হলুদ টিশার্ট পড়ে স্টল পরিচালনার পাশাপাশি কয়েকজন ফটোগ্রাফার পুরো অনুষ্ঠানটি কাভার করেন যা ছিলো দেখার মতো্ । তাদের অমায়িক ব্যবহারে মুগ্ধ উপস্থিত দর্শক-ক্রেতারা। এদেশে জন্ম হওয়া এবং বড় হয়ে ওঠা সিবিএনএ-এর প্রজন্ম সন্তানরা বাংলা-ইংলীশ এবং ফ্রেঞ্চ ভাষায় দক্ষ । সিবিএনএ-এর স্টলের দায়িত্বে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছিলেন শ্রাবনী দেবরায়, সৌভিক দেবরায় এবং অভিষেক ধর দীপ্র। সার্বিক তত্ত্ববধানে ছিলেন সিবিএনএ-এর প্রধান উপদেষ্টা বিদ্যুৎ ভৌমিক, তামসী দেবরায়, দেবাশীষ ধর চৌধুরী রনী এবং তাপস ধর। পুরো অনুষ্ঠানের ফটোগ্রাফিতে ছিলেন দেবাশীষ ধর, সম্রাট দেবরায় ও সদেরা সুজন।
সিবিএনএ-এর চতুর্থ বর্ষপূতি উপলক্ষে চার রঙের অফসেট পেপারে দু’ভাষায় প্রকাশিত বিশাল গ্রন্থটির মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের পরিচালনা করেন সাংবাদিক শামসাদ রানা। মোড়ক উন্মোচন করেন মান্যবর রাষ্টদূত মিজানুর রহমান এবং অভিনেত্রী ও সাংবাদিক ফালগুনী হামিদ। বক্তব্য রাখেন সিবিএনএ-এর প্রধান উপদেষ্টা বিদ্যুৎ ভৌমিক ও সিবিএনএ-এর প্রধান নির্বাহী সদেরা সুজন। মোড়ক উন্মোচনে আরো উপস্থিত ছিলেন সিবিএনএ-এর উপদেষ্টা দিলীপ কর্মকার, সহযোগী সম্পাদক দীপক ধর অপু, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শামীমুল হাসান, রশীদ খান, সাংবাদিক রুমু ইসলাম, মন্ট্রিয়ল বইমেলার জনক ও সংগঠক জিয়াউল হক জিয়া, সাংবাদিক শামসাদ রানা, লেখক অপরাহ্ণ সুসমিতো এবং লেখক আলিফ আলম।
একই সময়ে মাইক থেকে ঘোষণা হয় এবছরের বই মেলাতে সেরা স্টল হিসেবে সিবিএনএ২৪ডটকম নির্বাচিত হয়। সিবিএনএ-এর পুরো টিম শ্রেষ্ঠ স্টলের ক্রেস্ট গ্রহন করে।
বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিষয় সম্বলিত লেখাগুলো নিয়ে Arial Publication কর্তৃক প্রকাশিত বিদ্যুৎ ভৌমিকের English এ লেখা বই “My Window To The World” এর মোড়ক উন্মোচন হয় একুশে বইমেলায় । এখানে উল্লেখযোগ্য যে, Englishএ লেখা বিদ্যুৎ ভৌমিকের তথ্যবহুল লেখাগুলোর অধিকাংশই প্রকাশিত হয় জনপ্রিয় online newspaper www.cbna24.com, এ ছাড়াও কিছু কিছু লেখা The South Asian Digest সহ অন্যান্য English Newspaper এ প্রকাশিত হয়েছে । বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন ২০০৪ সালে বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত শ্রেষ্ঠ অধ্যাপক ও ইউনেষ্কো পুরস্কার প্রাপ্ত চিত্রশিল্পী, লেখক ও অধ্যাপক আজিজুর রহমান লস্কর । English এ লেখা বই “My Window To The World” এর উপর জ্ঞানগর্ব আালোচনা করেন Inernational Relations এ বিশেষজ্ঞ ডঃ কোদরত এ হুদা । ক্যানাডা বাংলাদেশ সলিডারিটির পক্ষেএকুশে বইমেলার অন্যতম সংঘটক সামসাদ রানা অনুষ্ঠানসমূহসহ সুন্দর ভাবে পরিচালনাকরেন ।
কবি ও প্রবন্ধিক আব্দুল হাসিবের চারটি গ্রন্থের মোড়ক উনোমাচন করেন রাষ্ট্রদূত মিজানুর রহমান ও অভিনেত্রী ফাল্গনী হামিদ। সুদূর টরন্টো থেকে বই মেলাতে যোগ দেন মৌ মধুবন্তী। কবি মৌ মধুবন্তীর গ্রন্থের মোড়ক উনোমচিত করেন রাষ্ট্রদূত মিজানুর রহমান ও অভিনেত্রী ফাল্গনী হামিদ।
বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির নিরন্তর সৃজনশীল অবদানের জন্য কানাডা প্রবাসী লেখক ও কথা সাহিত্যিক অপরাহ্ণ সুসমিতোকে এবছরের কানাডা একুশে সম্মাননা দেওয়া হয়।
মন্ট্রিয়লের একুশের বই মেলাতে প্রতি বছরের মতো এবারও ‘দূরের আকাশ’ নামে একটি বিশেষ সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। কানাডার প্রধান মন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোসজ দেশের এগারজন মন্ত্রী ও এমপি একুশের উপর বাণী প্রকাশিত হয়েছে।
জিয়াউল হক জিয়ার সভাপতিত্বে একুশের আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন সৈয়দ রহমত উল্লাহ, শ্যামল দত্ত, ফনীন্দ্র ভট্টাচার্য, রুমু ইসলাম, কাজী শহীদ, রশিদ খান, শামিমুল হাসান, ময়নুল ইসলাম, আলী আহমদ, বাবলা দেব, এবং মতূর্জা কানন। অনুষ্ঠান ছোট ছোট শিশুদের ছবি আঁকা ,গল্প বলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানটি শেষ হয়। বইমেলা উপলক্ষে মন্টিয়লে বইমেলার পাশাপাশি “বঙ্গবন্ধু কর্নার” করা হয়। বঙ্গবন্ধু কর্নার উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ থেকে আগত বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের নির্বাহী সভাপতি ও অভিনেত্রী লেখক, সাংবাদিক ফাল্গুনী হামিদ।
আলোচনা সভায় কানাডাস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনার মিজানুর রহমান বলেন, ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের উন্মেষ। ভাষা আন্দোলন না হলে হয়তো আমরা আজকের এ স্বাধীনতা পেতাম না। তিনি আরও বলেন বাংলা ভাষার চর্চায় আরো গুরুত্ব বাড়াতে হবে।
বিশিষ্ট অভিনেত্রী শিল্পী লেখক ও সাংবাদিক ফাল্গুনী হামিদ বলেন, “পাকিস্তানিরা চেয়েছিল পূর্বপাকিস্তানে উর্দুই হোক রাষ্ট্রভাষা, কিন্তু আমাদের দেশের দামাল ছেলেরা তা অগ্রাহ্য করে নেমে পড়ে ঢাকার রাজপথে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার সহ আরো অনেকে। তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা ভাষা পেয়েছি, পরবর্তীতে বাংলাদেশে যত আন্দোলন হয়েছে তার মূলে ছিল এই ভাষা আন্দোলন।”
তিনি আরও বলেন, প্রবাসেও বাংলা ভাষার গুরুত্ব দিয়ে আমাদের কোমলমতি শিশুদের মাঝে এর চর্চা করতে হবে। পরিশেষে তিনি কানাডা-বাংলাদেশ সলিডারিটি সংগঠনসহ সকলকে ধন্যবাদ জানান।
অত্যাধুনিক মঞ্চে অনুষ্ঠিত সলিডারিটি আয়োজিত সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার শুরুতেই শুভসূচনা হয় সরগম মিউজিক একাডেমীর পরিবেশনার মধ্য দিয়ে । এই উদ্বোধনী পর্বে সরগম মিউজিক একাডেমীর পরিবেশনায় ছিল তিনটি কোরাস, তিনটি একক এবং একটি দলিয় নৃত্ত। প্রথম কোরাস গানটির ( আমার এই বাংলা ভাষা ,আমার এই মায়ের ভাষা ) রচয়িতা রণজিৎ মজুমদার এবং সুরারোপ করেছেন ডরিন মলি গোমেজ । তবলায়- ঝলক দেব চৌধুরী, টেম্বোলিনায়- রনজিত মজুমদার, গীটারে- এফাজ উল হক, নৃত্ত পরিচালনায়- অরজিতা বান্সাল গুপ্তা , পরিচালনায়- একাডেমীর প্রিন্সিপ্যাল ডরিন মলি গোমেজ এবং শর্মিষ্ঠা মন্ডল ।
অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি ও নিবন্ধ পাঠ করেন আফাজ উদ্দীন তোতন, সঞ্জীব দাস, কবি মৌ মধুবন্তী, ক্যাপ্টেন ফরিদও জেসমিন ফরিদ, আরিয়ান হক এবং ইসরাত আলম। অনুষ্ঠানের আবৃত্তি পর্বে ভাষার উপর নিজের লেখা কবিতা পাঠ করেন রনজিত মজুমদার।
সংগীত পরিবেশন করেন নিরোজ বড়ুয়া, মঞ্জুর চৌধুরী মিঠু, মুনমুন দেব, অনুজা দত্ত, শেলী দেব, সাফিনা করিম, শিখা আহমদ এবং অতিথি শিল্পী কাদেরী কিবরিয়া। তবলায় ছিলেন ঝলক দেব চৌধুরী। বেহালায় একুশের গান পরিবেশন করে দিব্য ধর । বুলগেরিয়ার ভানিয়া ত্রিকোনোভোর রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশনা ছিলো চমৎকার।
এছাড়াও ছোটদের গল্পবলা এবং ছবি আঁকা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানের ভিডিও ফটোগ্রাফিতে ছিলেন আরিফ সিদ্দিকী।
আরও পড়ুনঃ