বাংলাদেশী বহু প্রবাসী শ্রমিক বর্তমানে বিভিন্ন দেশের কর্তৃপক্ষের হাতে আটক আছেন – একটি সংস্থার হিসেব মতে যাদের সংথ্যা ১০ হাজারের কাছাকাছি।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর এ বছরেই মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশে কারাগার অথবা ডিটেনশন সেন্টারে আটক প্রবাসী বহু বাংলাদেশী প্রবাসী শ্রমিককে দেশে ফেরত পাঠিয়েছে সেসব দেশের কর্তৃপক্ষ।
তবে এখনো আরও অনেকে আটক রয়েছেন অনেক দেশে। তাদের অধিকাংশের বিরুদ্ধে শ্রম আইন ভঙ্গের অভিযোগ আছে।
সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশী প্রবাসী শ্রমিক আটক রয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে, আর একটি বড় অংশ আটক আছেন ভারতের কারাগারগুলোয়।
কত লোক আটক আছেন?
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্রাকের অভিবাসন বিষয়ক যে কর্মসূচি রয়েছে সেখান থেকে আনুমানিক একটি তথ্য দেয়া হয়েছে যে পৃথিবীর নানা দেশে বাংলাদেশী প্রবাসী আটকের সংখ্যা দশ হাজারের মতো হবে।
গত বছর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে এই বিষয়ে তথ্য দিয়ে বলেছিলেন – পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রায় নয় হাজারের মতো বাংলাদেশি আটক রয়েছেন বিভিন্ন কারণে।
তবে এ বছর এখনো পর্যন্ত সরকারের তরফ থেকে এই বিষয়ে কোন তথ্য দেয়া হয়নি।
তবে এই সংখ্যাটি ওঠানামা করে কারণ অনেককেই দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়।
যেমন এবছর করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর দিকে মধ্যপ্রাচ্যের কুয়েত, কাতার, ওমান, আরব আমিরাত এসব দেশ তাদের কারাগারে আটক এক হাজারের মতো বাংলাদেশিদের দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে।
সিরিয়া থেকে মাত্র কদিন আগেই ফেরত পাঠানো হয়েছে ৩২ জনকে। একটি বড় অংশ রয়েছেন ভারতের কারাগারে।
সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মালয়েশিয়া এই দেশগুলোতে আটকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
সৌদি আরবের রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে জানানো হয়েছে শুধুমাত্র রিয়াদেই আটক রয়েছেন এগারোশ’র মতো প্রবাসী শ্রমিক।
যে কারণে আটক হন তারা
কারাগার আটক থেকেছেন পরে দেশে এসেছেন এরকম শ্রমিক, মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের দূতাবাস এবং ব্রাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেল মূলত শ্রম আইন ভঙ্গ করার জন্য বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকরা আটক হন।
ব্রাকের অভিবাসন কর্মসূচীর প্রধান শরিফুল হাসান বলছেন, “একটি কারণ হল মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশে যাওয়ার সময় শ্রমিকের যে মালিক বা কোম্পানির সাথে কাজের চুক্তি হয়েছিল, সেই চুক্তি ভঙ্গ করে তারা আরও বেশি বেতনের জন্য অন্য কারো সাথে কাজ নিয়েছেন। আর এর মুল কারণ হল তাদের বেতন বা সুবিধাদি দেয়া হবে বলে গন্তব্য দেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেখানে গিয়ে তারা ভিন্ন কিছু পান।”
“আরেকটি প্রধান বিষয় হল যে খরচ হয় ওসব দেশে যেতে। ধরুন জমি বেচে বা দামি কিছু বিক্রি করে চার-পাঁচ লাখ টাকা এজেন্সিকে দিয়ে তারপর মধ্যপ্রাচ্যে যারা যান তারা তাদের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও ওই টাকা তুলতে দেশটিতে রয়ে যান এবং অন্য কোথাও কাজ নেন। তখন তারা আনডকুমেন্টেড বা অবৈধ হিসেবে বিবেচিত হন। এই দুটিই অভিবাসী শ্রমিকদের আটক হওয়ার মুল কারণ।”
কারাগার ও ডিটেনশন কেন্দ্রে দুইজনের অভিজ্ঞতা
বাংলাদেশের পিরোজপুরের ছেলে পড়তে গিয়েছিলেন মালয়েশিয়াতে। একদম শেষ বর্ষে ওঠার পর হঠাৎ প্রতারণার অভিযোগে তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করে মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষ।
তিনি জানিয়েছেন, “আমার ভিসার মেয়াদ তখনো ছিল। কিন্তু খুব বেশি দিন না। কলেজ কর্তৃপক্ষ জানালো যে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। তারা নতুন ভিসার জন্য আমার পাসপোর্ট জমা নিলো। এরপর ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও তাদের আশ্বাসে আমি সেখানে রয়ে গিয়েছিলাম।”
“নতুন ভিসা ও পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার আগেই একদিন কুয়ালালামপুরে বাংলা মার্কেটে গেছি। সেখানে হঠাৎ পুলিশের অভিযান। সেখানে যত বাংলাদেশি পেয়েছে সবাইকে আটক করে নিয়ে গেল। যাদের বৈধ কাগজ ছিল তাদের ছেড়ে দেয়া হল। আমাকে প্রথমে ডিটেনশন সেন্টারে রাখা হল। এরপর আদালত আমাকে ভিসার মেয়াদ শেষ করার পরও সেদেশে থাকার জন্য তিন মাসের কারাদণ্ড দেয়া হল।”
গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে কারাদণ্ডের মেয়াদ শেষে দেশে ফিরে আসেন আত্মীয়দের সহায়তা।
তিনি বলছেন, পড়াশুনার একদম শেষ পর্যায়ে এসে এই ঘটনা তার জীবন পুরো ওলটপালট করে দিয়েছে। যা থেকে তিনি এখনো ঘুরে দাড়াতে পারেননি।
সৌদি আরবে মাত্র সাত মাসের মতো ছিলেন টাঙ্গাইলের একজন। সেখানে পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে কাজ করতেন।
যাওয়ার পরই দেখলেন মালিক তার বেতন বকেয়া রাখছে।
“যাওয়ার জন্য খরচ হয়েছিল ৪ লাখ টাকার মতো। যাওয়ার পর মালিক ঠিক মতো বেতন দিত না। বেতন চাইতে গেলে মারধোর করতো। খাবার যা দিতো তা খুবই মানে খারাপ। বাইরে কোথাও যেতে দিতো না। এসব নিয়ে আমি আমার দালালকে বললাম। সে আমাকে বলল তুই পালা, তোরে আমি আরও ভাল কাজ দেবো। এই যে না বুঝে তার কথামতো আমি পালিয়ে চাচাতো ভাইয়ের কাছে গেলাম সেটাই ছিল সবচেয়ে বড় ভুল।”
চাচাতো ভাই তাকে একদিন থাকতে দিয়েছিল। এরপর তাকে চলে যেতে বলেন তিনি।
এরপর মক্কায় এক মামার কাছে গেলেন। সেখানে কয়েকদিন থাকার পর সেও চলে যেতে বলল।
দালালের কাছে নতুন কাজ চাইলে তার কাছে এক লাখ টাকা দাবি করেন তিনি।
এরপর টাঙ্গাইলের এই যুবক নিজেই একটি রুটির দোকানে কাজ খুঁজে নেন। এই পরিস্থিতিতে অবৈধ শ্রমিক হিসেবে পুলিশের হাতে আটক হন।
আটক ব্যক্তিরা কতটুকু সহায়তা পান?
সৌদি দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলছেন, বাংলাদেশের যেকোনো নাগরিক বিদেশে কারাগারে আটক হলে বা আইনি জটিলতায় পড়লে দূতাবাসের সহায়তা পায়।
তিনি বলছেন, শ্রম আইন বিষয়ক কিছু হলে আইনি সহায়তা করা হয়। কিন্তু ফৌজদারি কোন অপরাধ হলে শ্রমিককে নিজেকেই আইনজীবী নিয়োগ করতে হয়।
তিনি বলছেন, যে দুটি প্রধান কারণে মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিকরা আটক হন যেমন নিয়োগ চুক্তি ভঙ্গ করে অন্য কোথাও কাজ নেয়া এবং মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও সেদেশে রয়ে যাওয়া এই দুই ধরনের শ্রমিকদের সাধারণত ‘ডিপোর্ট’ বা দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়।
এর বাইরে তাদের আর কোনভাবে সহায়তার কোন উপায় নেই।
দূতাবাস কর্মকর্তার বক্তব্য অনুযায়ী দুই ধরনের আটক ব্যক্তিদের সাথেই তারা দেখা করেন, পরামর্শ দেন এবং দেশে ফিরতে সহায়তা করেন।
কিন্তু বেশিরভাগ সময় অভিযোগ ওঠে যতটুকু সহযোগিতা আটক ব্যক্তিদের দরকার সেটি তারা পান না।
যেমন মালয়েশিয়াতে তিনমাস কারাদণ্ড ভোগ করা তরুণ বলছেন, “আটক হওয়া, আদালতে বিচার এবং তিনমাস কারাগারে থাকা এই পুরো সময়ে আমার সাথে দূতাবাস থেকে কেউ দেখা করতে আসেনি। তারা জানতো আমি আটক হয়েছি সেটা জানতো কারণ আমি সেখানে অসহায় প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করতাম। কিন্তু তারা কেউ আসেনি।”
সৌদি আরবে আটক ব্যক্তি বলছেন, সৌদি আরবে থাকা তার আত্মীয় ও দেশ থেকে পরিবারের পাঠানো টাকা তিনি ডিটেনশন সেন্টারে ঘুষ আকারে দিয়ে তবে দেশে ফিরেছেন।
তবে রিয়াদে দূতাবাস কর্মকর্তা বলছেন, সৌদি আরবে শ্রমিক রয়েছেন ২০ লাখের উপরে।
নানা শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে তারা থাকে কিন্তু সেখানকার দূতাবাসে কর্মী সংখ্যা এতই কম যে বিপদে শ্রমিকদের কাছে তাদের পৌছাতে দেরি হয়।
তবে সহায়তা দেয়ার ব্যাপারে তাদের আন্তরিকতার কোন ঘাটতি নেই।
সূত্রঃ বিবিসি বাংলা
বাঅ/এমএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন