ফিচার্ড ভ্রমণ

বাঙালি দম্পতির অ্যান্টার্কটিকা জয়ের বিস্ময়কর গল্প

বাঙালি দম্পতির অ্যান্টার্কটিকা জয়ের বিস্ময়কর গল্প

বেড়াবার ঝোঁক বরাবরই। দশটা পাঁচটা চাকরি। দৈনিকের হিসাব। এভাবে জীবন ভারি করতে চান না দু’জনই। বুয়েট থেকে পড়াশোনা শেষে আমেরিকার কানেকটিকাটে পাড়ি জমান। উচ্চতর বিষয়ে গবেষণা করেন। তারপর ক্যারিয়ার। নানান সংকট শেষে থিতু হন ২০০৮ সাল থেকে।

দিনের ব্যস্ততা শেষে দুজনই ট্র্যাভেল শো’র নেশায় বুঁদ হন।

স্বপ্নগুলো রঙিন প্রজাপতি হয়ে ডানা মেলতে থাকে ধীরে ধীরে। ফুরসত পেলেই শুরু হয় ইতিউতি বেরিয়ে পড়া। তবে গতানুগতিক ভ্রমণ তাদের পছন্দ নয়। একটু কষ্টকর, পরিশ্রমসাধ্য। খানিকটা ফিলোসফিক্যালও বটে। হাঁটতে হয়, কসরত করতে হয় তবে দেখার শেষে মেলে প্রশান্তি। কখনো আধ্যাত্মিক; কখনো বিমূর্ত। কখনো নিজেদের অন্যভাবে আবিষ্কার করা। খুঁজে খুঁজে এমন সব জায়গা বের করেন। শত ঝুট ঝামেলা পাড়ি দিয়ে বেরিয়ে পড়েন ব্যাকপ্যাক নিয়ে।

শুরুটা ২০০৮ সালে। এই তেরো বছরের ভ্রমণ তালিকায় এরই মধ্যে দেখা শেষ করেছেন ছয় মহাদেশের আশি দেশ। তাদের সবশেষ ভ্রমণ তালিকায় যুক্ত হয়েছে সপ্তম মহাদেশ। যা তাদের জীবনের সেরা বিস্ময়কর ভ্রমণ। এই বাঙালি দম্পতির অ্যান্টার্কটিকা জয়। ঢাকায় ইনাম আল হক হচ্ছেন প্রথম ব্যক্তি যিনি সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে রূপকথার গল্পের নায়কের মতোই জয় করেছেন ইরান তুরান পাড়ি দিয়ে অ্যান্টার্কটিকা। আর এই বাংলাদেশেরই দীপু ও শারমীন হাতে হাত রেখে, কাঁধে মাথা রেখে জয় করেছেন পৃথিবীর বিস্ময়কর ও রহস্যঘেরা অ্যান্টার্কটিকা।
বলছিলাম রেজাউল বাহার ও শাহরিয়াত শারমীনের কথা। পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার। অন্যজন করপোরেট জগতের মানুষ। একজন ১৯৯৯ আর অন্যজন ২০০৫ সালে জীবনের তাগিদে আসেন যুক্তরাষ্ট্রে। অন্য আর দশটি পরিবারের মতো তাদের টানা হেঁচড়ায় জীবন শুরু। টানটানির জীবনে সব শেষে ভ্রমণের জন্য সঞ্চয়। বৈষয়িক জীবনের মোহ দূরে রেখে অল্পবিস্তর সঞ্চয় নিয়ে মুক্তাকাশে ঘুড়ি উড়িয়ে দেয়া। নানান রোমাঞ্চে ভরপুর এই দম্পতির ভ্রমণ নেশার গল্প তরতরিয়ে এগিয়ে চলে এভাবেই।

দুজনের এই অভিযাত্রা কীভাবে শুরু?
শাম্মীর সঙ্গে বিয়ের পনেরো বছর। দেশে বুয়েটে পড়াশোনা শেষ করে পাড়ি দেই যুক্তরাষ্ট্রে। কানেক্টিকাট স্টেটে চাকরির মাধ্যমে প্রবাসী জীবন শুরু। ২০০৫ সালে শাম্মী আসে মাস্টার্স প্রোগ্রামে। জীবনযুদ্ধ, ভিনদেশে মাইগ্রেশনের জন্য প্রথমদিকে খুব ধকল যায়। পরে ধীরে ধীরে জীবন ছন্দময় হয়। মূলত দুটি বিষয় আমাদের ভ্রমণ নেশাকে উসকে দেয়। এক. কাজ থেকে বাসায় ফিরে ট্রাভেল চ্যানেলে সামান্থা ব্রাউন আর অ্যান্থনি বোর্ডেইন-এর শোগুলো খুবই উপভোগ করি। দুই. শাম্মীর অন্য অনেকের মতো ঘর সংসারের জিনিসপত্র, গহনা বা জামা কাপড়ের কোনো শখ ছিল না। শখ একটাই তা হলো ঘুরতে যাওয়ার ব্যাপারে এক পায়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া। দুজনের ভ্রমণের শুরু এখান থেকেই। আমেরিকার স্টেটগুলো ঘুরতে ঘুরতে প্রথম পা দেই ক্যারিবিয়ানের বাহামা আইল্যান্ডে। তারপর ইউরোপ আর সেন্ট্রাল আমেরিকা। তারপর ২০১৩ সালে মার্কিন পাসপোর্ট পাওয়ায় ভিসা ফ্রি হয়ে পরে ট্রাভেল। দেখতে দেখতে দশ বছরে ছয় মহাদেশের আশিটির মতো দেশ ভ্রমণ করি আমরা। আর আমাদের ভ্রমণের ব্যাপারটা একেবারেই ফিলোসোফিক্যাল।

একজন মানুষ হিসাবে এই পৃথিবীর যতটুকু দেখা যায়, জানা যায়, এটুকুই চাওয়া, এর চেয়ে বেশি কিছু চাওয়া আমার সাধ-সাধ্যের বাইরে। জীবন সীমিত সময়ে বাঁধা, প্রতিদিন ধরেই নেয়া ভালো আর একটা সূর্যোদয় আমার জন্য নাও হতে পারে। এতোটা অনিশ্চয়তায় জীবনে সবকিছুর পিছু দৌড়ানো সম্ভব নয়। তাই যেভাবে আছি, এই বেশ। যা আছে, তাই যথেষ্ট। পরিপূর্ণ জীবন বলে কিছু নেই, সামর্থের মধ্যে যা আছে তাই নিয়ে জীবন। আমরা দুজনই এমনটি বিশ্বাস করি। ভ্রমণ নিয়ে আমাদের লক্ষ্য বলেও কিছু নেই।

সম্পত্তি বা বড় অঙ্কের ব্যাংক-ব্যালেন্স বলে আমাদের কিছু নেই। অনেকেই প্রশ্ন করে- কীভাবে এতো সময় বের করেন, বেড়াবার টাকা পান কোথায়? এখানে মূল ব্যাপার হলো প্রায়োরিটি, জীবনে কী চাই, কোনটা আগে। আমাদের সামর্থ সীমিত, একসঙ্গে সবকিছু চাওয়া মানে না পাওয়ার যন্ত্রনায় ভোগা। আমাদের শেষ বছর গুলোতে প্রায়োরিটি ছিল ভ্রমণ, এখনো তাই আছে। বছরে ছুটি কম, কাজেই রিসার্চ আর অগ্রীম প্ল্যানিংটা প্রয়োজন। ভ্রমণ নিয়ে আমি অনেক রিসার্চ করি- এয়ারপোর্ট, হোটেল, লোকেশন, অ্যাক্টিভিটিস ইত্যাদি। চাকরির সঙ্গেও ভ্রমণকে দুজনই প্রাধান্য দিয়েছি। ক্যারিয়ার এখন মোটামুটি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, কারণ ভ্রমণ প্রথম। চাকরিতে বড় পদে যাওয়া, বেশি অর্থ আয়ের পদে গেলে ভ্রমণের ক্ষেত্রে ছাড় দিতে হবে। কাজেই ঐ যে বললাম, প্রায়োরিটি। জীবনে একসঙ্গে সব পাওয়া যাবে না, কিছু ছাড় দিতেই হবে। ভ্রমণ মানেই যে অনেক দূরে কোথাও যাওয়া তাও কিন্তু না। নতুন কিছু দেখা বা অজানাকে জানাও কিন্তু আনন্দের একটা ব্যাপার।

ভ্রমণ নিয়ে রোমাঞ্চকর স্মরণীয় অভিজ্ঞতা।
অনেক মজার মজার অভিজ্ঞতা আছে। ভ্রমণে গিয়ে একবার এক লাশের সঙ্গে ছবি তুললাম। লাশ ঘরে লাশ রাখা, জীবিতরা লাইন ধরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে লাশ ঘরে লাশ দেখে ফেরত আসছে। সিকিউরিটির লোকজন লাশ পাহাড়া দিচ্ছে। লাশের সঙ্গে ছবি তোলা নিষেধ। আমরাও যাবো, আমার ইচ্ছে হলো আমরা দুজন একাকী লাশের সঙ্গে কিছু সময় কাটাবো। অন্য কেউ থাকবে না। আমাদের সঙ্গে প্রাইভেট ট্যুর গাইড ছিল। তাকে কিছু টাকা অতিরিক্ত দিয়েই ব্যবস্থা করা হলো। পরিকল্পনা এরকম, আমরা দুজন সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যাবো লাশ ঘরে। সিঁড়ির উপরে সিকিউরিটি অন্য মানুষদের কিছুক্ষণের জন্য আটকে দেবে। শাম্মী আর আমি নিচে নেমে গেলাম। কিছুক্ষণ ব্যক্তিগত মুহূর্ত থাকলাম লাশের সঙ্গে, ছবি তুললাম। তারপর উপরে উঠে এলাম। সেই লাশ অন্য কারও নয়, সে মিশরের হাজার বছর আগের ফেরাউন কিং টাট (ঞঁঃধহশযধসবহ)। মিশরে রয়েল ফেরাউনদের মমি রাখা আছে কায়রোর মিউজিয়ামে। শুধু কিং টাট এর মমি রাখা আছে? মিশরে লাক্সর শহরে নীল নদের পাশে ভ্যালি অফ দি কিং-এ ফেরাউনদের মমি পাথর কেটে চেম্বার করে রাখা হতো তার ধন সম্পদ আর ব্যবহৃত জিনিসের সঙ্গে।

অ্যান্টার্কটিকা দেখার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
অবশেষে শারমীন আর আমি পৃথিবীর শেষ মহাদেশে পা ফেললাম। বিস্ময়কর রোমাঞ্চে ঠাঁসা অ্যান্টার্কটিকা দেখলাম। ২০০৮ থেকে শুরু করে একে একে ৬ মহাদেশ দেখা হলো। ২০১৬ সালের ঘটনা। এক সন্ধ্যায় টিভিতে অ্যান্টার্কটিকা নিয়ে কোনো একটি ডকুমেন্টরি দেখতে দেখতে শারমীন বললো- আমি অ্যান্টার্কটিকা যেতে চাই? মনে মনে ভাবলাম, শাম্মী বলে কী! একটু খোঁজ নিলাম, চাইলে যাওয়া যায়। কিন্তু সমস্যা একটাই, অনেক টাকার দরকার। তখনো কিন্তু আমরা বছরে অনেক ঘোরাঘুরি করি, টাকা জমিয়ে তারপর ঘোরাঘুরি। এই ঘোরাঘুরিও বন্ধ রাখা যাবে না। শারমীন বললো আমি আলাদা করে টাকা জমাবো। তারপর প্রায় বছর তিনেক পর হঠাৎ সে বললো অ্যান্টার্কটিকা যাবার জন্য বেশকিছু টাকা জমে গেছে। হিসাব করে যা বুঝলাম, অর্ধেক জমেছে। কী আছে দুনিয়ায়- এই কথা মাথায় রেখে বাকি টাকা ক্রেডিট কার্ড থেকে দিয়ে দিলাম। সিলভার-সী এক্সপেডিশন ক্রুজ লাইনের সঙ্গে এক বছর তিন মাস অগ্রিমে বুকিং শেষ করলাম।

এর পর শুরু হলো অপেক্ষার পালা। অ্যান্টার্কটিকা ভ্রমণের সময় ঠিক হলো ২০২০ এর নভেম্বর। বছর শুরুতেই দুনিয়াজুড়ে করোনা মাহামারিতে স্থবিরতা দেখা দিলো। একে একে বন্ধ হওয়া শুরু হলো সবকিছু।
এই যখন অবস্থা। তখন খবর আসে ঢাকাতে মা অসুস্থ। আমার শেষ আশ্রয়, আমার মা। মায়ের অসুখটা ছিল চলে যাবার অসুখ। মা থাকবে না, এই সত্য নিয়ে প্রতিটা দিন মুহূর্ত পথচলা। অ্যান্টার্কটিকা ট্রিপ আপাতত বাদ দিলাম। ক্রুজ এমনিতেও বাতিল হলো করোনার কারণে। অনেকগুলো টাকা জমা দেয়া, তুলে ফেলবো কিনা ভাবতে শারমীন বললো থাক, পরের বছরের জন্য প্ল্যান করো। টাকা তুলে ফেললে খরচ হয়ে যাবে, আর যাওয়া হবে না অ্যান্টার্কটিকা। সুতরাং অপেক্ষার পালা আবারও।
অ্যান্টার্কটিকা ভ্রমণ পিছিয়ে দিলাম ২০২১ এর ডিসেম্বরে। এরমধ্যে দেশে গেলাম দুবার, ছিলাম বেশকিছু সময় মায়ের সঙ্গে। মা চলে গেল ২০২১ এর ২১শে এপ্রিল।

অনেক চড়াই-উতরাই পারি দিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু ২০২১ এর ১৯শে ডিসেম্বর। চারিদিকে নিয়ম-কানুন, করোনা টেস্ট, ইন্স্যুরেন্স, হেলথ ডিক্লারেশন, চিলিয়ান গভর্নমেন্টের অনুমতি- লম্বা লিস্টের কিছু অংশ। দুটো এয়ারপোর্ট পার হয়ে দক্ষিণ আমেরিকার চিলির শেষ প্রান্তে ক্রুজশিপের পোর্ট-এ পৌঁছানোর পরও বিশ্বাস হচ্ছে না যেতে পারবো কী পারবো না। ডিসেম্বর ২১শের সন্ধ্যা ৬টার দিকে সব শেষ করে যখন সিলভার-সী’র ডাইনিং এ বসে আছি, দেখলাম আমাদের জাহাজ পোর্ট ছেড়ে বেরুচ্ছে। মনে হলো আমাদের স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে, আমরা যাচ্ছি পৃথিবীর শেষ প্রান্তে।

এর পরের ১৬ দিন কেটেছে বিস্ময় নিয়ে। প্রতিটি মুহূর্তই ছিল চমকে ঠাঁসা। কোনো শব্দমালা তৈরি হয়নি যা দিয়ে সেই অনুভূতি প্রকাশ করতে পারবো। প্রথম দু-রাত পারি দিলাম ড্রেক প্যাসেজ, উত্তাল সমুদ্র। উত্তাল বলতে ভয়ঙ্কর, ড্রেক সম্পর্কে জানতে গুগল বা ইউটিউব করে কিছুটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে। ড্রেক প্যাসেজ পার হওয়াটা অ্যান্টার্কটিকারই অংশ। সমুদ্রের সেই রাত মনে থাকবে বহুদিন। শারমীন সী সিকনেসে অসুস্থ হয়ে পড়লো।
দু-রাত পাড়ি দিয়ে পরের এক সকাল। ঘুম থেকে জেগে পর্দা সরিয়ে রুমের পাশে বেলকনিতে যেয়ে শব্দহীন কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। আমার সামনে এক অপরিচিত জগৎ, অনেকটা -আমি কী জেগে আছি না ঘুমে বুঝতে পারছি না। যেদিকে তাকাচ্ছি সাদা মুক্তোর মতো ঝিলিক দিচ্ছে।

এরপর প্রায় সপ্তাখানেক সময়ে একে একে বেশকিছু আইল্যান্ড আর অ্যান্টার্কটিকার মূল ভূখণ্ডে পা রাখলাম। অ্যান্টার্কটিকা নিয়ে গল্প করলে পাঠকের পথচলা থেমে যাবে। হয়তো অবাক-বিস্ময়ে অনেকেই ভাববে এ এক কল্প-কাহিনী। পৃথিবীর শেষ প্রান্তের এই অংশটুকু কল্পনার মতোই। এ জগৎ আমাদের নয়, এ জগৎ পেঙ্গুইন, তিমি, সীল আর আলবাট্রস পাখিদের। সারা মহাদেশজুড়ে ৭০০০ ফুট বরফের স্তর, তাপমাত্রা হিমাঙ্কের অনেক নিচে, মূল ভূখণ্ডে বছরের অর্ধেক সময়ই থাকে মাইনাস (-) ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গলে গেলে সারা পৃথিবীর সমুদ্র ২০০ ফুট উচ্চতায় উঠবে।

কিন্তু আমাদের কাছে এগুলো শুধুই কিছু সংখ্যা মাত্র, এটা বোঝার মতো অবস্থা আমাদের মস্তিষ্কের বাইরে। আর সেটাই বোধহয় ভালো, এন্টাকটিকা থাকুক বাইরের এক জগৎ হয়ে। মানুষতো পৃথিবীর সবকিছুই দখল করে নিলো, কোথাও কিছু থাকুক অন্য প্রাণীকুলের জন্য, অ্যান্টার্কটিকা থাকুক সবার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

-কাজল ঘোষ, মানবজমিন





সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

সংবাদটি শেয়ার করুন