বিমান কি বদলে যাচ্ছে !! ||| মোঃ মাহমুদ হাসান
মুক্ত চিন্তায় বাঁধা আসলে, সত্যের পরিস্ফুটন ঘটে না। সত্য বিবর্জিত লেখনি পাঠক মনে যেমন মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, তেমনি লেখকও তাঁর শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার কে উপস্থাপনে ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে মরহুম মওদুদ আহমেদ ছিলেন এক ব্যতিক্রমী চরিত্র। তাকে নিয়ে আলোচনা সমালোচনার অন্ত ছিল না। কেউ তাঁকে সুবিধাবাদি আবার কেউবা তাকে চতুর বলতেন। তবে মেধা, পান্ডিত্য আর বিচক্ষণতায় তিনি অনেককেই ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন।
রাজনীতিবিদ মওদুদ আহমেদ কে নিয়ে যত বিতর্ক-ই থাকুক, লেখক মওদুদ আহমেদ নানা কারনেই অনেকের পছন্দের ব্যক্তিত্ব ছিলেন। বিএনপির রাজনীতি করে, দলের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের একজন হয়েও লেখক মওদুদ দলীয় মতাদর্শকে উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু কে মূল্যায়ন করেছেন। তিনি হয়তো বিশ্বাস করেছিলেন, চিন্তাশক্তি বন্দী হলে ইতিহাসের কাঠগড়ায় তাঁর সৃষ্টি একদিন হারিয়ে যেতে পারে, তাই লেখক মওদুদ সত্যাশ্রয়ী হয়ে বেঁচে থাকতে চেয়েছেন। আজকের সামাজিক বাস্তবতায় সত্যাশ্রয়ী হওয়া যেন দিন দিন বড় কঠিন হয়ে উঠছে! ‘ভয়’ যেন চারপাশে তাড়া করে ফিরে।
ভয়! চারিদিকে ভয়। এ যেন ভয়ের অক্টোপাস! মত প্রকাশের ভয়, মুক্ত মনে লিখতে গিয়ে ভয়, দ্রব্য মূল্যের উর্ধগতির ভয়, চৌদ্দ পুরুষের ভাষা-সংস্কৃতি কে হারিয়ে সন্তানের বেড়ে উঠার ভয়-এ যেন ভয়েরই সংস্কৃতি!! যারা লিখে, সৃজনশীলতার চর্চা করে, এঁদের ‘বুদ্ধিজীবি’র তকমা লাগার ভয় !! হাড়ভাঙা খাটুনিতে পরবাসে যা আয় রোজগার হয়, স্বজনরা ভোগ বিলাসে সেই কষ্টার্জিত অর্থকে উজাড় করে দেয়ার ভয়। শুভাকাঙ্ক্ষী বেশে জাল-জালিয়াতি করে স্থাবর অস্থাবর সহায় সম্পদ হাতিয়ে নেয়ার ভয়। ভালোবাসার আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখতে বিশ্লেষণধর্মী সমালোচনা করলে, নব্য রাজাকার হয়ে যাওয়ার ভয়!!
‘নীলাম্বর টিভি’ কেলগেরীর বাংলাদেশী কমিউনিটির প্রথম বাংলা টিভি চ্যানেল। মুক্তি যুদ্ধের চেতনা আর মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস কে বিকশিত করতে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ চ্যানেলের একটি নিয়মিত অনুষ্ঠান ‘হ্রদয়ে ৭১’। বাংলাদেশ ও প্রবাসে অবস্থানকারী মুক্তি যোদ্ধাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে স্মৃতিচারণ মূলক অনুষ্ঠানটি পরিচালিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ গবেষক তাজুল মোহাম্মদ অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। গেল সপ্তাহে এক মুক্তি যোদ্ধার বীরত্ব গাঁথার গল্প শুনছিলাম। যিনি মুক্তিযুদ্ধে বাবা, চাচা, সহ পরিবারের অনেক সদস্যকে হারিয়েছেন। যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফিরে শুধু আপন জন নয়, ভিটে মাটি আর জমি জমাতেও অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন নি। একজন যুদ্ধজয়ী কমান্ডার হয়েও স্বাধীনতার একান্নতম দিবসেও আপনজনদের খুনি রাজাকার, আল-বদরদের নাম বলতে ভয় পান! দর্শক আর সঞ্চালকের বারংবার অনুরোধে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলেন, ‘ ভয়, চারিদিকে ভয়! সেই দুঃসাহস আজ আর নেই’। এমন সামাজিক বাস্তবতায় আমার মতো চুনোপুঁটি লেখক
রা তো ডাল-ভাত!
বিমান নিয়ে লিখতে গেলে মাঝে মাঝে কলম থেমে যায়। ‘ভয়’ আমাকে তাড়া করে ফিরে। সাফল্যের কথা লিখতে গিয়েও ভয়, ব্যর্থতায় আরও ভয়। বিমানের দায়িত্ব প্রাপ্ত মন্ত্রী মহোদয় আমার পরিচিত জন। চারপাশের অনেকেই, তাঁর সাথে সম্পর্কের বিষয়টি অবহিত। সফলতার কথা লিখলে, কেউ বলবেন মন্ত্রী কে খুশি করতে চাই। আবার ব্যর্থতার কথা লিখলে বলবেন, তাঁকে বিতর্কিত করতে চাই। তাই পারতপক্ষে বিমান, এভিয়েশন আর পর্যটনকে চিন্তা শক্তির বাহিরে রাখতি স্বস্থি বোধ করি। তবুও মাঝে মাঝে আবেগকে প্রশমিত করা বড় বেশি কঠিন হয়ে উঠে।
২৬ শে মার্চ ২০২২, বলাকা খচিত লাল সবুজের পতাকা নিয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স টরন্টোর পিয়ারসন্স আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করবে, এ সংবাদে নিজের আবেগকে সংবরণ করা বড় বেশি কঠিন হয়ে উঠেছিল। তাই ‘বিমানের সাফল্য চাই’ শিরোনামে লিখেছিলাম। যুগান্তর সহ বিভিন্ন পত্রিকার মতামত কলামে ২৫ শে মার্চ ২০২২ তারিখে লিখাটি প্রকাশিত হয়েছিল। সেদিন নানা প্রত্যাশার কথা লিখেছিলাম, সফলতার অন্তরায় কি হতে পারে, সেদিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম। কানাডার প্রবাসী কমিউনিটিতে বাংলাদেশ বিমানের উদ্বোধনী ফ্লাইট নিয়ে চরম এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া বিরাজমান ছিল। কেউ বলছিলেন লোক দেখানো, কেউবা অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়ার আশংকা ব্যক্ত করেছিলেন!
ভেবেছিলাম, বছর পূর্তিতে বিমান নিয়ে লিখবো। সেই লক্ষ্যে ঢাকা-টরন্টোর বিমান যাত্রীদের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া গভীর ভাবেই পর্যবেক্ষণ করছিলাম। উদ্বোধনী ফ্লাইটের যাত্রী চাকসুর সাবেক জিএস আজিম ভাই থেকে শুরু করে শতাধিক যাত্রীর মতামত জানার সুযোগ হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভ্রমণ অভিজ্ঞতার বহু গল্প পড়ারও সৌভাগ্য হয়েছে। যাঁরা এক সময়ে বিমানের সমালোচনায় মুখর ছিলেন, তাদের অাত্বতুষ্টির কথা শুনে বিস্ময় লাগে। কেউ বলছে, অসাধারণ গ্রাহক সেবা, কেউ বলছে তুলনাহীন, কেউ বা বলছে এখন থেকে স্বদেশ ভ্রমণে বিমান-ই প্রথম এবং শেষ পছন্দ। একটু আগ বাড়িয়ে কেউবা বলছেন, ‘আমার দেখা সর্বোচ্চ গ্রাহক সেবা’। খাবারের মান, আর বিমান কর্মীদের আচার আচরণে সবার কন্ঠেই স্বস্তির সুর!! এসব শুনে বিস্ময় লাগে, প্রশ্ন জাগে- বিমান কি তাহলে বদলে যাচ্ছে!!
পরিচ্ছন্নতা নিয়ে কিছু যাত্রীর অভিযোগ আছে, তবে এ দায়টি কোনভাবেই শুধুমাত্র বিমান ক্রুদের উপর চাপিয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে যাত্রীদের দায়িত্বশীল ভূমিকা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। টিকেটিং আরও সহজলভ্য হওয়া প্রয়োজন। অনেক সময় অনলাইনে টিকেট পাওয়া দুরূহ হয়ে উঠে, আবার অনেক যাত্রী অনলাইনের চেয়ে ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে টিকেট ক্রয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। আক্ষেপ আছে, টরন্টোর বাহিরে কোন ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে বিমানের টিকেট পাওয়া যায় না বা টিকেট করার সুযোগ নেই। কেলগেরী, ভ্যানকুবার, মন্ত্রিয়াল এর মতো শহরে প্রচুর বাংলাদেশী বসবাস করলেও এসব শহরের সাথে কোন ডমেস্টিক এয়ারলাইন্সের কানেকটিং না থাকায় পছন্দের শীর্ষে থাকলেও অনেক যাত্রী বিমানের সেবা গ্রহণে বঞ্চিত হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ভেবে দেখলে উদ্দেশ্য পূরণে এটি অনেক বেশি সহায়ক হতে পারে।
যাত্রী সেবা সব সময়ই চ্যালেঞ্জিং। তাবত দুনিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় এয়ারলাইন্সের বিরুদ্ধেও অসন্তুষ্টির অভিযোগ শুনা যায়। তবে এর মাত্রা কতটা সহনীয় সেটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। গত ছয় মাসে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ঢাকা টরন্টো ফ্লাইট নিয়ে বিবেচনা নেয়ার মতো কোন অভিযোগ চোখে পড়েনি। বিরূপ আবহাওয়ার কারণে একটি ফ্লাইট সময়মতো ঢাকায় অবতরণ করতে না পারায়, দীর্ঘ পরিভ্রমণে ক্লান্ত শিশু সন্তানসহ এক যাত্রীর ফেসবুক লাইভ, কিছুটা অসহিষ্ণুতার বহিঃপ্রকাশ হলেও এটি কোনভাবেই যাত্রীসেবার সাথে সম্পর্কিত ছিল না।
বিমান নিয়ে নেতিবাচক গল্প শুনেই আমরা অভ্যস্ত, এর মাঝে বিমানের টরন্টো অফিস কি ব্যতিক্রম! গত মাসে বাংলাদেশ বিমানে দেশে যাওয়ার উদ্দেশ্যে চার সদস্যের এক পরিবার পাসপোর্ট সংক্রান্ত জটিলতায় নির্দিষ্ট তারিখে যাত্রা করতে পারেনি। আবার গ্রহণযোগ্য সময়ে টিকেট বাতিলও করতে পারেনি। সমস্যাটি নিয়ে গ্রাহক স্বশরীরে বিমান অফিসে হাজির হয়েছিল। তদবির ছাড়া দ্রুততম সময়ে এমন সমস্যার সন্তোষজনক সমাধানে যাত্রীর মন্তব্য, ‘বিমান কি তাহলে বদলে গেছে?’ তবে, বিমানের টরন্টো অফিসের ফোন সংযোগ নিয়ে অনেক আক্ষেপের কথা শুনা যায়। জনবলের সংকট হয়তো এ ক্ষেত্রে মূখ্য কারণ হতে পারে।
আজ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বরাতে প্রচারিত একটি সংবাদ, হ্রদয় মনে এক অন্যরকম অনুভূতির জন্ম দেয়। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, ‘স্মার্ট এয়ারলাইন্স’ হিসেবে আত্নপ্রকাশের পরিকল্পনায় এগিয়ে যাচ্ছে!! সংবাদটি সুখকর, চ্যালেঞ্জ থাকলেও অসম্ভব নয়। বিমানের ঢাকা টরন্টো ফ্লাইট, পদ্মাসেতু আর মেট্রোরেলই তার অকাট্য প্রমাণ। বঙ্গবন্ধু কন্যার আগামী দিনের স্মার্ট বাংলাদেশের পরিকল্পনার সাথে সঙ্গতি রাখতেই নাকি এই স্বপ্ন বিলাসী পরিকল্পনার সূত্রপাত! সামাজিক ব্যাধি দূর্নীতিকে ‘না’ বলতে পারলে, আর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলে, কোন কিছুই অসম্ভব নয়। ঢাকা-টরন্টো পথের যাত্রী সেবার অনুকরণে, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আর বিমানের সকল রুটেই যদি সমমানের সেবা অব্যাহত রাখা যায়, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ‘স্মার্ট এয়ারলাইন্স’ এ রুপান্তরের পরিকল্পনা কোন ভাবেই কল্পনা প্রসূত নয়। লাল সবুজের পতাকায় বলাকা খচিত বিমান ‘স্মার্ট এয়ারলাইন্স’ হয়ে জাতীয় গৌরবের অংশীদার হয়ে উঠুক- এটিই আজকের প্রত্যাশা।
লেখকঃ কলামিস্ট উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক এবং সাধারণ সম্পাদক, আলবার্টা রাইটার্স ফোরাম, কানাডা।