জীবন ও স্বাস্থ্য ফিচার্ড

খেজুরের রস খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা জানেন?

খেজুরের-রস-খাওয়ার-উপকারিতা-ও-অপকারিতা

খেজুরের রস খাওয়ার উপকারিতা জানলে প্রতিদিন নিয়ম করে এক গ্লাস করে খাবেন!

বাংলাদেশে শীতকালে হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডার মধ্যে কাঁচা খেজুরের রস খাওয়ার প্রচলন আছে। কেউ কেউ আবার এ রস প্রক্রিয়াজাত করে পিঠা-পুলি, পায়েস, গুড় তৈরি করেন। সারা বছর খেজুরের রস সংগ্রহ করা যায় তবে শীতকালের খেজুরের রস সবচেয়ে বেশি সুস্বাদু ও সুমিস্ট হয়। শীত কমার সঙ্গে সঙ্গে রসের পরিমাণ ও মানও কমতে থাকে।

শীতকালে খেজুরের রসের উপকারিতা ও অপকারিতা নিয়ে কলাম লিখেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট গবেষক ও জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ…

খেজুরের রস প্রচুর খনিজ ও পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ। এতে ১৫-২০% দ্রবীভূত শর্করা থাকে, যা থেকে গুড় ও সিরাপ উৎপাদন করা হয়। খেজুরের গুড় আখের গুড় থেকেও বেশি মিষ্টি, পুষ্টিকর ও সুস্বাদু। ঘ্রাণ ও স্বাদের জন্য এ গুড়ের রয়েছে বিশেষ চাহিদা। খেজুরের গুড়ে আখের গুড়ের চেয়ে বেশি প্রোটিন, ফ্যাট ও মিনারেল রয়েছে। সকালের নাশতায় খেজুর রসের সিরাপ দিয়ে রুটি খেলেই বেশি তৃপ্তি পাওয়া সম্ভব।

খেজুরের রস খাওয়ার উপকারিতা :
খেজুরের রস খাওয়ার উপকারিতা জানলে এবার থেকে প্রত্যেক শীতে নিয়ম করে প্রতিদিন এক গ্লাস রস খাবেন। তাহলে শুরু করা যাক খেজুর রসের উপকারিতা এর সাতকাহন:

প্রকৃতির এনার্জি ড্রিংকস খেজুর রস :
খেজুর রসে সরল শর্করা বা ফ্রুক্টোজ ও গ্লুকোজ থাকে প্রায় ১৫ ২০%। এই মিশ্রিত শর্করার সঙ্গে প্রচুর খনিজ লবণ ও মিনারেল থাকে। এত উপকারী উপাদান একসঙ্গে উত্তম অনুপাতে মেশানো থাকে ফলে এটি যেকোনো কৃত্রিম এনার্জি ড্রিংকস এর চাইতে বেশি ভালো ও স্বাস্থ্যকর। এক গ্লাস খেজুরের রস পান করলে নিমিষেই এনার্জি পাওয়া যায়। রসের গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজ দ্রুত রক্তে মিশে গিয়ে শক্তির অভাব দূর করে।

রক্ত স্বল্পতা দূর করে খেজুর রস :
রসে লৌহ বা আয়রন সুপ্ত অবস্থায় থাকে যদি রস জ্বাল করে গুড় বা লালি তৈরি করা হয় তবে এতে প্রচুর আয়রন থাকে। রক্তস্বল্পতা দূর করতে প্রতিদিন এক টুকরা গুড় বা এক চামুচ লালি খাওয়া উচিত। বাংলাদেশে খেজুর গুড়ের পিঠা খাওয়া বেশ প্রচলিত তাই বিপুল জনগোষ্ঠীর মোটামুটি ১/৫ অংশ এই শীতকালে রক্ত স্বল্পতার হাত থেকে রক্ষা পায়।

পেশীকে মজবুত করে :
পেশির স্বাভাবিক কার্যকারিতা সচল রাখতে পটাসিয়াম ও সোডিয়াম বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখে। খেজুরের রসে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম ও সোডিয়াম থাকে তাই রস বা গুড় পেশীকে শক্তিশালী করে। পেশীর অসারতা দূর করতেও এটি কাজ করে। স্নায়ুকোষ পরস্পর যুক্ত থাকে নিউরন নামের সংযোগ স্থলে। এই স্থান দিয়ে অনুভূতির সংকেত চলাচল করে। পটাশিয়াম ও সোডিয়াম স্নায়ু সংকেত চলাচলে প্রধান ভূমিকা রাখে।

ক্লান্তিভাব দূর করে :
ম্যাগনেসিয়াম এর ঘাটতির কারণে আমাদের অবসন্ন বা ক্লান্তি ভাব আসে। রসে রয়েছে প্রচুর ম্যাগনেশিয়াম। এটি পান করলে ক্লান্তিভাব দূর হয় এবং দেহের সজীবতা ফিরে আসে।

হাড় মজবুত করে :
খেজুর রসের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ক্যালসিয়াম। এটি হাড় ও পেশী গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। হাড়ের প্রধান উপাদান ক্যালসিয়াম এর অভাব দূর করে খেজুর রস।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় :
রসে প্রচুর এন্টিঅক্সিডেন্ট থাকে এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি করে। দেহের ক্ষতিকর উপাদান বের করে দেয়।

ভিটামিনের অভাব দূর করে :
রসে ভিটামিন বি-৩ থাকে। এটি রক্ত উৎপাদন ও ইমিউন সিস্টেমকে সাহায্য করে। ভিটামিন সি কোষের বর্জ্য পদার্থ দূর করে। সর্দিকাশির হাত থেকে বাঁচায়।

ওজন কমাতে সাহায্য করে :
রসের মিষ্টি স্বাদের কারণ অশোধিত চিনি। এটি ধীরে ধীরে রক্তে মিশে যায় ফলে দেহে চর্বি কম জমে। কিন্তু সাধারণ চিনি দ্রুত রক্তে মেশে তাই চিনির খুব ভালো বিকল্প হতে পারে খেজুরের রস। রসে পর্যাপ্ত পটাশিয়াম থাকায় এটি বিপাক ক্ষমতা বাড়ায় ফলে অতিরিক্ত চর্বি দেহে কম জমে এতে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে।

কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে :
রসে প্রচুর ফাইবার বা আঁশ থাকে। এটি মলের পরিমাণ বাড়ায় এবং মল নরম করে ফলে রস কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে। খেজুর গুড় একই কাজ করে। এটি অনিদ্রা দূর করতেও সাহায্য করে।

হজম ক্ষমতা বাড়ায় :
রস আমাদের হজমে অংশগ্রহণকারী এনজাইমগুলোর ক্ষরণ ও কাজের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ফলে খাবার তাড়াতাড়ি হজম হয়। খাওয়ার পর সামান্য পরিমাণ রস বা গুড় খেলে হজম তাড়াতাড়ি হবে।

খেজুর রসের অপকারিতা:
খেজুর রসের অনেক উপকারিতার কথা জানলেন তাহলে এবার অপকারিতা সম্পর্কে জানুন।

যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের খেজুর রস না খাওয়াই ভালো কারণ এর ভেতর থাকা চিনি ডায়াবেটিসের সমস্যা বাড়িয়ে দিতে পারে।

কিডনি রোগী খেজুর রস পান করলে সমস্যা হতে পারে। রসের পটাশিয়াম কিডনির সমস্যা সৃষ্টি করে।

রক্তের সমস্যা আছে এমন রোগীর রস না খাওয়া উচিত।

হাপানী বা অ্যাজমা আছে এমন রোগীর ঠাণ্ডা রস পান করা উচিত নয় এতে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যেতে পারে।

বাদুড় রস পান করে রসের হাঁড়ি থেকে আর বাদুড়ের মুখ থেকে বিভিন্ন রোগের জীবাণু ছড়িয়ে পরে রস পান করার মাধ্যমে।

কখন খাবেন, কখন খাবেন না:

খেজুরের রস ভোরবেলায় খাওয়া ভালো। সারা রাত ধরে রস জমে থাকার পর সকাল সকাল এ রস খেলে উপকার পাওয়া যায়। তবে সময় যত গড়াতে থাকে, তত এতে ফারমেন্টেশন বা গাঁজন প্রক্রিয়া হতে থাকে।

এতে রসের স্বাদ নষ্ট হয় এবং অম্লতা বাড়ে। অন্ধকারে এই প্রক্রিয়া কম হয়, কিন্তু দিনের আলোতে গাঁজন বেশি হয়। তাই দিনের বেলা রস খাওয়া ঠিক নয়। এতে বমিসহ পেটের নানা সমস্যা হতে পারে। খেয়াল রাখতে হবে, খেজুরের রসে যেন কোনো পোকামাকড় মুখ না দেয়। বাদুড় বা পাখির মুখ দেয়া রস খেলে রোগ হতে পারে।

কতটুকু রস খাবেন: একজন সুস্থ মানুষ সকালে এক থেকে দুই গ্লাস রস খেতে পারেন। সকালে খালি পেটে খেলেও সমস্যা নেই। যেহেতু এটি এনার্জি ড্রিংক, তাই শরীরে শক্তি জোগাতে পরিমাণমতো রস খাওয়া ভালো।

কীভাবে খাবেন: রাতে বা সকালে রস খেতে পারেন বা রসের তৈরি বিভিন্ন খাবার খেতে পারেন। তবে রস যেহেতু খোলা অবস্থায় গাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়, তাই এতে জীবাণু থাকতে পারে। এটা অস্বাস্থ্যকর। এজন্য রস আগুনে হালকা আঁচ দিয়ে বা ফুটিয়ে নিয়ে খাওয়া ভালো। এ ছাড়া রস জ্বাল দিয়ে বিভিন্ন খাবার তৈরি করে খেতে পারেন।

খেজুর রস খাওয়ার আগে কিছু সাবধানতা: খুব সকালবেলা সূর্যের তাপ বেড়ে যাওয়ার আগেই রস পান করা উচিত। ফাঙ্গাস বা ছত্রাক বাতাসে ভেসে রসের সাথে মিশে যায় এবং সূর্যের তাপে গরম হওয়া রসকে ফারমেন্টেশন করে ফলে প্রথমে এলকোহল বা মদ তৈরি হয় পরে আরো ফারমেন্টেশনের কারণে ভিনেগার তৈরি হয়। এ ধরনের রস পান করলে পেট খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। রসের হাঁড়ি অবশ্যই যেন জাল বা কাপড় দিয়ে ঢাকা থাকে এই বিষয়টি খুব মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করতে হবে। বাদুড় হাঁড়ির ভেতর মুখ ঢুকিয়ে রস খায়। এ থেকে নিপা ভাইরাসের সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই খেজুরের রস ফুটিয়ে খাওয়া বেশি নিরাপদ।

পরিশেষে বলতে চাই, এখন শীতকাল। এসময় গাছিরা খেজুর গাছ থেকে খেজুর রস আহরণে ব্যস্ত। তারা খেজুর রস থেকে গুড় বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। অনেকে খেজুর গুড় বানানোর পাশাপাশি খেজুর রসও বিক্রি করে কিন্তু এই খেজুর রসের একটি মারাত্মক অপকারিতা রয়েছে, তা আমরা অনেকেই অবগত নই। গাছিরা বিকালে খেজুর গাছে মাটির হাঁড়ি লাগিয়ে আসে। মাটির হাঁড়ি সর্বত্রই খোলা অবস্থায় থাকে। রাতে ওই খোলা খেজুর রসের হাঁড়িতে বাদুড় এসে বসে এবং রস পান করে। তখন রসের সঙ্গে বাদুড়ের মুখনিঃসৃত লালা মিশে যায়। আর এভাবেই বাদুড়ের মাধ্যমে মানুষের শরীরে নিপা নামের ভাইরাস আক্রমণ করে বসে। নিপা ভাইরাস একটি মারাত্মক ভাইরাস। এই ভাইরাসে কেউ আক্রান্ত হলে প্রথমে জ্বর আসে। একপর্যায়ে খিঁচুনি, অতঃপর মৃত্যুও হতে পারে। যেহেতু রোগটি বাদুড়চাটা খেজুর রস পান করার জন্য হয়ে থাকে, সেহেতু আমাদের খেজুর রস আহরণে সতর্ক হতে হবে। আসুন আমরা স্বাস্থ্যসচেতন হই, সতর্কতা অবলম্বন করি।

লেখক, প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
কলাম লেখক ও গবেষক
ইমেইল:[email protected]

সূত্রঃ মানবজমিন


সংবাদটি শেয়ার করুন