বিশ্বে প্রভাবশালী ৫০০ মুসলিমের মধ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম স্থান পেয়েছে। জর্ডানের অভিজাত রয়েল ইসলামিক স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ সেন্টার সোমবার প্রভাবশালী মুসলিম নেতাদের তালিকা সংবলিত ৩২১ পৃষ্ঠার একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এর নাম দেয়া হয়েছে ‘পারসন্স অব দ্য ইয়ার: দ্য ওয়ার্ল্ডস মোস্ট ৫০০ ইনফ্লুয়েন্সিয়াল মুসলিমস’। এই তালিকায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের ব্যাপক প্রশংসা করা হয়েছে।
অন্যদিকে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী কী অবস্থার মধ্যে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন তা তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়, শেখ হাসিনার শাসনকাল রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও বিতর্কিত হয়ে আছে। ছাত্র বিক্ষোভের ফলে দেশ শাসন করা শেখ হাসিনার জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে। ছাত্রদের নেতৃত্বে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে উত্তেজনা চরম আকার ধারণ করে। তার ফলে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রিপোর্টে বাংলাদেশ অধ্যায়ে ড. ইউনূস সম্পর্কে বলা হয়েছে- শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর ছাত্রদের আহ্বানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে যোগ দিতে বলা হয়। এই সরকারের কাজ হবে অন্তর্বর্তী সময় ক্ষমতায় থাকা এবং একটি নতুন নির্বাচন করা। ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন অর্থনীতিবিদ এবং ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা, শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী। তার ক্ষুদ্র ঋণ ধারণা কোনোরকম জামানত বা গ্যারান্টার ছাড়াই ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে দারিদ্র্য দূরীকরণের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। ড. ইউনূসের এই মডেলে ঋণ নিয়েছেন এক কোটি ৬ লাখ মানুষ। তার মধ্যে শতকরা ৯৭ ভাগই নারী। এই মডেল বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে।
দারিদ্র্যদূরীকরণে ড. ইউনূসের অর্জন এবং যে প্রতিশ্রুতি তার জন্য তিনি গভীর শ্রদ্ধা পেয়েছেন। দেশের এই উত্তাল সময়ে তিনি দেশকে পরিচালনার জন্য একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করার তিন দিনের মাথায় তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিয়েছেন। রাজনৈতিক অস্থিরতা, দারিদ্র্য এবং নির্ভরতাভিত্তিক অর্থনীতির ফলে যে চাপ দেশের কাঁধে তাতে তাকে এ পদে নিয়োগ দেয়ায় আশার আলো জেগেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু অগ্রগতি সত্ত্বেও বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ অন্যতম সবচেয়ে দরিদ্র দেশ হিসেবে রয়ে গেছে। এখনো অব্যাহতভাবে গভীর কাঠামোগত চ্যালেঞ্জের মুখে। এমন একটি ইস্যু হলো দেশটির গার্মেন্ট শিল্প। এতে কাজ করেন প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক। দেশের রপ্তানির শতকরা ৮২ ভাগ এই খাতের। বছরের পর বছর ধরে এসব শ্রমিক অমানবিক পরিস্থিতিতে কাজ করছিলেন। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসে পড়ে। এতে কমপক্ষে এক হাজার মানুষ নিহত ও কমপক্ষে ২৫০০ আহত হন। এর ফলে এই খাতে অনিয়মের বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি পড়ে। যদিও ওই ট্র্যাজেডির পর কিছুটা সংস্কার হয়েছে, তবু এই শিল্পের পরিস্থিতি এখনো অনিরাপদ। বেতন কম।
বলা হয়, ২০২৪ সালটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ বছরেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের নেতা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করেন। তার ক্ষমতার সময় উল্লেখযোগ্যভাবে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও বিতর্কিত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেছে। এর ফলে বাংলাদেশের সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
এ বছরের এই উত্তেজনাকর অবস্থার সূত্রপাত হয় মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মীয়স্বজনদের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বহাল রাখা নিয়ে। এর প্রতিবাদে সারা দেশে ছাত্ররা তীব্র প্রতিবাদ শুরু করে। এর আগে ২০১৮ সালে এমন আন্দোলন হয়েছিল। ফলে কোটা বাতিল হয়েছিল। কিন্তু এবার তা আবার পুনর্বহালের রায় দেন আদালত। ফলে ২০১৩ ও ২০১৮ সালের মতো আন্দোলন এবার শুরু হয়।
কিন্তু এ বছর প্রতিবাদ বিক্ষোভ ফুটন্ত পানির মতো ফুটতে থাকে। জুলাই মাসে আন্দোলন দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। লাখ লাখ মানুষ রাজপথে নেমে আসেন। হতাশাগ্রস্ত মানুষ তাতে অংশ নেন। তারা কর্তৃত্ববাদী, দুর্নীতিপরায়ণ এবং অপশাসনের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠেন। নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা নিষ্ঠুরভাবে শক্তি প্রয়োগ করে। এতে বিপুল সংখ্যক মানুষ নিহত হন। বিক্ষোভ আরও ফুঁসে ওঠে। শেখ হাসিনার শাসন চালিয়ে নেয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। ৫ই আগস্ট তিনি পালিয়ে ভারতে চলে যান। এর মধ্যদিয়ে তার দীর্ঘমেয়াদি শাসনের অবসান ঘটে। তার বিদায়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক আবহে বড় রকম পরিবর্তন ঘটে। নেতৃত্বশূন্যতা দেখা দেয়। ছাত্রদের নেতৃত্বে তা দ্রুত সমাধান করা হয়।
এতে আরও বলা হয়, দেশকে স্থিতিশীলতায় আনা, প্রতিষ্ঠানগুলোতে আস্থা ফেরানো, অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার এক দুর্দান্ত কাজ হাতে নিয়েছেন ড. ইউনূস। জনগণ যখন একটি পরিবর্তনের জন্য উদগ্রীব এবং ছাত্ররা সংস্কার দাবির কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করছেন, তখন বাংলাদেশ এক ‘ক্রিটিক্যাল ক্রসরোডে’। ২০২৪ সালটি নিঃসন্দেহে দেশের ইতিহাসে একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে স্মরণ করা হবে। একে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের ইতি এবং নতুন একটি অধ্যায়ের সূচনা হিসেবে দেখা হবে। এই তালিকায় ৫০০ প্রভাবশালী মুসলিম নেতার মধ্যে ড. ইউনূসের অবস্থান ৪৫০। কিন্তু তার মধ্যে আবার সর্ব শীর্ষ ৫০ জনকে বাছাই করা হয়েছে। তাতে ড. ইউনূসের অবস্থান ৫০তম।